হাওজা নিউজ এজেন্সি: ফিলিস্তিন ও সিরিয়ায় ইহুদিবাদ বিরোধী যোদ্ধা থেকে শুরু করে হারাম ও ধর্মীয় স্থান রক্ষাকারী শহীদ ও করোনা মহামারিতে শহীদ চিকিৎসাকর্মী—এই সকল শহীদরা আমাদের ধর্মীয় বিশ্বাসে এক উচ্চ অবস্থানে রয়েছেন; কিন্তু এই বিষয়ের একটি প্রশ্ন ও সন্দেহ হলো, যাদের আমরা “শহীদ” বলে সম্মান দিই, তাদের কি আল্লাহর দৃষ্টিতেও সেই সম্মান রয়েছে?
এই প্রশ্ন ও সংশয়ের জবাব খোঁজার তাগিদেই আমরা সাক্ষাৎকার গ্রহণ করি ধর্মীয় সংশয় ও জটিলতার বিষয়ে একজন অভিজ্ঞ ও স্বীকৃত বিশেষজ্ঞ হুজ্জতুল ইসলাম রেজা পুর-ইসমাইল সাহেবের। শহীদ শব্দটির তাৎপর্য, প্রেক্ষাপট ও তার চারটি ভিন্ন ব্যাখ্যা—ফিকহি, সামাজিক, আইনগত ও আখিরাতসংক্রান্ত দিক থেকে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে তিনি অত্যন্ত সুচিন্তিত ও গভীর দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করেন। পাঠকদের জন্য সাক্ষাৎকারটির সারাংশ নিচে তুলে ধরা হলো:
হুজ্জতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমিন রেজা পুর-ইসমাইলের জবাব:
এই সংশয় এই স্থান থেকে জন্ম নেয় যে আমরা কখনো ভাবি, আমাদের দায়িত্ব বা আমাদের কাজ অবশ্যই কোনো নির্দিষ্ট বাস্তবতার সঙ্গে মিলে যেতে হবে।
উদাহরণস্বরূপ, যখন আমরা কোনো শহীদের শ্রদ্ধা করি, তার জন্য স্মরণসভা করি, তার নাম স্মরণে রাখি, ছবি টাঙাই, জমকালো জানাজা করি বা তার প্রশংসা করি—তখন আমরা মনে করি, সে অবশ্যই সেই উচ্চ মর্যাদায় পৌঁছেছে, যার ব্যাপারে কোরআনে বলা হয়েছে: «عِندَ رَبِّهِمْ يُرْزَقُونَ» (তারা তাদের প্রভুর নিকট রিযিকপ্রাপ্ত হয়); কিন্তু বাস্তবে বিষয়টি এমন নয়।
আমরা যারা দেশের জন্য, শত্রুর (যেমন ইসরায়েল) বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বা এমনকি যারা জীবনের সাধারণ অবস্থায় জুলুমের শিকার হয়ে নিহত হয়েছে—তাদের সম্মান করি। কেন? কারণ এই ব্যক্তিদের সম্মান জানানো আল্লাহর নিদর্শনগুলোর মহত্ব প্রতিষ্ঠা করা এবং সত্যপন্থী ফ্রন্টকে শক্তিশালী করা।
যেমন কোরআনে বলা হয়েছে:
وَمَن يُعَظِّمْ شَعَائِرَ اللَّهِ فَإِنَّهَا مِن تَقْوَى الْقُلُوبِ
অর্থাৎ যে কেউ আল্লাহর নিদর্শনসমূহকে শ্রদ্ধা করে, নিশ্চয় তা অন্তরের তাকওয়ার অন্তর্ভুক্ত। [সূরা হজ- ৩২]
অতএব, যখন আপনি এমন কিছু করেন, যাতে এসব মানুষের স্মরণ ও নাম উজ্জ্বল থাকে, তখন বাস্তবে আপনি আল্লাহর নিদর্শনগুলো সমাজে ছড়িয়ে দিচ্ছেন এবং সত্যপন্থী ফ্রন্টকে শক্তিশালী করছেন।
এখানে আলোচনা এই নয় যে, এই ব্যক্তিরা কি আল্লাহর কাছে শহীদের মর্যাদায় পৌঁছেছে কিনা; বরং আমরা যখন তাদের শহীদ হিসেবে স্মরণ করি, তখন আমরা তাদের সম্মান জানাচ্ছি এবং এই কাজটি একটি উত্তম কাজ, যার দিকনির্দেশনা স্পষ্ট।
এই শহীদদের মধ্যে এমন লোকজনও ছিলেন, যাদের বাহ্যিক চেহারা বা তাদের পর্দা ইসলামী আদর্শের সঙ্গে মানানসই ছিল না, অথবা এমন কেউ ছিলেন, যিনি কারাগারে ছিলেন এবং ইসরায়েলি হামলায় শহীদ হন; তবুও আমরা তাদের শহীদ বলি— কেন?
