হাওজা নিউজ এজেন্সি রিপোর্ট অনুযায়ী, ইসলামী ইতিহাসে ওহুদের যুদ্ধ একটি স্মরণীয় অধ্যায়। এই যুদ্ধে মুসলমানদের জন্য ছিল কঠিন পরীক্ষা ও ত্যাগের অনন্য দৃষ্টান্ত। অনেক সাহাবি প্রথমে দৃঢ়ভাবে যুদ্ধ করলেও পরবর্তী সময়ে বিভ্রান্তি ও গুজবের কারণে কেউ কেউ যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করে পাহাড়ের দিকে পালিয়ে গিয়েছিলেন। অথচ সেই ভয়াবহ মুহূর্তে, যখন নবী করিম (সা.) এর জীবন বিপদের মুখে, তখন এক নারী অকুতোভয় বীরের মতো সামনে এগিয়ে এসেছিলেন। তিনি ছিলেন নাসিবা বিনতে কা’ব (উম্মে আম্মারা)।
ইবনে কাসির দামিশকি তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া (খণ্ড ৪, পৃষ্ঠা ৩৮), সিরাতে ইবনে হিশাম (খণ্ড ৩, পৃষ্ঠা ৫৯৯), এবং সুবুলুল-হুদা ওয়াল রাশাদ (খণ্ড ৪, পৃষ্ঠা ২০২)-এ এই ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন। বর্ণিত আছে যে, উম্মে আম্মারা মূলত যুদ্ধক্ষেত্রে এসেছিলেন আহত সাহাবিদের সেবা ও চিকিৎসার জন্য। তাঁর হাতে ছিল ব্যান্ডেজ, পানি ও চিকিৎসাসামগ্রী। কিন্তু যখন তিনি দেখলেন যে মুশরিকদের আক্রমণে নবী করিম (সা.) সরাসরি বিপদের মুখে, তখন তিনি বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে নিজের চিকিৎসা সরঞ্জাম ফেলে অস্ত্র তুলে নেন এবং শত্রুদের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়েন।
ইবনে কাসির এই ঘটনাকে “অত্যন্ত বিস্ময়কর” বলে আখ্যায়িত করেছেন। কেননা, সেই সময় অনেক পুরুষ সাহাবি পাহাড়ের দিকে ছুটে পালাচ্ছিলেন, অথচ এই নারী নিজের প্রভুর রাসুল (সা.)-কে রক্ষার জন্য মৃত্যুকে উপেক্ষা করে যুদ্ধের কেন্দ্রে প্রবেশ করেছিলেন।
সুবুলুল-হুদা ওয়াল রাশাদ (খণ্ড ৪, পৃষ্ঠা ২০১)-এ বর্ণিত আছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) সেই সময় বলেছিলেন, “আজ নাসিবা বিনতে কা’বের অবস্থান অমুক ও অমুক (যারা পালিয়েছিল) ব্যক্তিদের অবস্থানের চেয়ে শ্রেষ্ঠ।”
এই বাণীতে নবী করিম (সা.) স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, ঈমান ও সাহসের মানদণ্ড নারী-পুরুষে নির্ভর করে না; বরং নির্ভর করে কর্ম, ত্যাগ ও আল্লাহর প্রতি দৃঢ় বিশ্বাসের ওপর।
যুদ্ধের এক পর্যায়ে নাসিবার ছেলে আবদুল্লাহ ইবন যায়েদ-ও লড়াই করছিলেন। তিনি আহত হলে নবী করিম (সা.) নিজে তাঁর ক্ষত ব্যান্ডেজ করতে বলেন। তখন নবী (সা.) পুনরায় নাসিবার প্রতি দোয়া করে বলেন, “তোমার মায়ের অবস্থান অমুক ও অমুকের চেয়ে শ্রেষ্ঠ।”
পরবর্তী মুহূর্তে এক মুশরিক এসে আবদুল্লাহর হাত কেটে ফেলে। সেই দৃশ্য দেখে নাসিবা তলোয়ার হাতে নিয়ে শত্রুকে আঘাত করে দুই টুকরো করে ফেলেন। তিনি নিজের ক্ষত-বিক্ষত দেহের ব্যথা ভুলে নবী করিম (সা.)-এর সুরক্ষা অব্যাহত রাখেন।
ইতিহাসে বর্ণিত আছে, তাঁর শরীরের বারোটি স্থানে আঘাত লাগে, তবুও তিনি যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করেননি।
এই ঘটনাটি শুধু ইসলামী ইতিহাসে নয়, মানবতার ইতিহাসেও এক বিরল উদাহরণ। উম্মে আম্মারার সাহস, ত্যাগ, ও ঈমানের দৃঢ়তা প্রমাণ করে যে, নারীও আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (সা.)-এর পথে এমন বীরত্ব দেখাতে পারেন যা অনেক পুরুষকেও লজ্জিত করে।
ওহুদের যুদ্ধের সেই দুঃসময়ে উম্মে আম্মারা ছিলেন ঈমানের জীবন্ত প্রতীক—
এক নারী, যিনি নিজের জীবন বাজি রেখে রাসুল (সা.)-কে রক্ষা করেছিলেন,
যিনি প্রমাণ করেছিলেন যে প্রকৃত সাহস লিঙ্গে নয়, অন্তরের ঈমানে নিহিত।
উপসংহার:
উম্মে আম্মারা-এর এই ঘটনা আমাদের শেখায় যে, ইসলাম নারীদের দুর্বল নয় বরং মর্যাদাবান, সাহসী ও আত্মত্যাগী করে তোলে। যারা ওহুদের যুদ্ধ থেকে পলায়ন করেছিলেন, তাদের তুলনায় এই নারীর অবস্থান শুধু শ্রেষ্ঠ নয়, বরং ইতিহাসে অমর হয়ে আছে। তাঁর সাহস ও ত্যাগ চিরকাল মুসলিম নারী-পুরুষের জন্য প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।
রিপোর্ট: হাসান রেজা
আপনার কমেন্ট