হাওজা নিউজ এজেন্সি রিপোর্ট অনুযায়ী, কারবালার ময়দানে সংঘটিত যুদ্ধ শুধু তরবারি ও বর্শার সংঘর্ষ ছিল না; এটি ছিল চেতনা ও অচেতনা, অস্তিত্ব ও অনস্তিত্বের মধ্যে এমন এক সংঘাত, যার প্রভাব থেকে গাছ, পাথর এমনকি সূর্য-চাঁদও রেহাই পায়নি।
একবার ভাবুন তো, সেই পাথরখণ্ডগুলো, যাদের কথা বলার ভাগ্য ছিল না, কিন্তু নবীজীর (সা.) স্পর্শ পেয়ে যারা “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ” উচ্চারণ করেছিল—তারা যখন রাসুলের (সা.) প্রিয় দৌহিত্রের তৃষ্ণার্ত মুখ ও রক্তে ভেজা পবিত্র দেহ দেখেছিল, তখন কী তাদের নীরবতা বিস্ফোরণ ঘটায়নি? বলা হয়, যখন ইমাম হুসাইন (আ.) শহীদ হলেন, নাইনাওয়ার প্রতিটি পাথর রক্তরঞ্জিত হয়েছিল—এ যদি তাদের কান্না না হয়, তবে আর কী?
সেই উট, যে তার ক্লান্ত শরীর নিয়ে নবীর দরবারে এসে হালকা হয়েছিলেন এবং মালিকের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানিয়েছিল, যখন দেখেছিল নবীর (সা.) কাঁধের আরোহী মাটি পড়ে আছে, দাফনহীন, ঘোড়ার খুর তার মর্যাদাকে পিষে দিচ্ছে—তখন তার চোখের জল কী চিরতরে মরুভূমির বালিতে অমর হয়ে যায়নি?
সেই গাছ, যারা একসময় তাদের শাখা নত করে নবীর পবিত্র পায়ের ধুলো স্পর্শ করত, তারা কি শোকের গভীর রাতে নিজেদের সবুজ বসন ছিঁড়ে কাঁদেনি?
যখন হযরত আলী (আ.)-এর কন্যার মাথা থেকে চাদর খুলে নেওয়া হয়েছিল, তখন কি সৃষ্টির প্রতিটি ছায়া নিজেকে লজ্জায় গুটিয়ে নেয়নি?
সেই বাতাস, যা একসময় নবীজীর (সা.) কেশ স্পর্শ করে সুবাসিত হত, যখন সে কারবালার ময়দানে বয়ে যায় এবং রক্ত ও তৃষ্ণার গন্ধ অনুভব করে—তখন কি সে চিরকাল কান্নার সুরে প্রবাহিত হয়নি?
সেই সূর্য, যা একসময় ইশারায় পশ্চিম থেকে উঠেছিল, সে কি সহ্য করতে পেরেছিল যে তার নিজের আলো—হুসাইন ইবনে আলী (আ.)—বিকেলে মাটিতে নিভে যাক? সেই দিনের সূর্যগ্রহণ ছিল আসলে সূর্যের লজ্জাজনিত কালিমা, যা সে মানবতার অপরাধে নিজের মুখে মেখে নিয়েছিল।
আর সেই চাঁদ, যে একদিন নবীজীর (সা.) ইশারায় দ্বিখণ্ডিত হয়ে তার আনুগত্য প্রমাণ করেছিল, তার বুকও তো ফেটে গিয়েছিল, যখন সে বর্শার ফলা থেকে নিজের প্রভুর চাঁদের মতো মুখটি অসহায়ভাবে দেখেছিল।
আকাশের ওপারে, ফেরেশতাদের কাতারে নিশ্চয়ই এক মৃত্যুর মতো নীরবতা ছড়িয়ে পড়েছিল। তাদের শ্বাস আটকে গিয়েছিল। তারা মাথা নিচু করে কাঁপা কাঁপা স্বরে জিবরাঈল (আ.)-এর কাছে জিজ্ঞাসা করেছিল, “হে ওহি বাহক! এই যে লাশের মাঝে পড়ে আছে, এ কি সেই নয়, যার জন্য আপনি জান্নাত থেকে দোলনা নিয়ে নামতেন? এই কি সেই, যার একটি দীর্ঘশ্বাসে আরশ কেঁপে উঠত? আজ তার এই নিঃসঙ্গতায় আকাশ কেন ফেটে পড়ছে না?”
সেই দিন শুধু মানুষকে হত্যা করা হয়নি—শব্দের অর্থকেও জবাই করা হয়েছিল। “ওফা” (বিশ্বস্ততা) লজ্জিত হয়ে গিয়েছিল, “তৃষ্ণা” মহাসমুদ্রকে ডাকছিল, আর “জুলুম” (অত্যাচার) নিজের ভয়াবহতায় কেঁপে উঠছিল। যুক্তির আয়না ভেঙে চুরমার হয়ে গিয়েছিল, আর দর্শনের ভাষা নির্বাক হয়ে পড়েছিল। যখন হৃদয়ের বেদনা, চোখের অশ্রু, ব্যথার নৃত্য এবং অবিরাম কান্নার প্রতীকগণ তাদের চূড়ান্ত অর্থ ছুঁয়ে ফেলে, তখনই কাইনাত প্রকৃত শোকের অর্থ বুঝেছিল।
এমন এক সময়ে, যখন ধৈর্যের প্রতিটি পাত্র উপচে পড়ে, তখন নিশ্চয়ই নাজাফে ইমাম আলীর (আ.) কক্ষে "যাকুব-যুগের" ক্রন্দন প্রতিধ্বনিত হয়েছিল: "يَا أَسَفَىٰ عَلَىٰ يُوسُفَ" (আহা, আমার ইউসুফ!)। আর মদিনার ফাতিমা (আ.)-র উদাস উঠানে দুঃখ ভারাক্রান্ত বাতাস বারি হাকের দরবারে বলেছিল: "إِنَّمَا أَشْكُو بَثِّي وَحُزْنِي إِلَى اللَّهِ" (আমি আমার দুঃখ ও কষ্টের আরজি শুধু আল্লাহর কাছেই পেশ করি)।
এটি শুধু আশুরার একটি ক্ষণ নয়—এটি কিয়ামত পর্যন্ত মানবতার বিবেকের উপর এক চিরন্তন প্রশ্ন। আর হুসাইন (আ.)-এর শোক সেই মানদণ্ড, যার ভিত্তিতে প্রতিটি যুগে সত্য ও মিথ্যার বিচার হয়ে যাবে।
মজিদুল ইসলাম শাহ
আপনার কমেন্ট