মঙ্গলবার ২০ মে ২০২৫ - ১৭:৩৩
ইমাম মাহদী (আ.)-এর গায়েবাতের দর্শন

প্রশ্ন জাগে যে, কেন আল্লাহর হুজ্জাত ও ইমাম- মাহদী (আ.ফা.) পর্দার অন্তরালে অবস্থান করছেন? কোন কারণ মানুষকে তাঁর উপস্থিতির বরকত থেকে বঞ্চিত করেছে?

হাওজা নিউজ এজেন্সি: আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, আল্লাহ সুবহানাহু তাআলা কোনো কাজই হিকমত ও মাসলেহাত (যথোপযুক্ত কারণ) ছাড়া করেন না—তা ছোট হোক বা বড়। আমরা সে হিকমত বুঝি বা না বুঝি। 

বিশ্বের সব ঘটনা— ছোট ও বড়—আল্লাহর ইচ্ছা ও তদ্বিরেই সংঘটিত হয়। এর মধ্যে ইমাম মাহদী (আ.)-এর গায়েবাতও একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। সুতরাং, তাঁর গায়েবাতও হিকমত ও মাসলেহাতের ভিত্তিতেই হয়েছে, যদিও আমরা এর দর্শন সম্পূর্ণভাবে জানি না। 

তবে, যে ব্যক্তি আল্লাহর সব কাজকে হিকমতপূর্ণ মনে করে এবং সেগুলোর কাছে আত্মসমর্পণ করে, সে কিছু ঘটনার রহস্য জানার জন্য উদগ্রীব হয়, যাতে হৃদয়ে প্রশান্তি ও নিশ্চিন্তি বৃদ্ধি পায়। তাই, আমরা ইমাম মাহদী (আ.)-এর গায়েবাতের হিকমত ও প্রভাব নিয়ে আলোচনা করব এবং এ সম্পর্কিত হাদীসগুলো উল্লেখ করব: 

১. মানুষের শাস্তি ও শিক্ষা
যখন উম্মত নবী বা ইমামের কদর না করে, তাদের দায়িত্ব পালন না করে, বরং তাদের আদেশ অমান্য করে, তখন আল্লাহর ন্যায়বিচার এই যে, তিনি তাদের নেতাকে তাদের থেকে সরিয়ে নেন। এতে মানুষ নিজেদের ভুল বুঝতে পারে এবং গায়েবাতের সময় ইমামের মূল্য ও বরকত উপলব্ধি করে। এভাবে, গায়েবাত উম্মতের জন্যই কল্যাণকর, যদিও (অধিকাংশ) মানুষই তা বুঝতে পারে না। 

ইমাম বাকির (আ.) বলেছেন,

إِنَّ اَللَّهَ إِذَا کَرِهَ لَنَا جِوَارَ قَوْمٍ نَزَعَنَا مِنْ بَیْنِ أَظْهُرِهِمْ

“যখন আল্লাহ কোনো জাতির সাথে আমাদের সহাবস্থান পছন্দ করেন না, তখন তিনি আমাদের তাদের মধ্য থেকে উঠিয়ে নেন।”  [ইলালুশ্ শারা’য়ে, খণ্ড- ১, পৃষ্ঠা- ২৪৪]

২. স্বাধীনতা ও অন্যের অধীনস্থ বা চুক্তিবদ্ধ না থাকা
যারা কোনো পরিবর্তন বা বিপ্লব সাধন করতে চায়, তাদেরকে প্রাথমিক পর্যায়ে কিছু বিরোধী শক্তির সাথে চুক্তি করতে হয়। কিন্তু ইমাম মাহদী (আ.ফা.) হলেন সেই মহান সংস্কারক, যিনি কোনো জালিম শক্তির সাথে কোনো ধরনের আপস বা চুক্তি করবেন না। কারণ হাদীস অনুযায়ী, তিনি সকল অত্যাচারী শক্তির বিরুদ্ধে স্পষ্ট ও দৃঢ় সংগ্রাম পরিচালনা করবেন। তাই, বিশ্বব্যাপী ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি না হওয়া পর্যন্ত তিনি গায়েবাতে থাকবেন, যাতে কোনো জালিম শক্তির সাথে বাধ্যতামূলক কোনো চুক্তিতে আবদ্ধ হতে না হয়। 

ইমাম রেযা (আ.) বলেছেন,

لِئَلاَّ یَکُونَ لِأَحَدٍ فِی عُنُقِهِ بَیْعَةٌ إِذَا قَامَ بِالسَّیْفِ

“যাতে তিনি যখন তরবারি হাতে নিয়ে (ন্যায়ের পক্ষে) রুখে দাঁড়াবেন, তখন কারো সাথে তাঁর কোনো পূর্ববর্তী আনুগত্যের চুক্তি বাকী না থাকে।” [কামালুদ্দীন, খণ্ড- ২, পৃষ্ঠা- ৪৮০]

এই নীতির মাধ্যমে ইমাম মাহদী (আ.)-এর আন্দোলন সম্পূর্ণ স্বাধীন ও নিঃশর্তভাবে পরিচালিত হবে, যা তাকে সকল প্রকার রাজনৈতিক সমঝোতা বা আপস থেকে মুক্ত রাখবে।

