হাওজা নিউজ এজেন্সি রিপোর্ট অনুযায়ী, ইতিহাসের পৃষ্ঠায় এমন কিছু অধ্যায় রয়েছে, যা শুধু রক্তে নয়, অশ্রু ও বেদনার অমোচনীয় চিহ্নে লেখা। ইমাম হাসান মুজতবা (আ.)-এর শাহাদত সেইসব বেদনাবিধুর ঘটনার অন্যতম, যা ইসলামের ইতিহাসে ন্যায় ও অন্যায়, মানবতা ও ক্ষমতার লোভের মধ্যে এক স্পষ্ট সীমারেখা টেনে দেয়। এই প্রবন্ধে আলোচিত হবে-মুয়াবিয়া ইবনে আবি সুফিয়ানের সেই প্রতিক্রিয়া, যিনি ইমাম হাসান (আ.)-এর শাহাদতের সংবাদ পেয়ে আনন্দ প্রকাশ করেছিলেন, এবং তার বিপরীতে মানবিক ও ঈমানি অবস্থান থেকে যারা শোক প্রকাশ করেছিলেন।
ইমাম হাসান (আ.)-সত্য ও শান্তির প্রতীক
ইমাম হাসান (আ.), রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর অতি প্রিয় নাতি এবং ইমাম আলী (আ.) ও ফাতিমা যাহরা (আ.)-এর সন্তান। তাঁর চরিত্রে ছিল শান্তি, ধৈর্য ও ন্যায়ের মূর্ত প্রতীক। ক্ষমতা বা রাজনীতি নয়, বরং সত্য ও ঐক্যের জন্য তিনি জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। তাই তাঁর শাহাদত শুধু একজন মানুষের মৃত্যু নয়, বরং ইসলামী ন্যায়বিচারের এক মহান ক্ষতি ছিল।
মুয়াবিয়ার প্রতিক্রিয়া-এক অমানবিক আনন্দ
ইতিহাসের বিশ্বস্ত গ্রন্থগুলো, যেমন ইবন আবদে রাব্বাহর “আল-আকদুল ফরিদ” (খণ্ড ৫, পৃষ্ঠা ১১০), উল্লেখ করেছে—
যখন ইমাম হাসান (আ.)-এর শাহাদতের খবর মুয়াবিয়ার কাছে পৌঁছায়, তখন সে আল্লাহর উদ্দেশ্যে সেজদায়ে পড়ে যায়। বাহ্যত সেটি ছিল “সেজদায়ে শুকর”, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা আল্লাহর জন্য নয়, বরং শয়তানের জন্য এক আনন্দ প্রকাশ।
এরপর সে ইবন আব্বাস (রা.)-এর কাছে লোক পাঠিয়ে বাহ্যিকভাবে শোক প্রকাশ করে, অথচ অন্তরে গভীর আনন্দ ধারণ করে। ইবন আব্বাসের সাথে তার কথাকাটাকাটি হয়েছিল, যা ইতিহাসবিদরা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন।
তাকবির ও আনন্দ-ফাখিতা বিনতে কুরতের প্রতিবাদ
যমাখশরী তাঁর “রবীউল আবরার” (খণ্ড ৫, পৃষ্ঠা ১৫৭)-এ লিখেছেন—
ইমাম হাসান (আ.)-এর শাহাদতের সংবাদ শোনার পর মুয়াবিয়া জোরে “আল্লাহু আকবার” বলে ওঠে, এবং শামের জনগণও তাকবির ধ্বনি তোলে। তখন মুয়াবিয়ার স্ত্রী ফাখিতা বিনতে কুরত বিস্ময়ে জিজ্ঞেস করেন: আল্লাহ তোমার চোখ উজ্জ্বল করুক, হে আমিরুল মুমিনিন, কিন্তু তুমি কোন আনন্দের জন্য তাকবির বলছ?
