শনিবার ১০ মে ২০২৫ - ১৫:৪৪
রউফ ইমাম: দয়ার জীবন্ত প্রতিচ্ছবি

ক্ষমাশীলতা একজন মানুষের মর্যাদা বাড়ায় বৈ কমায় না। অতএব তোমরা একে অপরকে ক্ষমা করো—আল্লাহ তোমাদের সম্মান বাড়িয়ে দেবেন।

হাওজা নিউজ এজেন্সি রিপোর্ট অনুযায়ী, “রউফ ইমাম: দয়ার জীবন্ত প্রতিচ্ছবি”

قالَ الإمامُ الرِّضا (ع):
"العَفوُ لا يُزيدُ العَبدَ إلّا عِزّاً، فَتَعافَوا يَعِزَّكُمُ اللهُ."
“ক্ষমাশীলতা একজন মানুষের মর্যাদা বাড়ায় বৈ কমায় না। অতএব তোমরা একে অপরকে ক্ষমা করো—আল্লাহ তোমাদের সম্মান বাড়িয়ে দেবেন।”
—( তুহাফুল উকূল)

ভূমিকা
ইসলামের ইতিহাসে আহলুল বাইতের প্রতিটি ইমামই মানবতার পথপ্রদর্শক, করুণা ও ত্যাগের প্রতীক। তাঁদের মধ্যে অষ্টম ইমাম, হযরত আলী ইবনে মূসা আল-রেজা (আঃ), তাঁর অসাধারণ ধৈর্য, দয়া ও জ্ঞানগরিমার জন্য বিশেষভাবে স্মরণীয়। তিনি “ইমাম রউফ”—অর্থাৎ “করুণাশীল ইমাম”—উপাধিতে প্রসিদ্ধ। তাঁর জন্মদিনে আমরা তাঁর জীবন, গুণাবলি ও ‘রউফ’ উপাধির তাৎপর্য নিয়ে কিছু আলোচনা করব।

ইমাম রেজা (আঃ)-এর সংক্ষিপ্ত জীবনী:
ইমাম রেজা (আঃ) হিজরি ১৪৮ সালের ১১ই যিলক্বাদ মাসে মদিনায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ছিলেন সপ্তম ইমাম হযরত মূসা কাযিম (আঃ), আর মাতা ছিলেন “নাজমা খাতুন”  একজন পবিত্র ও ধার্মিক মহিলা। ছোটবেলা থেকেই তিনি জ্ঞানে, আখলাকে ও ইবাদতে অনন্য ছিলেন।

ইমাম রেজা (আঃ)-কে মামুন আব্বাসি রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে খিলাফতের উত্তরাধিকারী ঘোষণা করেন এবং তাঁকে জোরপূর্বক মদিনা থেকে খোরাসানে নিয়ে যান। যদিও এটি একটি চক্রান্ত ছিল, কিন্তু সেই ভূমিতে তাঁর উপস্থিতি ইসলামের জ্ঞান, দয়া ও আধ্যাত্মিকতার আলো ছড়িয়ে দিয়েছিল।

‘রউফ’ উপাধির তাৎপর্য:
‘রউফ’ শব্দটি আরবি “رَؤُوف” থেকে এসেছে, যার অর্থ “অত্যন্ত দয়ালু ও করুণাময়”। আল্লাহ নিজেই কুরআনে নিজের জন্য এই গুণবাচক নাম ব্যবহার করেছেন:

 إِنَّ رَبَّهُم بِهِمۡ يَوۡمَئِذٖ لَّخَبِيرٞ رَّحِيمٞ رَؤُوفٌ
অর্থাৎ, “নিশ্চয়ই তাদের রব তাদের প্রতি খবর রাখেন, তিনি পরম দয়ালু ও করুণাশীল।” (সূরা তাওবা: ১১৭)

এই উপাধি ইমাম রেজা (আঃ)-এর জন্যও ব্যবহার করা হয়, কারণ তিনি সর্বদা মানুষের বিপদে পাশে দাঁড়াতেন, শত্রুকেও ক্ষমা করতেন এবং দরিদ্রদের বিশেষ যত্ন নিতেন। এমনকি তাঁর রওজা শরিফ এখনো দরিদ্র ও নিপীড়িতদের আশ্রয়স্থল।

ইমামের রউফ গুণাবলি:
১. অসাধারণ ধৈর্য: মামুনের ষড়যন্ত্র, ভ্রান্ত অপবাদ ও যন্ত্রণাময় বিষ প্রয়োগের মধ্যেও তিনি ধৈর্য হারাননি।
২. দয়ার নিদর্শন: খাদেম থেকে শুরু করে অপরিচিত মেহমান—সবাই তাঁর দয়া ও ভালোবাসার ছায়া পেতেন।
৩. জ্ঞানচর্চা ও যুক্তিতর্ক: তিনি বিভিন্ন ধর্ম ও দর্শনের পণ্ডিতদের সঙ্গে আলোচনা করে ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব তুলে ধরতেন।