৩. মানুষের পরীক্ষা
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ'লার একটি সুন্নত হলো মানুষকে বিভিন্নভাবে পরীক্ষা করা, যাতে তাদের সত্যের পথে অবিচলতা প্রকাশ পায়। এই পরীক্ষার ফল আল্লাহ জানেন, কিন্তু এর মাধ্যমে বান্দারা নিজেদের প্রকৃতি বুঝতে পারে। 

ইমাম কাযেম (আ.) বলেছেন, 

إِذَا فُقِدَ اَلْخَامِسُ مِنْ وُلْدِ اَلسَّابِعِ فَاللَّهَ اَللَّهَ فِی أَدْیَانِکُمْ لاَ یُزِیلُکُمْ عَنْهَا أَحَدٌ یَا بُنَیَّ إِنَّهُ لاَ بُدَّ لِصَاحِبِ هَذَا اَلْأَمْرِ مِنْ غَیْبَةٍ حَتَّی یَرْجِعَ عَنْ هَذَا اَلْأَمْرِ مَنْ کَانَ یَقُولُ بِهِ إِنَّمَا هِیَ مِحْنَةٌ مِنَ اَللَّهِ عَزَّ وَ جَلَّ اِمْتَحَنَ بِهَا خَلْقَهُ

“যখন ইমামের সাত সন্তানের পঞ্চম সন্তান (ইমাম মাহদী আ.) অদৃশ্য হবেন, তখন - হে প্রিয় সন্তান! - আল্লাহকে স্মরণ করো, আল্লাহকে স্মরণ করো তোমাদের দ্বীনের ব্যাপারে। কোনো ব্যক্তি যেন তোমাদেরকে তোমাদের ধর্ম থেকে বিচ্যুত করতে না পারে। নিশ্চয়ই ইমামের জন্য একটি গায়েবাত (অদৃশ্যতা) অনিবার্য, এমনকি যারা ইমামতের বিশ্বাসী ছিল তারাও এ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে। নিঃসন্দেহে এই গায়েবাত মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি পরীক্ষা, যার মাধ্যমে তিনি তাঁর সৃষ্টিকে পরীক্ষা করেন।”

(সূত্র: আল-কাফি, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩৩৬)

৪. ইমামের প্রাণরক্ষা
নবী-রাসূলগণ যখন নিজ সম্প্রদায়ের হুমকির সম্মুখীন হতেন, তখন তারা আত্মরক্ষার্থে গোপনে চলে যেতেন। যেমন, রাসূল (সা.) মক্কা ত্যাগ করে গারে সোরে লোকচক্ষুর আড়ালে ধ্যানমগ্ন ছিলেন। ইমাম মাহদী (আ.ফা.)-এর গায়েবাতেরও একটি কারণ হলো তাঁর প্রাণরক্ষা। 

ইমাম সাদিক (আ.) বলেছেন,

إِنَّ لِلْقَائِمِ غَیْبَةً قَبْلَ ظُهُورِهِ قُلْتُ [وَ] لِمَ قَالَ یَخَافُ اَلْقَتْلَ

“নিশ্চয়ই কায়েম (ইমাম মাহদী আ.)-এর জন্য তাঁর“প্রকাশের পূর্বে একটি গায়েবাত (অদর্শনকাল) রয়েছে।” 

জিজ্ঞাসা করা হল: 'কেন?'  
তিনি উত্তরে বললেন  'তিনি নিজ প্রাণের ভয়ে (গায়েবাতে থাকবেন)।”

[গায়েবাহ (অদৃশ্যতা)- শেখ তুসি, খণ্ড- ১, পৃষ্ঠা- ৩৩২]

শাহাদত মুমিনের কামনা, কিন্তু তা তখনই কাম্য যখন তা দ্বীন ও সমাজের জন্য কল্যাণকর হয়। কিন্তু ঐ সময় ইমাম মাহদী (আ.ফা.)-এর শাহাদত মানে আল্লাহর শেষ প্রতিশ্রুতি—বিশ্বব্যাপী ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা—অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ'লা তা করবেন না। তাই তিনি হযরত ঈসা (আ.)-এর মতই ইমাম মাহদী (আ.ফা.)’কে দীর্ঘ গায়েবাতের মাধ্যমে তাঁর মিশন সম্পন্ন করার জন্য নিরাপদ করেছেন।

উপসংহার
গায়েবাত আল্লাহর একটি রহস্য, যার পূর্ণ কারণ কেবল ইমাম মাহদী (আ.ফা.)’র আবির্ভাবোর পরই সুস্পষ্ট হবে। উপরোক্ত কারণগুলো কেবল গায়েবাতের ক্ষেত্রে প্রভাব রেখেছে। 

গ্রন্থসূত্র: “নেগীনে অফারিনেশ” (সামান্য পরিবর্তন ও পরিমার্জন সহকারে) 

চলবে...

Tags

আপনার কমেন্ট

You are replying to: .
captcha