হাওযা নিউজ এজেন্সি রিপোর্ট অনুযায়ী, আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ীর দৃষ্টিতে ইসলামী সভ্যতা একটি পাঁচ ধাপবিশিষ্ট ও অগ্রগামী প্রক্রিয়া। তিনি বলেন:
“আমরা একটি ইসলামি বিপ্লব করেছি, এরপর ইসলামি শাসনব্যবস্থা গঠন করেছি, এরপরের ধাপ হচ্ছে ইসলামি সরকার প্রতিষ্ঠা, তার পরবর্তী ধাপ ইসলামি রাষ্ট্র গঠন, এবং চূড়ান্ত ধাপ হলো আন্তর্জাতিক ইসলামি সভ্যতা প্রতিষ্ঠা। আজ আমরা ইসলামি সরকার ও ইসলামি রাষ্ট্রের ধাপে রয়েছি।” (২০০৪/১০/২৮)
ইসলামী সভ্যতা একটি ধাপে ধাপে অগ্রসরমান প্রক্রিয়া যার প্রতিটি স্তরের নির্দিষ্ট শর্ত রয়েছে এবং এটি স্বাভাবিক যে পূর্ববর্তী ধাপ বাস্তবায়িত না হলে পরবর্তী ধাপ অর্জন সম্ভব নয়। (২০০১/১২/১২)
এই ধাপে ধাপে এগিয়ে যাওয়া সভ্যতাগত যাত্রায় ধীরে ধীরে বিভিন্ন বিষয় পূর্ণতা লাভ করে এবং এটি সুপরিকল্পিত, গভীর পর্যবেক্ষণ ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার মাধ্যমে সম্পাদন করতে হয়। তাৎক্ষণিক, আবেগনির্ভর ও ক্ষণস্থায়ী পদক্ষেপ থেকে বিরত থাকতে হয়।
তিনি বলেন:
“ইসলামি ব্যবস্থার মহা-আন্দোলন এবং সেই আদর্শ ভবিষ্যতের দিকে যাত্রা — অর্থাৎ একটি ইসলামি সভ্যতা গঠন; এমন একটি সভ্যতা যেখানে জ্ঞান থাকবে নৈতিকতার সঙ্গে, বস্তুবাদ থাকবে আধ্যাত্মিকতা ও ধর্মের সঙ্গে, রাজনৈতিক ক্ষমতা থাকবে ন্যায়বিচারের সঙ্গে — এটি একটি ধাপে ধাপে অগ্রসরমান আন্দোলন। হ্যাঁ, এটি আবেগপূর্ণ, কিন্তু প্রত্যেকের জানা উচিত যে সে কী করছে। প্রতিটি পদক্ষেপই উত্তেজনাপূর্ণ, কিন্তু এই ঐতিহাসিক ও দীর্ঘস্থায়ী কাজ, যা প্রজন্ম ও শতাব্দীগুলোর সঙ্গে সম্পৃক্ত, সেটিকে তাৎক্ষণিক ও আংশিক বা কেবলমাত্র স্লোগান ভিত্তিক কার্যক্রম বলে ভেবে নেওয়া উচিত নয়। প্রতিটি পদক্ষেপ যেন আগের চেয়ে বেশি মজবুত হয়, প্রতিটি ধাপ যেন সুদূরদর্শী দৃষ্টিতে নেওয়া হয়।” (২০০০/১০/৫)
ইসলামী সভ্যতা গঠনের জন্য যা প্রয়োজন:
আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ীর বহু বক্তব্য পর্যালোচনা করলে বোঝা যায়, তাঁর মতে, ইসলামী সভ্যতা গঠনের জন্য কিছু মূলনীতি ও বৈশিষ্ট্য রয়েছে। তিনি বিশ্বাস করেন, সমাজ একটি উন্নয়নশীল প্রক্রিয়া এবং একটি জীবন্ত সভ্যতা সর্বদা উৎকর্ষের দিকে অগ্রসর হয় (২০০৪/৯/১৫)। এই যাত্রায় সত্য অবশ্যই মিথ্যার ওপর বিজয়ী হবে এবং আল্লাহর প্রতিশ্রুতি অনুসারে দুর্বলদের শাসন প্রতিষ্ঠা হবে। এই বার্তা আবারও আলেম সমাজের প্রতি তাঁর সাম্প্রতিক বার্তায় উচ্চারণ করা হয়েছে:
“এই মিথ্যা সভ্যতা অবশ্যই বিলুপ্ত হবে; এটি সৃষ্টির অবশ্যম্ভাবী নিয়ম: ‘নিশ্চয়ই মিথ্যা মুছে যাবে’ (ইসরা ১৭:৮১), ‘ফেনা চলে যায়, আর যা মানুষের উপকারে আসে তা জমিতে স্থির থাকে’ (রাদ ১৩:১৭)। আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে, প্রথমত এই মিথ্যা সভ্যতা বিলুপ্ত করতে সাহায্য করা এবং দ্বিতীয়ত আমাদের সাধ্য অনুযায়ী বিকল্প সভ্যতা গড়ে তোলা।” (২০২৫/০৫)
তিনি বলেন, ইসলামি সভ্যতা গঠিত হতে পারে — এটি কেবল একটি ধারণা নয় বরং একটি বাস্তবতাও হতে পারে। কিন্তু এটি অর্জন করতে হলে প্রয়োজনে আত্মত্যাগ, কঠোর পরিশ্রম, এবং বিশ্বাস রাখতে হবে:
“যে বলে ‘অন্যরা পারেনি, তাই আমরাও পারব না’ — এটি একটি বিভ্রান্তিকর কথা। অন্যরা যখন বিশ্বাস, হিসাব ও ধৈর্যের সঙ্গে এগিয়েছে, তখন সফল হয়েছে। আমাদের চোখের সামনে আছে — ইসলামি বিপ্লব এবং ইসলামি প্রজাতন্ত্র।” (২০২৫/০৫)
এই সভ্যতাগত প্রতিযোগিতায় পেছনে পড়ে থাকা, নিরপেক্ষ থাকা নিরাপত্তা দেয় না; বরং বিচ্ছিন্নতা বয়ে আনে। (২০১২/১০/১০)
ইসলামি সভ্যতা গঠনের পথে প্রতিদ্বন্দ্বী সভ্যতা সম্পর্কে জ্ঞান থাকা জরুরি। প্রতিদ্বন্দ্বী সভ্যতার ইতিবাচক দিক — যেমন আবিষ্কার, প্রযুক্তি ও উদ্ভাবন — গ্রহণ করতে হবে; অন্যদিকে, হিউম্যানিজম, সেক্যুলারিজম, প্র্যাগম্যাটিজমের মতো দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গিভিত্তিক উপাদান বর্জন করতে হবে। (২০১৬/১২/২৯)
পাশাপাশি, পশ্চিমা সভ্যতা শুধু বিজ্ঞান ও জ্ঞানেই সীমাবদ্ধ নয়; এর রয়েছে একটি আদর্শগত দিক, যা স্বার্থের জন্য অনৈতিক ও বৈধতাহীন দখল, উপনিবেশ, এবং প্রকৃতির ওপর সর্বগ্রাসী কর্তৃত্বকে বৈধতা দেয়। পশ্চিম এই পথেই এশিয়া, আফ্রিকা ইত্যাদি অঞ্চলের ওপর আধিপত্য স্থাপন করেছিল, যার পরিণাম ছিল তাদের পতন। ইসলামি সভ্যতা এই জায়গায় নৈতিকতা ও ন্যায়বিচারের মাধ্যমে বিপরীত মডেল উপস্থাপন করে। (২০০৮/৮/২৬)
পশ্চিম-জ্ঞান চর্চা ইসলামী সভ্যতার বোঝাপড়ায় গুরুত্বপূর্ণ। পশ্চিম কীভাবে পুরনো উপনিবেশ থেকে নতুন উপনিবেশ এবং অবশেষে নব্য-উপনিবেশে পরিণত হয়েছে তা বোঝা জরুরি, যেন ইসলামি গবেষকরা পশ্চিমা লিবারাল ও সমাজতান্ত্রিক ধারার চিন্তার প্রভাবে না পড়েন। (২০০۴/৬/১১)
তিনি আরও বলেন:
“ইসলামী সভ্যতা বর্তমান ভোগবাদী সভ্যতার সম্পূর্ণ বিপরীতে। এই সভ্যতা শুরু থেকেই উপনিবেশ, হত্যা, বর্ণবাদ, মিথ্যা, শ্রেণীবৈষম্য ও অবাধ যৌনতার ওপর প্রতিষ্ঠিত। আজ আমরা এর পরিণাম দেখছি পশ্চিমে — সম্পদের পাহাড়ের পাশে দারিদ্র্যের খাদ, দুর্বলদের ওপর শক্তিধরদের দমন-পীড়ন, বিজ্ঞানকে গণহত্যার অস্ত্রে পরিণত করা, পরিবারে যৌন বিপর্যয়, শিশুদের
দুর্ব্যবহার, গাজা ও ফিলিস্তিনে নির্মমতা এবং অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ।” (২০২৫/০৫)
