হাওজা নিউজ এজেন্সি: হুজ্জাতুল ইসলাম মানদেগারি তাঁর বক্তব্যে বলেন, যেমনটি পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে— «الَّذِينَ إِن مَكَّنّاهُمْ فِي الأَرْضِ أَقَامُوا الصَّلاةَ» — “যাদের আমরা পৃথিবীতে ক্ষমতা দিই, তারা নামাজ কায়েম করে।”
তিনি ব্যাখ্যা করেন, নামাজই ইসলামি ব্যবস্থার সর্বশ্রেষ্ঠ দায়িত্ব ও ফরজ ইবাদত এবং এটি ধর্মীয় তাঁবুর মূল স্তম্ভস্বরূপ।
তিনি আরও বলেন, প্রতি বছর দেশের বিভিন্ন প্রদেশে নামাজ প্রতিষ্ঠা বিষয়ক জাতীয় সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। তাই উপযুক্ত হবে যদি আহলে বাইত (আ.)-এর এই বরকতময় হারামে প্রতিবছর নামাজ বিষয়ক একটি বিশেষ সভা বা অধিবেশন আয়োজন করা হয়, যাতে এই মহান ফরজ ইবাদত—যা সমাজের নৈতিকতা, আত্মিক বিকাশ ও মানসিক স্বাস্থ্যের মূলভিত্তি—আরও অধিক মনোযোগ ও গুরুত্ব লাভ করে।
মাজার শরীফের খতিব হুজ্জাতুল ইসলাম মানদেগারি আমিরুল মুমিনিন ইমাম আলী (আ.)-এর বাণীর প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন, “নিজেদের জীবনকে নামাজে রূপান্তর করো।”
তিনি বলেন, নামাজ কেবল একটি আনুষ্ঠানিক ইবাদত নয়; এটি একটি পূর্ণাঙ্গ মানবিক, নৈতিক ও আধ্যাত্মিক শিক্ষাব্যবস্থা, যা মানুষকে সামগ্রিকভাবে গড়ে তোলে। আমরা যদি নামাজকে গভীরভাবে বুঝতে পারি, তবে আমাদের ধর্ম, দুনিয়া ও আখিরাত—সবই সঠিকভাবে পরিচালিত হবে।
হুজ্জাতুল ইসলাম মানদেগারি নামাজের প্রথম শিক্ষামূলক নীতি হিসেবে পবিত্রতা (তাহারাত)-এর ওপর জোর দেন এবং বলেন, “পবিত্রতা ছাড়া কোনো নামাজ কবুল হয় না। আল্লাহ তাআলা পবিত্রতার উপকরণ হিসেবে পানি ও মাটিকে নির্ধারণ করেছেন, যা ওজু, গোসল ও তায়াম্মুমে ব্যবহৃত হয়। তবে এর গভীরতর অর্থ এই যে, আমাদের জীবনও যেন অপবিত্রতা থেকে মুক্ত থাকে। আমরা যা দেখি, যা শুনি, যা খাই, যা বলি—সবকিছুতেই পবিত্রতা থাকা জরুরি।”
তিনি সূরা নূরের আয়াতের প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন,
“আল্লাহ নবী করিম (সা.)-কে নির্দেশ দিয়েছেন যেন তিনি মুমিনদের বলেন, তারা যেন হারাম দৃষ্টিপাত থেকে নিজেদের দৃষ্টি সংযত রাখে; কারণ অপবিত্র দৃষ্টি হৃদয়কে অসুস্থ করে দেয়। যেমন অপবিত্র খাদ্য দেহে শারীরিক প্রভাব ফেলে, তেমনি হারাম দৃশ্য দেখা বা নিষিদ্ধ বিষয় শোনা আত্মায় গভীর প্রভাব ফেলে এবং কখনও কখনও মানুষকে বছরের পর বছর আল্লাহর ইবাদত থেকে দূরে সরিয়ে রাখে।”
তিনি জোর দিয়ে বলেন, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে পবিত্রতার নীতি বজায় রাখা অপরিহার্য। বন্ধুত্ব, অতিথি আপ্যায়ন, লেনদেন ও সামাজিক সম্পর্ক—সবক্ষেত্রেই পবিত্রতা রক্ষা করতে হবে। “কারণ, একটি অপবিত্র বন্ধুত্ব বা দূষিত সম্পর্ক মানুষকে আল্লাহর স্মরণ ও নামাজ থেকে বিচ্যুত করতে পারে। ধন্য তারা, যারা শহীদের মতো পবিত্র মৃত্যুবরণ করেছেন।”
বক্তা নামাজের দ্বিতীয় শিক্ষামূলক নীতি হিসেবে খালেস নিয়ত বা একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে ইবাদত করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
