বৃহস্পতিবার ২৪ জুলাই ২০২৫ - ১৫:৪০
গাজার শিশুরা তাকিয়ে আছে, না, কিছু চাইছে

আমরা যদি আজ তাদের জন্য কিছু না করি, তাহলে আগামীকাল আমাদেরই কণ্ঠস্বর নীরব হয়ে যাবে। গাজার শিশুরা আমাদের সকলের কাছে মানবতার চূড়ান্ত পরীক্ষা। তাদের পাশে দাঁড়ানো মানে আমাদের নিজেদের অস্তিত্বের প্রতি দায়বদ্ধ থাকা, মানবতার প্রতি শ্রদ্ধা জানানো।

হাওজা নিউজ এজেন্সি রিপোর্ট অনুযায়ী.

ভূমিকা:

পৃথিবীর কোনো শিশু যুদ্ধের জন্য জন্মায় না। তারা জন্মায় ভালোবাসার জন্য, খেলাধুলার জন্য, গল্প শুনে ঘুমিয়ে পড়ার জন্য, আর শান্তিময় এক পৃথিবীর কোলে বেড়ে ওঠার আশায়। কোনো শিশু তার প্রথম কথাগুলোর সাথে সাথে বন্দুকের গর্জন শোনার কথা নয়, প্রথম হাঁটার চেষ্টার সময় পায়ের নিচে ধ্বংসস্তূপ থাকার কথা নয়। অথচ গাজার শিশুরা আজ সেই ভয়াবহ বাস্তবতার মুখোমুখি।

তারা জন্ম থেকেই দেখে এসেছে যুদ্ধের ধ্বংস, বোমার শব্দে ঘুম ভাঙা, প্রিয়জনদের রক্তাক্ত দেহ-এক ভয়াবহ, অমানবিক চিত্র যা কোনো শিশুর স্মৃতিতে থাকার কথা নয়। তাদের চোখে আজ আর কোনো স্বপ্ন নেই, নেই হাসি বা নিস্পাপ কৌতূহল। তাদের নিরব চোখজোড়া যেন শত সহস্র প্রশ্নে ভরপুর: "পৃথিবী আমাদের জন্য এত নিষ্ঠুর কেন?"

এই শিশুরা আমাদের সভ্যতার আয়না। তাদের দিকে তাকালেই আমরা বুঝতে পারি, মানবতা কতটা পেছনে পড়ে গেছে। গাজার শিশুরা আজ কেবল একটি অঞ্চল বা একটি সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি নয়-তারা হয়ে উঠেছে সেই নিপীড়িত মানবজাতির প্রতীক, যারা কেবল শান্তি চায়, নিরাপত্তা চায়, আর একটু মমতা চায়।

তাদের চোখের দিকে তাকিয়ে আমাদের বিবেক জেগে ওঠে, কারণ এই দৃষ্টির অন্তরালে লুকিয়ে আছে একটিমাত্র অনুরোধ: "আমাদের জন্য কিছু করো।" এই আবেদন কেবল রাজনৈতিক নয়, এটি এক গভীর মানবিক আহ্বান-যা আমাদের চিন্তা, করুণা, এবং কার্যকর পদক্ষেপ দাবি করে।

অত্যাচার ও নিপীড়নের ছোবলে শিশুতা হারানো

গাজা উপত্যকা আজ যেন এক বিশাল বন্দিশালা, যেখানে অসহায় শিশুরা বন্দী হয়ে পড়েছে। বছরের পর বছর ধরে চলা ইসরায়েলি অবরোধ, ক্রমাগত সংঘর্ষ এবং ধ্বংসাত্মক বিমান হামলার ছোবলে গাজার এই ছোট্ট উপত্যকাটি পরিণত হয়েছে একটি বন্দি এলাকা হিসেবে, যেখানে শিশুরা তার শৈশব হারাচ্ছে প্রতিনিয়ত। শান্তির স্বপ্ন কখনো দেখা হয় না, কারণ তাদের চারপাশে সারাক্ষণ বোমার গর্জন, বন্দুকের গুলির শব্দ, আর মৃত্যু-এই তিনটাই যেন তাদের জীবনের অঙ্গ।