মুয়াবিয়া উত্তর দেয়: ইমাম হাসান ইবনে ফাতিমা (আ.)-এর মৃত্যুর খবর পেয়েছি।
এ উত্তরে ফাখিতা ক্ষুব্ধ হয়ে বলেন: তুমি কি ফাতিমার (আ.) পুত্রের শাহাদতে তাকবির বলছ?
মুয়াবিয়া তখন স্বীকার করে বলে: না, আমি কষ্ট দিতে চাইনি, বরং আমার হৃদয় শান্তি পেয়েছে; কারণ এখন খিলাফতের পথে আর কোনো বাধা রইল না।
এই সংলাপ ইতিহাসে এক ভয়াবহ সত্যকে উন্মোচন করে-মুয়াবিয়ার রাজনীতি ও তার হৃদয়ের প্রকৃত অবস্থান।
ঐতিহাসিক সাক্ষ্য
ইবন খাল্লিকান তাঁর “ওফায়াতুল আয়ান” (খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ৬৬)-এও এই ঘটনাটি লিপিবদ্ধ করেছেন। তিনি লিখেছেন যে, ফাখিতা, মুয়াবিয়ার স্ত্রী, তাঁর স্বামীর এই আনন্দ প্রকাশে প্রতিবাদ করেছিলেন।
আল-কালকাশান্দি, আহমদ, এবং অন্যান্য বহু ঐতিহাসিকও একই ঘটনার উল্লেখ করেছেন-যে মুয়াবিয়া এবং শামের জনগণ ইমাম হাসান (আ.)-এর শাহাদতের সংবাদে আনন্দ প্রকাশ করেছিল। এটি ছিল এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত, যখন রাজনীতি ও মানবতার দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে এসে পড়ে।
শোকের প্রতিধ্বনি-সত্যিকার মুমিনদের হৃদয়ে
অন্যদিকে, আল্লাহ ও রাসূলের প্রকৃত অনুসারীরা এই সংবাদে গভীর শোক প্রকাশ করেন। মদিনা, কুফা, এমনকি ইসলামী বিশ্বের বহু স্থানে মানুষ কেঁদে ওঠে। তাঁরা বুঝতে পারেন-এটি শুধু এক মহান ব্যক্তিত্বের মৃত্যু নয়, বরং ন্যায়, ধৈর্য ও ঈমানের পতাকা-বাহকের শাহাদত।
শেষ কথা:
ইমাম হাসান (আ.)-এর শাহাদতের ঘটনায় মুয়াবিয়ার আনন্দ ও তাকবির ছিল ইতিহাসের এক নৈতিক কালো দাগ, যা আজও অন্যায় রাজনীতির প্রতীক হিসেবে স্মরণ করা হয়।
অন্যদিকে, ফাখিতা বিনতে কুরতের মতো সাহসী নারী, যিনি নিজের স্বামীর মুখোমুখি হয়ে সত্যের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন, তিনি ইতিহাসে এক উজ্জ্বল উদাহরণ হয়ে রইলেন।
ইমাম হাসান (আ.)-এর জীবন ও শাহাদত আমাদের শেখায়-ন্যায়ের পথে স্থির থাকা মানেই জীবন উৎসর্গের জন্য প্রস্তুত থাকা। আর মুয়াবিয়ার প্রতিক্রিয়া আমাদের মনে করিয়ে দেয়-ক্ষমতার লোভ মানুষকে কখনো কখনো মানবতা ও ঈমান থেকে বিচ্যুত করে দেয়।
আজও ইতিহাসের এই ঘটনা আমাদের শিক্ষা দেয়-যে আনন্দ অন্যায়ের মৃত্যুতে নয়, বরং অন্যায়ের পতনে হওয়া উচিত। কারণ সত্য, ধৈর্য ও ন্যায়বিচারের পথে যারা চলে, তাদের নামই চিরকাল অমর থাকে।
রিপোর্ট: হাসান রেজা
আপনার কমেন্ট