সভ্যতা নির্মাণের জন্য প্রয়োজন আত্মবিশ্বাস, “আমরা পারব” — এই বিশ্বাস, দেশীয় সক্ষমতার উপর নির্ভরতা, এবং শত্রুর মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধের ফাঁদে না পড়ে সাহসিকতার সঙ্গে এগিয়ে চলা। (দ্বিতীয় ধাপ বিবৃতি, ২০১৯/২/১১)
তবে এই রূপান্তরের পথে ধৈর্য ও দৃঢ়তা অপরিহার্য। নবী করিম (সা.)-এর জীবনী এ বিষয়ে একটি মূল্যবান শিক্ষণীয় দৃষ্টান্ত:
“এই সংগ্রামে আঘাত, ক্ষতি, যন্ত্রণা ও প্রাণহানী থাকবে, কিন্তু ধৈর্য ধরলে বিজয় নিশ্চিত। রাসূল (সা.) মক্কা থেকে গোপনে বেরিয়ে গুহায় আশ্রয় নেন; আট বছর পর বিজয়ের গৌরবে মক্কায় প্রবেশ করেন এবং কাবাকে মূর্তিমুক্ত করেন।” (২০২৫/০৫)
এই ধৈর্য আমাদের যুগেও প্রযোজ্য — যেমন ছিল আমাদের ৮ বছরব্যাপী সম্মিলিত প্রতিরোধ যুদ্ধ। ক্বুমের বর্তমান কার্যকরী ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান সেই কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে এসেই গড়ে উঠেছে। (২০২৫/০৫)
একইসঙ্গে ধর্মীয় শিক্ষার ক্ষেত্রেও প্রয়োজনীয় — সংকীর্ণতা, স্থবিরতা ও মতবাদ মিশ্রণের প্রবণতা থেকে মুক্ত থেকে ইসলামের মৌলিক উৎস ও যুক্তিনির্ভর গবেষণার উপর জোর দিতে হবে। (২০১০/১০/২১)
তিনি বলেন:
“ইসলামী সভ্যতার কাঠামো চিত্রণে ফিকহ ও যুক্তিবিজ্ঞান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আমাদের ইসলামী দর্শনকে সমাজের বাস্তব প্রয়োগের দিকে নিয়ে যেতে হবে। আমাদের ফিকহকেও নতুন নতুন সমস্যাগুলোর সমাধান দিতে হবে।
ইমাম খোমেইনির ‘ইজতেহাদ জাওয়াহেরি’ পদ্ধতি — যা ঐতিহ্যবাহী কিন্তু সময় ও প্রেক্ষাপটের প্রতি সংবেদনশীল — এই ক্ষেত্রেও নির্দেশনাদানকারী।” (২০২৫/০৫)
অন্যদিকে, ধর্মীয় শিক্ষার সংস্কার, আধুনিক জ্ঞানের ব্যবহার, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয়ের একীকরণ, বিষয়ভিত্তিক জ্ঞানের বিকাশ, এবং ইসলামি সমাজব্যবস্থার তত্ত্ব নিরূপণ — এগুলো ইসলামি সভ্যতা নির্মাণে অপরিহার্য। (২০০৭/১১/২৯ এবং ২০২৫/০৫)
এই সবগুলো প্রয়াস মিলিত হয়ে আজকের ধর্মীয় শিক্ষাকে নেতৃত্বদানকারী রূপে পরিণত করতে পারে।
সংক্ষেপে:
হওয়ার মতো ইসলামী সভ্যতা গঠনে ধর্মীয় শিক্ষাব্যবস্থার প্রথম কাজ হলো — এই সভ্যতার মৌলিক ও সহায়ক কাঠামো নির্ধারণ, এবং তারপর তা সমাজে প্রচার ও সংস্কৃতিতে পরিণত করা। এটিই “স্পষ্ট বার্তা প্রদান”-এর এক উৎকৃষ্ট উদাহরণ। (২০২৫/০৫)
ধর্মীয় উৎসের গভীর অনুধাবন, সমসাময়িক জগতের চ্যালেঞ্জসমূহের বোঝাপড়া, দর্শন ও বিশ্বাসের দৃঢ়তা, কুরআনের তাফসির জ্ঞানে গভীরতা, এবং যুগোপযোগী ইজতেহাদ, সব মিলিয়ে এই সভ্যতা নির্মাণের পথ সুগম করতে পারে এবং নতুন প্রজন্মের মনে আশা জাগাতে পারে।
আপনার কমেন্ট