গাজার শিশুরা কখনো যুদ্ধ, ক্ষুধা আর ঘুম হারানো রাতের অর্থ কী তা জানত না। কিন্তু বাস্তবতা তাদের জ্ঞানের বাইরে নয়; এই শিশুরা যুদ্ধের বীভৎস চিত্র দেখে বড় হচ্ছে, ধ্বংসের মাঝখানে বেড়ে উঠছে। তাদের কানের কাছে গর্জন করছে বোমার শব্দ, যা তাদের স্বপ্নের শূন্যতা তৈরি করে। ঘুম ভাঙে বিস্ফোরণের আওয়াজে, রাত কাটে আতঙ্ক আর ব্যথায়।

খেলার মাঠগুলো আজ মৃত্তিকার উপর পড়ে থাকা ধূলিমাখা জায়গায় পরিণত হয়েছে। শিশুরা আর খেলতে পারে না, তাদের মুখে নেই সেই নাসির হাসির ঝিলিক। স্কুলগুলো, যেখানে স্বপ্ন বোনা হত, এখন ধ্বংসস্তূপে পরিণত। পাঠশালার চার দেয়াল কেবল স্মৃতির সাক্ষী, যেখানে একদিন হাজারো শিশুর কোলাহল ভেসে বেড়াত। এখন সেখানে শুধু মাটির গন্ধ আর ধোঁয়ার রেখা।

প্রিয়জনদের মুখ হয়তো তারা শেষবারের মতো দেখেছে, হয়তো কখনোই আবার দেখা হবে না। বাবা-মা, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজনেরা যেন দূরের এক অবাস্তব ছায়ার মতো, যাদের নিরাপত্তা কিংবা সুরক্ষা দিতে পারছে না কেউ।

এই ছোট ছোট প্রাণগুলো আজ শুধুই চায় একটুখানি শান্তি। তারা চায় খেলনা না, মিষ্টি না-তারা চায় একটু নিরাপত্তা, একটু খাদ্য, একটু স্বাভাবিক জীবনের স্বাদ। যেখানে তারা নিঃশঙ্কে হাসতে পারে, যেখানে তারা নিরাপদে ঘুমোতে পারে, যেখানে তাদের শৈশব ফিরে আসতে পারে।

এই কিশোররা, যাদের চোখে আমরা ভবিষ্যত দেখতে চাই, তারা আজ শুধু অতীতের যন্ত্রণা আর বর্তমানের অনিশ্চয়তার দোসর হয়ে পড়েছে। তাদের চোখে ছায়া জমেছে ভয়, তাদের হৃদয়ে বসেছে ক্ষত।

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা, জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফসহ বহু সংস্থা এই মানবিক সংকটের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। তবে অনেক সময়ই দেখা যায় রাজনৈতিক এবং কূটনৈতিক জটিলতার মধ্যে শিশুদের চাওয়া-চাওয়া গুলো উপেক্ষিত থেকে যায়। গাজার এই শিশুদের জন্য প্রয়োজন কেবল আন্তর্জাতিক কূটনীতির নয়, বরং একটি আন্তরিক মানবিক সাড়া, যা তাদের নিরাপত্তা এবং মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করবে।

গাজা থেকে আসা প্রতিটি শিশুর চোখে আজ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দায়িত্ব আর কর্তব্য ঝলমল করছে। তারা আমাদের কাছে এক করুণ আর্তনাদ-“আমাদের জন্য কিছু করো।” আমরা যদি তাদের আহ্বান উপেক্ষা করি, তবে মানবতার প্রতি আমাদের দায়িত্ব থেকে আমরা একান্ত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বো।

