বুধবার ২১ মে ২০২৫ - ১৭:৫৯
ইমাম মাহদী (আ.ফা.)’র গায়েবাত—  যেন মেঘের আড়ালে সূর্য

গায়েবাত ইমামের (আ.ফা.) অস্তিত্বের প্রয়োজনীয়তার দর্শনকে বাতিল করে না; কারণ গায়েবাতের সময়েও ইমাম বিদ্যমান থাকেন এবং তাঁর কল্যাণ অন্যদের কাছে পৌঁছায়। কেবলমাত্র কিছু কল্যাণ মানুষের নিজেদের ত্রুটির কারণে গায়েবাতের সময় তাদের কাছে পৌঁছায় না। আর এজন্যই মানুষকে প্রস্তুতির মাধ্যমে ইমামের আবির্ভাবের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে।

হাওজা নিউজ এজেন্সি: গায়েবাতের সময় ইমাম মাহদী (আ.ফা.)-এর উপকারিতা সম্পর্কে মাসুম ইমামগণের বক্তব্যে একটি সুন্দর উপমা দেওয়া হয়েছে— গায়েবাতের সময় তাঁকে মেঘের আড়ালে থাকা সূর্যের সাথে তুলনা করা হয়েছে। নিঃসন্দেহে এই উপমাটি গভীর প্রজ্ঞাপূর্ণ। শিয়া পণ্ডিতগণ এই উপমার মাধ্যমে বেশ কিছু মূল্যবান বিষয় উল্লেখ করেছেন, যার মধ্যে কয়েকটি নিম্নরূপ: 

১. সৌরজগতে সূর্য হলো কেন্দ্র ও ভিত্তি। ঠিক তেমনই ইমাম যামান (আ.) মানুষের জীবনের কেন্দ্র ও ভিত্তি। 

২. সূর্য মহাবিশ্বে অগণিত উপকার বিতরণ করে, যার মধ্যে আলো দেওয়া কেবল একটি অংশ। অনুরূপভাবে, ইমাম যামান (আ.ফা.)ও সৃষ্টিজগতে অসংখ্য কল্যাণের উৎস, যার সামান্য অংশই কেবল তাঁর দৃশ্যমানতার উপর নির্ভরশীল। 

৩. মেঘ সূর্যের মুখমণ্ডলকে পৃথিবীবাসীর দৃষ্টি থেকে আড়াল করে, কিন্তু পৃথিবীকে অন্ধকারে ঢেকে দেয় না। গায়েবাতের পর্দাও মানুষকে সরাসরি ইমামের দর্শন থেকে বিরত রাখে, কিন্তু তাঁর আলো থেকে বঞ্চিত করে না। 

৪. মেঘের সৃষ্টি পৃথিবী ও পৃথিবীবাসীর বৈশিষ্ট্যের কারণে, সূর্যের কারণে নয়। অনুরূপভাবে, গায়েবাতও মানুষের কর্মের ফল। 

৫. মেঘ কেবল তাদের জন্যই বাধা যারা এর নিচে অবস্থান করে। যদি কেউ পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ অতিক্রম করে মেঘের উপরে উঠে যায়, তাহলে মেঘ আর বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। গায়েবাতের ক্ষেত্রেও, যদি কেউ worldly desires বা দুনিয়াবি আকাঙ্ক্ষা অতিক্রম করে আধ্যাত্মিক উৎকর্ষ লাভ করে, তাহলে গায়েবাতের পর্দা ভেদ করে সেই লুক্কায়িত সূর্যের দর্শন লাভ করতে পারে। 

৬. সূর্যের আলো উপভোগ করার ক্ষেত্রে, যারা সূর্যের অস্তিত্বে বিশ্বাস করে এবং যারা অস্বীকার করে- তাদের মধ্যে কোনো পার্থক্য হয় না। অনুরূপভাবে, ইমামের তাকবীনী (প্রাকৃতিক) কল্যাণ লাভের ক্ষেত্রেও বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসীর মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। 

৭. কেবল তারাই সত্যিকার অর্থে মেঘ সরে যাওয়ার অপেক্ষায় থাকে, যারা সূর্যের সমস্ত উপকারিতা সম্পর্কে সম্যক জ্ঞাত। গায়েবাতের সময়ও ইমাম সম্পর্কে পূর্ণ জ্ঞানই প্রকৃত ইমামের অপেক্ষা’কে অর্থবহ করে তোলে। 

এবং আরও অনেক কিছু... 

সুতরাং, এতে কোনো সন্দেহ নেই যে যখন কোনো বাধা থাকে না, তখন সৃষ্টিজগৎ সূর্য থেকে অধিকতর ও পূর্ণাঙ্গ কল্যাণ লাভ করে। তবে, এর অর্থ এই নয় যে মেঘের আড়ালে থাকা সূর্যের সমস্ত বা অধিকাংশ কল্যাণ বিনষ্ট হয়; বরং এই বাধা কেবল কিছু কল্যাণ কমিয়ে দেয় বা বাধাগ্রস্ত করে। 

ইমামের প্রকাশ্য উপস্থিতি ও আবির্ভাবের যুগের অর্থ হলো তাঁর সমস্ত কল্যাণ মানুষের কাছে পূর্ণমাত্রায় পৌঁছানোর সুযোগ সৃষ্টি হওয়া। তবে যদি কোনো কারণে ইমামের পূর্ণ কল্যাণ মানুষের কাছে পৌঁছাতে বাধাগ্রস্ত হয়, তাহলে তা কখনই তাঁর অস্তিত্বকে নিরর্থক করে না। গায়েবাতের পর্দার আড়ালে ইমামের উপস্থিতি ঠিক ততটাই ফলপ্রসূ, যতটা ফলপ্রসূ ছিল জালিম শাসকদের কারাবন্দী অবস্থায় তাঁর অবস্থান। অবশ্য গায়েবাতের কারাবন্দীতা ও অত্যাচারী শাসকদের কারাবন্দীতার মধ্যে অনেক মৌলিক পার্থক্য রয়েছে; তবে উভয় অবস্থাই ইমামের পূর্ণ কল্যাণ সৃষ্টিজগৎ ও মানবজাতির কাছে পৌঁছাতে কিছু না কিছু বাধার সৃষ্টি করে। 

সারসংক্ষেপে, গায়েবাতের বিষয়টি কখনই ইমামের অস্তিত্বের দার্শনিক প্রয়োজনীয়তাকে অকার্যকর করে না। কারণ গায়েবাতের সময়েও ইমাম (আ.ফা.) পূর্ণরূপে বিদ্যমান থাকেন এবং তাঁর অফুরন্ত কল্যাণ মানুষসহ সমগ্র সৃষ্টিজগৎকে স্পর্শ করতে থাকে। কেবলমাত্র কিছু বিশেষ কল্যাণ মানুষের নিজেদের অপ্রস্তুতি ও আধ্যাত্মিক অযোগ্যতার কারণে তাদের কাছে পূর্ণমাত্রায় পৌঁছায় না। এজন্য মানবজাতির একান্ত কর্তব্য হলো নিজেদেরকে আধ্যাত্মিক, নৈতিক ও সামাজিকভাবে প্রস্তুত করে ইমাম (আ.ফা.)-এর প্রকাশের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করা। 

এই আলোচনা চলবে...

‘ফারহাঙ্গনামায়ে মাহদাভিয়্যাত' গ্রন্থ থেকে (সামান্য সম্পাদিত ও পরিমার্জিত) 

Tags

আপনার কমেন্ট

You are replying to: .
captcha