রবিবার ১২ অক্টোবর ২০২৫ - ১৯:০৩
মৃত্যু, ভাগ্য ও শহীদত্ব: এক গভীর বাস্তবতা

ইসলামী দৃষ্টিতে, মৃত্যু হলো আল্লাহ্‌র নির্ধারিত এক অবধারিত সত্য—যা সময় ও স্থানের সীমারেখা ছাড়িয়ে নির্ধারিত মুহূর্তেই ঘটে।

হাওজা নিউজ এজেন্সি রিপোর্ট অনুযায়ী, মানুষের মৃত্যু কোনো একক কারণে ঘটে না; বরং এটি বহু উপাদানের সমন্বিত ফল। ইসলামী দৃষ্টিতে, মৃত্যু হলো আল্লাহ্‌র নির্ধারিত এক অবধারিত সত্য—যা সময় ও স্থানের সীমারেখা ছাড়িয়ে নির্ধারিত মুহূর্তেই ঘটে। তবে এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকে মানুষের নিজস্ব কর্ম, নৈতিক অবস্থান, অন্যদের প্রতি আচরণ, এমনকি সমাজে তার ভূমিকা পর্যন্ত।

অনেক সময় আমরা নিজেরাই এমন কিছু কাজ করি—অন্যের ওপর জুলুম চালাই, অধিকারহীন করি, বা যাদের আমাদের প্রতি অধিকার আছে (ذوی الحقوق), তাদের প্রতি অবিচার করি—যার ফলস্বরূপ, আমাদের জীবনে বিপর্যয় নেমে আসে। কখনও অন্যের হিংসা, বিদ্বেষ বা অভিশাপও আমাদের মৃত্যুকে ত্বরান্বিত করতে পারে, যদি আমরা নিজেদের আল্লাহর নিরাপত্তার ছায়ার মধ্যে না রাখি। অর্থাৎ, মানুষের মৃত্যু আল্লাহর ইচ্ছাধীন হলেও, আমাদের কর্মও সেই ব্যবস্থার এক অংশ।

তবে এ বাস্তবতা অত্যন্ত জটিল; তাই কোনোভাবেই নিশ্চিতভাবে বলা যায় না যে, কারও যুদ্ধক্ষেত্রে মৃত্যু “আগেভাগে” ঘটে গেছে, বা সে নিজেই মৃত্যুকে আহ্বান করেছে। এই ভুল ধারণাই শহীদত্বের মর্যাদাকে বিকৃত করে দেয়।

অনেকে বলে, “যদি সে যুদ্ধে না যেত, তাহলে আজও বেঁচে থাকত।”
“যদি শত্রুর সঙ্গে আপস করত, তাহলে প্রাণ হারাতে হতো না।”

এই ধরনের বক্তব্য সম্পূর্ণ অর্থহীন ও অজ্ঞতাপূর্ণ। কারণ, মানুষের মৃত্যু আল্লাহই নির্ধারণ করেন। যুদ্ধ হোক বা শান্তি, নিরাপত্তা হোক বা বিপদ-মৃত্যু নির্ধারিত সময়েই আসবে।

হযরত আলী (আ.) তাঁর পুত্রকে উপদেশ দিয়েছিলেন-“তোমার মাথা (জীবন) আল্লাহর হাতে সমর্পণ করো; মাথা রক্ষা করা তাঁর দায়িত্ব। তুমি তোমার যুদ্ধ করো, তোমার দায়িত্ব পালন করো।”

অর্থাৎ, আমাদের জীবন আল্লাহর হাতে সঁপে দেওয়া মানে দায়িত্বহীন হয়ে যাওয়া নয়। বরং এর মানে হলো-আমরা আল্লাহর ওপর ভরসা রেখে আমাদের দায়িত্ব পালন করব। নিজের জীবন রক্ষার দায়িত্ব, শত্রুর মোকাবিলার দায়িত্ব, ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়ানোর দায়িত্ব-সবই আমাদের উপর অর্পিত। একইসঙ্গে, আমরা শহীদত্ব কামনা করতে পারি, কারণ তা হলো আত্মত্যাগ ও ঈমানের সর্বোচ্চ প্রকাশ।

এই দায়িত্বগুলো পালন করা কোনোভাবেই ‘অকালমৃত্যু’ ডেকে আনে না। বরং, এগুলোই মানুষকে মৃত্যুর পরেও অমর করে তোলে। যারা মনে করে শহীদরা “অকারণে প্রাণ হারায়”, তারা আসলে মৃত্যুর অর্থই বুঝতে পারেনি।

ইতিহাসে এই ভুল ধারণা নতুন নয়। নবী করিম (সা.)-এর যুগেও কিছু মুনাফিকরা বলত, “অমুক যদি যুদ্ধে না যেত, এখনো আমাদের সঙ্গে বসে থাকত।”

তাদের উদ্দেশে ইমাম আলী (আ.) এক গভীর সত্য উচ্চারণ করেছিলেন,  “যদি তুমি আল্লাহর পথে নিহত না হও, তবুও তোমাকে মরতেই হবে।”

অর্থাৎ মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী; সেটা যুদ্ধক্ষেত্রে হোক বা বিছানায়। পার্থক্য শুধু একটিই-একজন মৃত্যুবরণ করে সাধারণ মানুষ হিসেবে, আরেকজন মৃত্যুবরণ করে শহীদ হিসেবে, যিনি চিরকাল বেঁচে থাকেন সম্মান ও ইতিহাসে।

সুতরাং যারা শহীদদের ত্যাগকে “অকারণ প্রাণদান” বলে অবমূল্যায়ন করে, তারা কেবল মৃত্যুর দর্শন নয়, ঈমানের গভীরতাও অনুধাবন করতে ব্যর্থ।

যেমন বিপ্লবী নেতা সুন্দরভাবে বলেছেন,  “এটা যেন সেই তেলের মতো, যা আগে থেকেই পড়েছিল-পরে কেউ এসে বলল, মানত করেছি, আসলে ওটা ছিল চালাকি।”

অর্থাৎ, মৃত্যু আগেই নির্ধারিত ছিল; যুদ্ধ কেবল সেই নির্ধারিত পথে তাকে পৌঁছে দিয়েছে।

মানুষের মৃত্যু আল্লাহর হাতে, কিন্তু মানুষের মর্যাদা নির্ধারিত হয় তার কর্মে। যারা আল্লাহর পথে নিজেদের উৎসর্গ করে, তারা মৃত্যুকে ভয় করে না-বরং মৃত্যুকে অমরত্বের সোপানে রূপান্তরিত করে। শহীদত্ব তাই মৃত্যু নয়, বরং জীবনের সর্বোচ্চ সত্যে পৌঁছানোর নাম।

রিপোর্ট: হাসান রেজা 

আপনার কমেন্ট

You are replying to: .
captcha