শিশুরা যুদ্ধের বিরুদ্ধে নিষ্পাপ কবিতার মতো, শান্তির এক নির্জন স্বপ্ন। তাদের জন্য আমাদের সবার উচিত ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করা, যেন গাজার শিশুরা তাদের হারানো শৈশব ফিরে পায়, যেন তারা খেলতে পারে, হাসতে পারে, এবং এক নিরাপদ পৃথিবীতে বড় হতে পারে-যেখানে যুদ্ধের ভয় তাদের জীবন থেকে সম্পূর্ণ নির্মূল হয়।

ক্ষুধা আর বাসস্থানের সংকট

গাজার অবরোধ ও ধারাবাহিক সংঘর্ষের কারণে আজ এই উপত্যকায় নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের তীব্র সংকট বিরাজ করছে। বাজারগুলো পণ্যের অভাবে প্রায় শূন্য, এবং সেই সাথে খাদ্যের দাম অত্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে, যা গাজাবাসীর মধ্যেই এক নাভিশ্বাসের মতো বিরাজ করছে। ছোট্ট শিশুদের জন্য পুষ্টিকর খাবার পাওয়া আজ এক দুর্লভ স্বপ্নের মতো। অনেক শিশু দিনের পর দিন আধপেটা, অর্ধেক খাবার খেয়ে কাটিয়ে দিচ্ছে জীবন। তাদের ক্ষুধার্ত শরীরের জন্য দরকার নির্ভরযোগ্য ও সুষম আহার, কিন্তু বাস্তবে তারা পাচ্ছে শুধুই ক্ষুধার যন্ত্রণা আর দুর্বলতা।

শিশুরা দুর্বল হয়ে পড়ছে, তাদের স্বাভাবিক বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। পুষ্টিহীনতা থেকে তাদের রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাচ্ছে, আর সহজেই তারা শ্বাসকষ্ট, ডায়রিয়া, অজ্ঞান হওয়া এবং অন্যান্য মারাত্মক অসুস্থতায় আক্রান্ত হচ্ছে। স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা সংকটাপন্ন হওয়ায় অনেক সময় প্রয়োজনীয় ওষুধ ও চিকিৎসা তাদের নাগালের বাইরে।

খাবারের অভাব ছাড়াও গাজার শিশুরা নিরাপদ বাসস্থানের অভাবের সমস্যায় নিপতিত। অবরোধ ও যুদ্ধের কারণে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ, পরিষ্কার পানির সংকট গভীরতর এবং চিকিৎসাসেবা সীমিত। বোমার বিধ্বংসী আঘাতে উড়ে গেছে অসংখ্য ঘরবাড়ি, যা শিশুদের ঘুমানোর স্থান থেকে শুরু করে নিরাপদ আশ্রয় পর্যন্ত সবকিছুই কেড়ে নিয়েছে। অনেক শিশু আজ ঘরের গুঁড়ো ও ধ্বংসস্তূপের মধ্যে বসবাস করছে, যেখানে শীত-গরম বা ঝড়-আঁধারে তাদের সুরক্ষা নেই।

স্কুল, হাসপাতাল ও সাধারণ নাগরিক সুবিধাও বোমাবাজির শিকার। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংসস্তূপে পরিণত, যেখানে একসময় শিশুরা আনন্দে ভরে উঠত, আজ সেখানে শুধু নিস্তব্ধতা আর ধুলোর রাজত্ব। হাসপাতালগুলোও সম্পূর্ণ কার্যক্ষম নয়, চিকিৎসক ও নার্সদের অভাব এবং ওষুধের ঘাটতির কারণে বহু রোগীর জীবন ঝুঁকির মুখে।

এই দুর্ভাগ্যবান শিশুরা আজ ধ্বংসস্তূপের মধ্যেই খুঁজে বেড়াচ্ছে হারানো স্মৃতির অংশ: খেলনার ছোট টুকরো, নষ্ট হয়ে যাওয়া বইয়ের ছাপ, কিংবা নিখোঁজ হয়ে যাওয়া ভাইবোন কিংবা আত্মীয়-স্বজনদের সন্ধান। তাদের এই খুঁজাখুজি যেন এক করুণ যাত্রা, যা আমাদের মনকে ব্যথিত করে এবং মানবতার প্রতি প্রশ্ন তোলে।