ইমাম রেজা (আঃ)-এর দয়ার কিছু বাস্তব ঘটনা ইতিহাসে বিশদভাবে লিপিবদ্ধ আছে, যেগুলো তাঁর "রউফ" (করুণাশীল) চরিত্রের জীবন্ত প্রমাণ। নিচে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা তুলে ধরা হলো:

১. খাদেমদের সাথে একত্রে আহার:
ইমাম রেজা (আঃ) কখনো নিজেকে আলাদা করে খাওয়াতেন না। একবার তাঁর এক সাথী দেখলেন, তিনি তাঁর খাদেমদের সঙ্গে বসে একসাথে খাচ্ছেন।
লোকটি বলল, “আপনি তো মর্যাদাবান ব্যক্তি, খাদেমদের থেকে আলাদা খেলে তো দোষ নেই।”
ইমাম বললেন:
“আল্লাহ এক, মা এক, পিতা এক, হিসাবের দিন এক—তবে আমি কেন নিজেকে শ্রেষ্ঠ ভাবব?!”

২. পথের ভিখারীদের নিজ হাতে খাওয়ানো:
খোরাসানে যাওয়ার পথে একবার তিনি কিছু দরিদ্র মানুষকে দেখলেন যারা মাটিতে বসে খাবার খাচ্ছিল। তিনি নামলেন এবং নিজ হাতে তাদের সঙ্গে বসে খেতে লাগলেন।
সাথীরা বলল, “আপনি যদি তাদেরকে কিছু দান করতেন তাও হতো, কিন্তু নিজে বসে খাচ্ছেন কেন?”
ইমাম রেজা (আঃ) বললেন:
“আমি নিজে দয়ালু হতে এসেছি, অহংকারী নয়।”

৩. অন্ধ ব্যক্তি ও ইনসাফ:
এক অন্ধ লোককে কেউ ধাক্কা মেরে দূরে সরিয়ে দিচ্ছিল। ইমাম রেজা (আঃ) তা দেখে সামনে গিয়ে তাঁকে সম্মান দিয়ে বসতে দিলেন, এবং তাঁর প্রয়োজন জেনে সঙ্গে সঙ্গে সাহায্য করলেন।
তিনি বলতেন:
“কোনো মানুষের দুর্বলতা কখনোই তার মর্যাদার কমতি নয়।”

৪. হাদিয়ায় পছন্দের গুরুত্ব:
একবার কেউ তাঁকে কিছু খেজুর উপহার দেয়। তিনি সবার মাঝে তা বণ্টন করে নিজে সবচেয়ে ছোট অংশটি রাখলেন।
কেউ জিজ্ঞেস করলে বললেন:
“দাতা যদি খুশি হন যে তার উপহার গ্রহণ করা হয়েছে—তাহলেই দয়ার পূর্ণতা ঘটে।”

এই ঘটনাগুলো শুধু কাহিনী নয়, বরং আদর্শ—কিভাবে ক্ষমতা, জ্ঞান ও মর্যাদার চূড়ায় থেকেও একজন মানুষ বিনয়, দয়া ও মানবতাকে নিজের জীবনের প্রধান ভিত্তি করতে পারেন। এই গুণগুলিই তাঁকে “রউফ ইমাম” নামের যোগ্যতা দিয়েছিল।

জন্মদিনের তাৎপর্য:
ইমাম রেজা (আঃ)-এর জন্মদিন শুধু তাঁর স্মরণে নয়, বরং মানবতার প্রতি দয়া, ধৈর্য ও জ্ঞানচর্চার পথে আমাদের উদ্বুদ্ধ হওয়ার দিন। ইরানের মাশহাদে অবস্থিত তাঁর রওজা শরীফ আজও সেই দয়ার সাগর যা মানুষকে শান্তি ও আশ্রয় দান করে।

উপসংহার:
ইমাম রেজা (আঃ) ছিলেন করুণা ও সত্যের আলোকবর্তিকা। তাঁর ‘রউফ’ উপাধি কেবল একটি নাম নয়, বরং তাঁর জীবনচরিতের এক সুন্দর প্রতিচ্ছবি। এই মহান জন্মদিনে আমাদের কর্তব্য হলো তাঁর শিক্ষা ও আদর্শকে হৃদয়ে ধারণ করা এবং সমাজে দয়া, জ্ঞান ও ন্যায়ের আলো ছড়িয়ে দেওয়া।

লেখক: কবির আলী তরফদার কুম্মী।
তারিখ:১০/০৫/২০২৫

আপনার কমেন্ট

You are replying to: .
captcha