তিনি বলেন, “নামাজ হতে হবে قُربَةً إلی الله — শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি ও নৈকট্যের উদ্দেশ্যে, রিয়া, খ্যাতি বা পার্থিব স্বার্থের জন্য নয়। যদি নামাজ মানুষের সন্তুষ্টি বা বাহ্যিক প্রশংসার জন্য হয়, তবে সেটি নামাজ নয়।”
তিনি নিজের শিক্ষক আয়াতুল্লাহ কাজেম হায়েরির একটি স্মৃতিচারণা করে বলেন, “আয়াতুল্লাহ হায়েরি প্রায়ই বলতেন, শুধুমাত্র আল্লাহর জন্য দুই রাকাত খাঁটি নামাজ আদায় করা অত্যন্ত কঠিন একটি কাজ। বহু আলেম ও আরিফগণ বলেছেন—যদি কেউ জীবনে অন্তত দুই রাকাত খালেস নামাজ পড়ে, সে জান্নাতের অধিকারী হয়ে যায়।”
হুজ্জাতুল ইসলাম মানদেগারি আরও বলেন, “নামাজ আমাদের শেখায়, আমাদের প্রতিটি কাজই যেন আল্লাহর জন্য হয়—কথা বলা, নীরব থাকা, কাজ করা, শিক্ষা গ্রহণ, উপহার দেওয়া, এমনকি ভোট দেওয়া পর্যন্ত। যখন নিয়তগুলো আল্লাহমুখী হয়ে যায়, তখন সমাজ একটি নামাজপড়ুয়া, তাকওয়াপূর্ণ ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজে পরিণত হয়।”
তিনি নামাজের তৃতীয় শিক্ষামূলক নীতি হিসেবে কিবলামুখিতা-র কথা বলেন এবং ব্যাখ্যা করেন, “নামাজ শেখায় যে, জীবনের সকল দিক ও কর্মকাণ্ড যেন কিবলার দিকে—অর্থাৎ আল্লাহর দিকে—নির্দেশিত থাকে। আমাদের প্রতিটি কাজ ও সিদ্ধান্ত এমন হওয়া উচিত, যা মানুষকে আল্লাহর নিকটবর্তী করে, দূরে নয়। বিয়ে, কাজ, সন্তান জন্মদান কিংবা বিনোদন—যদি তা মানুষকে আল্লাহর স্মরণে উদ্বুদ্ধ করে, তবে সেটিই আল্লাহমুখী ও ইবাদতমূলক কাজ।”
তিনি বলেন, “যখন আমরা দেখি প্রতিরোধের ময়দানে ইসলামি প্রতিরোধ ফ্রন্ট বা মুকাওয়ামা শত্রুদের বিরুদ্ধে বিজয় অর্জন করছে, তখন আমাদের মুখ থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে উচ্চারিত হওয়া উচিত ‘আল্লাহু আকবার’। এও এক ধরণের নামাজ—একটি ‘আচরণগত নামাজ’, যা আমাদের কর্মে, নীতিতে ও অবস্থানে প্রকাশ পায়।”
এরপর তিনি চতুর্থ নীতি হিসেবে আদব রক্ষা-র কথা উল্লেখ করেন। “যেহেতু নামাজের আদব ও শিষ্টাচার আছে, তাই জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেও আদব থাকা উচিত—খাওয়া, পরা, বিবাহ, অতিথি আপ্যায়ন—সবক্ষেত্রেই।
আল্লাহ তাআলা কোরআনে বলেছেন: فَسْئَلُوا أَهْلَ الذِّكْرِ إِن كُنتُمْ لا تَعْلَمُونَ — ‘তোমরা যদি না জানো, তবে জ্ঞানীদের জিজ্ঞেস করো’। অর্থাৎ জীবনের প্রতিটি বিষয়ে সঠিক পদ্ধতি, আদব ও আচরণ জানতে হবে আহলে ইলম ও আলেমদের কাছ থেকে।”
সবশেষে হুজ্জাতুল ইসলাম মানদেগারি নামাজের পঞ্চম শিক্ষামূলক নীতি হিসেবে বলেন, “সর্বোত্তম নামাজ সেই নামাজ, যার ইমাম আছে।”
তিনি কোরআনের আয়াত উদ্ধৃত করেন, یَوْمَ نَدْعُوا كُلَّ أُنَاسٍ بِإِمَامِهِمْ — “যেদিন আমরা প্রত্যেক সম্প্রদায়কে তাদের ইমামের নামে আহ্বান করব।”
তিনি ব্যাখ্যা করেন, “যেমন নামাজ ইমাম ছাড়া পূর্ণতা পায় না, তেমনি জীবনও একটি ইমাম বা নেতৃত্ব ছাড়া পরিপূর্ণ হতে পারে না। জীবনেরও একটি কেন্দ্র, দিকনির্দেশনা ও অনুসরণযোগ্য নেতৃত্ব থাকা জরুরি। যখন জীবনের ইমাম আল্লাহনির্দেশিত হয়, তখন নামাজ যেমন কবুল হয়, জীবনও তেমনি আল্লাহমুখী ও অর্থবহ হয়ে ওঠে।”
আপনার কমেন্ট