গাজার ক্ষুধার্ত শিশুদের এই জীবনযাত্রা আমাদের সকলের বিবেকের জন্য এক কঠোর ডাক। এটি শুধু একটি রাজনৈতিক সংকট নয়; এটি এক গভীর মানবিক বিপর্যয় যা মানবাধিকারের মৌলিক স্তম্ভগুলোকে চ্যালেঞ্জ করে। তাদের জন্য প্রয়োজন সঠিক খাদ্য সরবরাহ, নিরাপদ আশ্রয় ও মৌলিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা, যাতে তারা নতুন করে জীবন গড়ার স্বপ্ন দেখতে পারে।

হত্যা ও আপনজন হারানোর বেদনা

গাজার শিশুরা এক অমানবিক বাস্তবতার সান্নিধ্যে বেড়ে উঠছে, যেখানে মৃত্যু তাদের জীবনের একটি নিত্যসংবাদ, আর ভালোবাসা যেন এক দুর্লভ বিলাসিতা। প্রতিদিনই তারা চোখের সামনে দেখতে পায় অজস্র আপনজনের মৃত্যু, যারা তাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হওয়া উচিত ছিল। বাবা যখন বন্দুকের গুলিতে অচেতন হয়ে মাটিতে পড়ে থাকেন, মায়ের কান্নার আর্তনাদ কানে বাজে যেন অন্তহীন ব্যথার সুর। ভাইবোনেরা, যারা ছিল তাদের সবচেয়ে বড় সঙ্গী, প্রিয় বন্ধু, অনেকেই তখনই কষ্টে নিঃশব্দ হয়ে যায়, ক্ষতবিক্ষত দেহে শুয়ে থাকে, যা শিশুদের মনের ওপর অমোঘ একটা ছায়া ফেলে।

এই দৃশ্যগুলো কেবল একবারের ঘটনা নয়, বরং প্রতিদিনের জীবনযাত্রার অংশ। শিশুরা যখন স্বপ্ন বুনতে চায়, তখন তারা দেখতে পায় প্রিয়জনের বিদায়, হয়তো কখনোই ফিরে আসার নয় এমন একটি বিদায়। এই মৃত্যু শুধু একটি শারীরিক ক্ষতি নয়, এটি তাদের ছোট্ট হৃদয়ে অমোঘ ক্ষত তৈরি করে, যা জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে পীড়ার স্মৃতি হয়ে উপস্থিত থাকে।

তাদের চোখে জমে ওঠে এক ধরনের শূন্যতা, যেখানে স্বাভাবিক শিশুসুলভ আনন্দ, হাসি কিংবা মিষ্টি সপন হারিয়ে যায়। তাদের মানসিকতা দৃষ্টিভঙ্গি বিকৃত হয়, যেখানে মৃত্যুকে তারা শিখতে বাধ্য হয়, ভালোবাসার ওপর থেকে বিশ্বাস উঠে যায়, আর তাদের মনের এক কোণে জন্ম নেয় এক দীর্ঘ, নীরব শোকের অন্ধকার।

এই শিশুরা বড় হচ্ছে এক এমন পৃথিবীতে যেখানে নিরাপত্তা নেই, যেখানে প্রিয়জনের মৃত্যুর দৃশ্য প্রত্যক্ষ করা তাদের জীবনের অংশ। তাদের জন্য ভালোবাসা আজ বিলাসিতার মতো, কারণ তাদের চারপাশে যারা বেঁচে আছেন তারা বেঁচে থাকার জন্য প্রতিদিনই যুদ্ধ করছে। তাদের ছোট্ট হৃদয় যেখানে আঘাত পেয়েছে, সেখানে আবার নতুন করে ভালোবাসার জন্ম দেওয়া কতটা কঠিন-এই প্রশ্ন পৃথিবীকে প্রশ্ন করে।