কারণ সামগ্রিকভাবে এই কাজের মাধ্যমে সত্যের ফ্রন্ট শক্তিশালী হয় এবং এই বাস্তবতা প্রকাশ পায় যে, এই ব্যক্তিদের ইসরায়েল হত্যা করেছে এবং ইসরায়েলের শত্রুতা কেবল ইসলামি প্রজাতন্ত্র বা নির্দিষ্ট কোনো দলের সঙ্গে নয়, বরং সেই সব স্বাধীনচেতা মানুষের সঙ্গেও, যারা তাদের জুলুমের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়।
যখন আমরা এই অপরাধী শাসকের হাতে নিহত লোকদের, এমনকি তারা যদি শরিয়তের দৃষ্টিতে পূর্ণতা অর্জন না-ও করে থাকেন, শহীদ বলি, তখন বাস্তবে আমরা এই জালিম শাসকের অপরাধ প্রকাশ করছি এবং দেখাচ্ছি যে, তারা এমনকি নিরস্ত্র বন্দি বা নিরপরাধ নাগরিককেও রেহাই দেয় না।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই ব্যক্তিদের আসল মর্যাদা কী?
‘শহীদ’ অন্তত চারটি অর্থে ব্যবহৃত হয়:
১. ফিকহি অর্থে শহীদ: অর্থাৎ সেই ব্যক্তি, যে যুদ্ধক্ষেত্রে ইমামে মাসুম বা তাঁর প্রতিনিধি (যেমন: ওয়ালিয়ে ফকিহ)-এর অধীনে যুদ্ধ করে শহীদ হন। এই শহীদদের জন্য নির্দিষ্ট বিধান রয়েছে (যেমন: গোসলের প্রয়োজন নেই)।
যারা ইসরায়েলি বোমা ও ক্ষেপণাস্ত্রে শহীদ হয়েছেন, তারা এই ফিকহি শহীদের সংজ্ঞায় পড়েন না।
২. প্রচলিত বা সামাজিক অর্থে শহীদ: ইসলামি সমাজে, বিশেষ করে ইরানে, ‘শহীদ’ শব্দটি ফিকহি অর্থের চেয়ে অনেক বিস্তৃত। এই দৃষ্টিকোণে, তাদেরও শহীদ বলা হয় যারা শত্রুর মোকাবিলায় নিহত হন (হোক যুদ্ধক্ষেত্রে, নিরাপত্তা রক্ষার কাজে অথবা চিন্তাশীল-সাংস্কৃতিক লড়াইয়ে), বা যারা জনসেবার কাজে প্রাণ হারান (যেমন: করোনা সময়ের স্বাস্থ্যকর্মী, সেবাশহীদ, নিরাপত্তা শহীদ)।
এই অর্থটি সমাজের মূল্যবোধ দ্বারা গঠিত এবং ফিকহি বিধান অনুসরণ করে না।
৩. আইনগত অর্থে শহীদ: ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানে “বুনিয়াদে শহীদ ও ওমুরে ইসারগরান (শহীদ ও গৌরবময়দের সংস্থা)” শহীদদের চিহ্নিত ও নিবন্ধনের দায়িত্বে থাকে। এই কাঠামোর মধ্যে, যাদের রাষ্ট্রীয় সংস্থা শহীদ ঘোষণা করে, তারা আইনি সুবিধা ভোগ করেন।
এই সংজ্ঞা একটি প্রশাসনিক অর্থ বহন করে এবং তা ফিকহি বা সামাজিক সংজ্ঞার সঙ্গে পুরোপুরি মিল না-ও থাকতে পারে।
৪. কালামী (আখিরাত) অর্থে শহীদ: শহীদ সেই ব্যক্তি, যার আল্লাহর নিকট একটি বিশেষ মর্যাদা রয়েছে এবং তিনি তাঁর সান্নিধ্যে অবস্থান করেন। এই অর্থ কোরআনের আয়াত থেকে নেয়া:
وَلَا تَحْسَبَنَّ الَّذِينَ قُتِلُوا فِي سَبِيلِ اللَّهِ أَمْوَاتًا ۚ بَلْ أَحْيَاءٌ عِندَ رَبِّهِمْ يُرْزَقُونَ
অর্থ: আর যারা আল্লাহর পথে নিহত হয়েছে, তাদের মৃত মনে করো না; বরং তারা জীবিত এবং তাদের পালনকর্তার নিকট রিযিকপ্রাপ্ত।” [আলে ইমরান- ১৬৯]
এই মর্যাদা কারা অর্জন করে?