গাজার শিশুরা শুধু তাদের হারানো আপনজনদের জন্য শোকাহত নয়, তারা শোকের এই গভীরে পড়ে গিয়ে তাদের স্বপ্ন, আশা, এবং সম্ভাবনাও হারিয়ে ফেলছে। তারা বড় হচ্ছে এমন এক বাস্তবতায় যেখানে মৃত্যু আর ভালোবাসার মধ্যে এক প্রলয়াত্মক ফারাক থেকে গেছে।

এই বেদনার মাঝেও, তাদের ছোট্ট বুকের গভীরে থাকে একটুখানি আশার দীপ-একটা পৃথিবী যেখানে তারা আবার শান্তিতে বাঁচতে পারে, যেখানে তাদের শৈশব ফিরে পেতে পারে, এবং যেখানে তারা ভালোবাসার স্পর্শ পেতে পারে। সেই দিনের অপেক্ষায় তারা এখনো ধৈর্য ধরে দাঁড়িয়ে আছে, আমাদের মানবতার প্রতি একটি চূড়ান্ত আহ্বান নিয়ে-‘আমাদের বাঁচাও, আমাদের ভালোবাসো।’

শিশুরা তাকিয়ে আছে, কিন্তু কার দিকে?

গাজার শিশুরা নিরব হয়ে এক অনিশ্চিত দূরত্বের দিকে তাকিয়ে আছে-যেন তাদের নিঃশ্বাসে ভরা সেই গভীর যন্ত্রণার জবাব খুঁজে। কিন্তু প্রশ্ন ওঠে, তারা আসলে কার দিকে তাকিয়ে আছে? তাদের নিরীহ চোখ কি বিশ্ব মানবতার বিবেকের দিকে? জাতিসংঘের কাঁপানো শপথের দিকে? কিংবা মুসলিম বিশ্বের ঐক্যের প্রতিশ্রুতির দিকে? না কি আমাদের তোমার-আমার কাঁধের দিকে, যারা বেঁচে আছি এক স্বাভাবিক জীবনের স্বাদে?

এই ছোট্ট প্রাণগুলো তাদের চোখে নিয়ে এসেছে হাজারো প্রশ্ন। কেন কেউ তাদের কথা শোনে না? কেন এই পৃথিবীর শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলোর নিরাপদ সভা কক্ষগুলোতে তাদের আর্তনাদ পৌঁছায় না? কেন তাদের করুণ চিত্র আন্তর্জাতিক মিডিয়ার সংবাদের পরিধি থেকে বিলুপ্ত হয়ে যায়?

শিশুরা অবিরত চেয়ে থাকে, যেন কেউ তাদের শুনবে, কেউ তাদের বাঁচানোর জন্য এগিয়ে আসবে। কিন্তু পৃথিবীর বড় বড় মঞ্চগুলোতে, যেখানে শান্তি ও মানবাধিকার নিয়ে আলোচনা হয়, সেখানে তাদের অস্তিত্ব যেন এক অদৃশ্য দাগ। কেউ কি তাদের স্বপ্নের কথা ভাবছে? কেউ কি ভাবছে তাদের শৈশব ফিরিয়ে দিতে?

তাদের চোখে লেখা আছে এক গভীর একাকিত্ব, এক অনুনয়। “আমাদের জন্য কিছু করো,”-এই আহ্বান যেন কানে না আসে কেউ। তারা নির্দোষ, তারা নির্ভেজাল, তারা শুধু শান্তির স্বপ্ন দেখে। তাদের সেই দৃষ্টিতে কোনো ঘৃণা নেই, নেই কোনো বিদ্বেষ, কেবল এক আশার আলো, যা কেউ জ্বালাতে পারে, কিন্তু অনেকেই তার দিকে তাকায় না।

এরা তাকিয়ে আছে মানুষের অন্তরের দিকে, মানবতার বিচারকের দিকে, কিন্তু সেসব দরজা আজও তাদের জন্য বন্ধ। তারা অপেক্ষা করছে এক মানবিক যোদ্ধার জন্য, যে যুদ্ধের আগুন নেভাবে, যে শান্তির বাতাস বইয়ে আনবে, যে তাদের হারানো শিশুতা ফিরিয়ে দেবে।

এই নিরব আহ্বান আমাদের সকলের হৃদয়ে কম্পিত হওয়ার কথা। শিশুরা আজ আমাদের দৃষ্টির আকাঙ্ক্ষায়, আমাদের সাহায্যের অপেক্ষায়। তাদের চোখের প্রশ্ন শুধুই একটি-আমরা কি তাদের জন্য কিছু করব?