আমরা কেউই নিশ্চিতভাবে বলতে পারি না, কে আখিরাতে শহীদের মর্যাদা লাভ করেছেন—যতক্ষণ না আল্লাহ স্বয়ং অথবা তাঁর কোনো বিশেষ ওলি আমাদের সে সম্পর্কে অবহিত করেন।
মানুষের অন্তরের অবস্থা ও প্রকৃত অবস্থান আমাদের অজানা। তবে এটুকু নিশ্চিতভাবে বলা যায়—যারা আল্লাহর কাছে প্রকৃত শহীদের মর্যাদা অর্জন করেন, তারা গভীর বিশ্বাস, আন্তরিকতা ও সৎকর্মে অগ্রগামী ছিলেন।
সুতরাং, শহীদের ফিকহি, সামাজিক ও আইনগত সংজ্ঞা—এই তিনটি দৃষ্টিকোণ সবসময় আখিরাতের মর্যাদার সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কযুক্ত নয়।
সম্ভব, কাউকে আমরা সামাজিক বা আইনি দৃষ্টিতে শহীদ বলি, কিন্তু আখিরাতে তিনি সেই মর্যাদা না-ও পেতে পারেন। আবার, এমনও হতে পারে—কোনো ব্যক্তি দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন, কিংবা রোগশয্যায় মৃত্যুবরণ করেছেন, অথচ তাঁর ইমান, সততা ও আত্মত্যাগপূর্ণ জীবনযাপন তাঁকে আল্লাহর কাছে শহীদের মর্যাদা দিয়েছে।
অতএব, প্রকৃত শহীদের আসল মান ও মর্যাদা নির্ধারণ একমাত্র আল্লাহর এখতিয়ার। আমাদের কাজ হল যথাসম্ভব অন্যায়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া, ন্যায়ের পক্ষে থাকা এবং আল্লাহর পথে আত্মত্যাগকারীদের সম্মান জানানো।
আল্লাহর নিকট শহীদের মর্যাদা
আল্লাহর দৃষ্টিতে শহীদ হওয়ার মর্যাদা এমন অনেকেই পেতে পারেন, যাঁদের বাহ্যিকভাবে শহীদের কোনো লক্ষণ দেখা যায় না। কেউ হয়তো রোগশয্যায় মৃত্যুবরণ করেছেন বা দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন—তবু তাঁর পবিত্র অন্তর, দৃঢ় ঈমান ও সৎকর্মের কারণে আল্লাহ তাঁকে শহীদের মর্যাদা দিয়ে সম্মানিত করতে পারেন।
এমনকি কেউ যদি যুদ্ধক্ষেত্রে না-ও নিহত হন, বরং সারা জীবন আল্লাহর আনুগত্য ও জনগণের কল্যাণে আত্মনিবেদন করে থাকেন, তাহলেও তিনি আল্লাহর কাছে শহীদের মর্যাদায় আসীন হতে পারেন।
অন্যদিকে, সমাজ কারো আত্মত্যাগকে স্বীকৃতি দিয়ে তাঁকে শহীদ হিসেবে সম্মান জানালে—তা নিঃসন্দেহে একটি মূল্যবান সাংস্কৃতিক ও নৈতিক উদ্যোগ, যা আত্মোৎসর্গ, প্রতিরোধ ও ন্যায়ের চেতনা জাগিয়ে রাখে। তবে এই সামাজিক স্বীকৃতি আখিরাতে শহীদের প্রকৃত মর্যাদার নিশ্চয়তা দেয় না।
সম্ভব, সমাজ যাঁকে শহীদ বলে গণ্য করছে, আল্লাহর কাছে তাঁর কোনো বিশেষ মর্যাদা নেই। আবার এমন অনেকে আছেন, যাঁদের সমাজ শহীদ বলে না, কিন্তু তাঁরা আল্লাহর দরবারে বিশেষভাবে সম্মানিত।
মূল বিষয় হলো—এই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত একমাত্র আল্লাহর এখতিয়ার। আমরা না জানি, না অনুমতি রাখি কারো আখিরাত নিয়ে নিশ্চয়তা উচ্চারণ করার।
আমাদের দায়িত্ব হলো—আল্লাহর পথে আত্মত্যাগকারী ও ন্যায়ের পক্ষে সংগ্রামরতদের যথাযথ সম্মান জানানো এবং সমাজে সত্য, ন্যায় ও প্রতিরোধের চেতনা জাগ্রত রাখা। অবশিষ্ট সবকিছু সেই অসীম জ্ঞান ও ন্যায়বিচারের অধিকারী আল্লাহর কাছেই সমর্পিত।
আপনার কমেন্ট