সমাধানের পথ ও আমাদের দায়িত্ব

গাজার ছোট্ট শিশুদের যন্ত্রণাময় জীবন যখন আমাদের হৃদয় স্পর্শ করে, তখন প্রশ্ন ওঠে-আমরা কি শুধু দেখেই বসে থাকবো, নাকি তাদের জন্য কিছু করতে এগিয়ে আসবো? তাদের শৈশব ফিরে পাওয়ার অধিকার রক্ষায় আমাদের সক্রিয় হওয়া একান্ত প্রয়োজন। আসুন দেখি, আমরা কী কী করে তাদের জীবনে পরিবর্তন আনতে পারি:

১. সচেতনতা ছড়ানো:

সর্বপ্রথম, এই কষ্টের কাহিনী বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দিতে হবে। মিডিয়া, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, ব্লগ, আর্টিকেল কিংবা আলোচনার মাধ্যমে গাজার শিশুদের বর্তমান বাস্তবতাকে তুলে ধরা অত্যন্ত জরুরি। যখন অধিক মানুষ এই বেদনার কাহিনী জানবে, তখনই বিশ্বমঞ্চে তাদের প্রতি মনোযোগ বাড়বে। তথ্যের আলোয় সত্যকে স্পষ্টভাবে তুলে ধরা এবং ভুল তথ্যের বিরুদ্ধে লড়াই করা আমাদের প্রথম দায়িত্ব।

২. মানবিক সহায়তা পাঠানো:

বিশ্বের যে কেউ, ব্যক্তি কিংবা প্রতিষ্ঠান, আন্তর্জাতিক মানবিক সংস্থাগুলোর মাধ্যমে গাজার শিশুদের জন্য খাদ্য, পরিষ্কার পানি, চিকিৎসা সেবা, শিক্ষা সামগ্রী ও নিরাপদ আশ্রয়ের ব্যবস্থা করতে পারে। এই সহায়তা তাদের জীবনে এক নূতন আশা এবং জীবন সংগ্রামে এক অনিবার্য অবদান রাখবে। ক্ষুধার্ত মুখগুলোতে হাসি ফিরিয়ে আনা, চিকিৎসার মাধ্যমে জীবন রক্ষা করা-এইসবই আমাদের সামান্য প্রয়াসের অংশ।

৩. রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টি:

শান্তি প্রতিষ্ঠায় কেবল সহায়তা যথেষ্ট নয়; প্রয়োজন কার্যকর রাজনৈতিক উদ্যোগ। আমাদের রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক নেতাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে হবে যাতে তারা গাজার অবরোধ ও সংঘর্ষ বন্ধে সক্রিয় ভূমিকা নেয়। নিরপরাধ মানুষের ওপর চলমান নিপীড়ন থামানোর জন্য আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ও শান্তি বজায় রাখার কাঠামোকে শক্তিশালী করা জরুরি। ভোটার, নাগরিক ও সামাজিক সংগঠন হিসেবে আমাদের এই দায়িত্ব যে কোনো রাজনৈতিক নেতার কাছে পৌঁছানো।

৪. দোয়া ও মনোযোগ:

সবশেষে, আমাদের অন্তরের গভীর থেকে এই শিশুদের জন্য দোয়া করা অপরিহার্য। আমাদের হৃদয় থেকে তাদের জন্য শান্তি, নিরাপত্তা ও সুখের প্রার্থনা করতে হবে। শুধু দোয়াই নয়, আমাদের মনোযোগ তাদের কষ্টের প্রতি থাকা এবং সেই কণ্ঠস্বরকে উচ্চারণ করার মাধ্যম হয়ে ওঠা জরুরি। বিশ্বকে তাদের কথা শোনাতে হবে, যেন তারা ভুলে না যায় এবং তারা জানুক, তারা একা নয়।

গাজার শিশুরা আমাদের সমষ্টিগত মানবিকতার প্রতিফলন। তাদের জন্য যদি আমরা সচেতন হই, সহায়তা করি, রাজনৈতিক ও সামাজিক ভাবে এগিয়ে আসি এবং হৃদয় দিয়ে তাদের পাশে দাঁড়াই, তবে তাদের হারানো শৈশব ফিরে পাওয়ার স্বপ্ন পূরণ হতে পারে। আমাদের আজকের কাজ তাদের জীবনে আলো বয়ে আনবে, আর আগামী প্রজন্মের জন্য এক শান্তিপূর্ণ পৃথিবীর ভিত্তি স্থাপন করবে।

এখানে আমাদের প্রত্যেকের অবদান একটির মতো হলেও মূল্যবান। গাজার শিশুদের জীবন বাঁচানো মানে মানবতার বিজয়।

শেষ কথা

গাজার শিশুরা আজ মানব সভ্যতার সেই অন্ধকার দর্পণ, যার সামনে দাঁড়িয়ে আমরা নিজেদের প্রকৃত অবস্থা দেখতে পাই-কতটা অসহায়, কতটা অবহেলিত এবং কতটা উদাসীন। এই নিষ্পাপ প্রাণেরা কিছু চায় না-তারা কোনো বিলাসিতা বা বেশি কিছু প্রত্যাশা করে না। তারা শুধু একটি মানবিক পৃথিবীর দাবি জানায়, যেখানে তারা নিরাপদে শ্বাস নিতে পারবে, যেখানে তাদের শৈশব হবে আনন্দে ভরা, গানের সুরে মধুর, খেলাধুলায় পরিপূর্ণ। তারা স্বপ্ন দেখার অধিকার চায়-স্বপ্ন, যা রক্তের নদী পেরিয়ে আলোয় ভরে উঠবে।

গাজার শিশুর দৃষ্টিতে আজ আমাদের মানবতা ঝলসে উঠছে। তাদের দিকে তাকানো মানে আমাদের নিজের বিবেকের দিকে তাকানো, আমাদের মানবিক গুণাবলীর অম্লান সত্যের মুখোমুখি হওয়া। এই দৃষ্টির মধ্যে নিহিত আছে এক চূড়ান্ত আহ্বান-“আমাদের বাঁচাও, আমাদের ভালোবাসো, আমাদের স্বপ্নের সাথে দাঁড়াও।”

এখনো সময় আছে। এখনো সুযোগ আছে আমাদের ভুল সংশোধনের, আমাদের নীরবতা ভাঙার। দাঁড়াও তাদের পাশে। অন্তত চুপ থেকো না। তাদের কষ্টকে বিশ্ববাসীর কাছে পৌঁছে দাও। তাদের আহ্বানকে সত্যিকারের আলোয় রূপান্তরিত করো। কারণ মানবতার মাপকাঠি এখন তাদের উপর নির্ভর করছে।

আমরা যদি আজ তাদের জন্য কিছু না করি, তাহলে আগামীকাল আমাদেরই কণ্ঠস্বর নীরব হয়ে যাবে। গাজার শিশুরা আমাদের সকলের কাছে মানবতার চূড়ান্ত পরীক্ষা। তাদের পাশে দাঁড়ানো মানে আমাদের নিজেদের অস্তিত্বের প্রতি দায়বদ্ধ থাকা, মানবতার প্রতি শ্রদ্ধা জানানো।

তাই, এগিয়ে যাও-তাদের জন্য, আমাদের জন্য, মানবতার জন্য।

Tags

আপনার কমেন্ট

You are replying to: .
captcha