সোমবার ১৩ অক্টোবর ২০২৫ - ০৯:২৪
পরিবার ও সমাজের অধিকাংশ বিরোধের মূল কারণ হলো ‘অন্তরের অপবিত্রতা’ ও ‘শয়তানের কুমন্ত্রণা’

হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমিন নাসের রফিয়ি বলেছেন— শয়তানের কুমন্ত্রণা পরিবার ও সমাজে দ্বন্দ্ব ও মতবিরোধের অন্যতম প্রধান কারণ। আমরা মানুষ; তাই মতপার্থক্য স্বাভাবিক। কিন্তু এই মতপার্থক্য যেন সম্পর্কছেদের কারণ না হয়।

হাওজা নিউজ এজেন্সি: হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমিন নাসের রফিয়ি টেলিভিশন অনুষ্ঠান “সামতে খোদা”-তে ইমাম সাজ্জাদ (আ.)-এর দোয়াগুলোর প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন, ইমাম সাজ্জাদ (আ.) আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেন যাতে তিনি তাদের তাওফিক দান করেন যে, যারা একে অপরের সঙ্গে বিরোধে আছে, তাদের মধ্যে পুনর্মিলন ঘটাতে পারেন এবং সমাজে সম্পর্ক ও ঐক্য পুনরুদ্ধার করতে পারেন।

তিনি বলেন, বর্তমান সমাজে বিভক্তি ও মতবিরোধ একটি সাধারণ ও উদ্বেগজনক বাস্তবতা। মানুষের বিভিন্ন প্রশ্ন ও সমস্যার মাধ্যমে আমি লক্ষ্য করি— অনেক ভাই একে অপরের সঙ্গে বিরোধে আছেন, পিতা-পুত্রের মধ্যে দূরত্ব রয়েছে, এমনকি ঘনিষ্ঠ আত্মীয় যেমন চাচাতো ভাই, মামাতো ভাই, ফুফু ও খালার মধ্যেও সম্পর্ক শীতল বা ছিন্ন হয়ে গেছে। অনেক ক্ষেত্রে সামান্য বিষয়ে শুরু হওয়া এই মতবিরোধ সম্পর্ক ভাঙনের পর্যায়ে পৌঁছে যায়।

হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমিন রফিয়ি দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, আমি সত্যিই কষ্ট পাই যখন দেখি, ছোটবেলায় যে শিশুরা একে অপরকে ভালোবাসত, একসঙ্গে খেলত, একটু মনোমালিন্য হলে মুহূর্তেই মিলমিশ করত— বড় হওয়ার পর, বিবাহ ও সন্তান হওয়ার পর, সেই বন্ধুত্ব ও আন্তরিক স্নেহ হারিয়ে যায়। মাসের পর মাস একে অপরের দেখা হয় না, আর দেখা হলেও থাকে অভিযোগ, বাড়তি প্রত্যাশা বা অজুহাত।

তিনি আরও বলেন, এ সমস্যা কেবল পারিবারিক নয়— বন্ধু ও সহকর্মীদের মধ্যেও দেখা যায়। অধিকাংশ মতবিরোধ খুব সামান্য ও সহজে সমাধানযোগ্য বিষয়ে। আমরা মানুষ, তাই মতভেদ স্বাভাবিক; কিন্তু তা যেন সম্পর্কছেদের কারণ না হয়। এমনকি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সাহাবিদের মধ্যেও কখনও মতবিরোধ হতো, কিন্তু তাঁরা তা সমাধান করতেন।

হুজ্জাতুল ইসলাম রাফিয়ি বলেন, কুরআন ও হাদীস উভয়ই বিভক্তি ও বিচ্ছেদ থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিয়েছে। ইসলামে বহুবার বলা হয়েছে— وَاعْتَصِمُوا بِحَبْلِ اللَّهِ جَمِيعًا وَلَا تَفَرَّقُوا
“তোমরা ঐক্যবদ্ধ থাকো, পরস্পর বিচ্ছিন্ন হইও না।” [সূরা আল-হুজুরাত ৪] কুরআনের বহু আয়াতে এ কথা পুনরাবৃত্ত হয়েছে।

এখন প্রশ্ন হলো— এই মতবিরোধের মূল কারণ কোথায়?

ইমাম আলী (আ.) বলেছেন, «إِنَّمَا أَنْتُمْ إِخْوَانٌ عَلَی دِینِ اللَّهِ، مَا فَرَّقَ بَیْنَکُمْ إِلَّا خُبْثُ السَّرَائِر» — “তোমরা সবাই আল্লাহর ধর্মে ভাই ভাই; তোমাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির একমাত্র কারণ হলো অন্তরের অপবিত্রতা।”

তিনি ব্যাখ্যা করেন, এই অন্তরের অপবিত্রতাই এমন এক মানসিক অবস্থা তৈরি করে, যেখানে কেউ কেউ বিরোধ সৃষ্টি করে আনন্দ পায় এবং অন্যদের বিচ্ছিন্ন দেখে তৃপ্তি অনুভব করে।

আরেকটি বড় কারণ হলো— শয়তানের কুমন্ত্রণা। সন্দেহ নেই, যেখানে বিভেদ আছে, সেখানে শয়তানের প্রভাব রয়েছে।

আল্লাহ তাআলা সূরা মায়িদার ৯১ নম্বর আয়াতে বলেছেন:
إِنَّمَا یُرِیدُ الشَّیْطَانُ أَنْ یُوقِعَ بَیْنَکُمُ الْعَدَاوَةَ وَالْبَغْضَاءَ فِی الْخَمْرِ وَالْمَیْسِرِ — “শয়তান চায়, মদ ও জুয়ার মাধ্যমে তোমাদের মধ্যে শত্রুতা ও ঘৃণা সৃষ্টি করতে।”

হুজ্জাতুল রাফিয়ি আরও বলেন, আল্লাহ যা হালাল করেছেন, তা পবিত্র; আর যা হারাম করেছেন, তা অপবিত্র। এতে কোনো সন্দেহ নেই। সুদ (রিবা) হলো অপবিত্র বিষয়ের একটি উদাহরণ। তাহলে মানুষ কেন এমন কিছুর পেছনে যাবে যা আল্লাহ অপবিত্র ঘোষণা করেছেন, এমনকি অন্যরা তা করলেও?

তিনি আরও উল্লেখ করেন যে, ভণ্ডামি বা কপটতা (নিফাক), অবিচার, অহংকার, হিংসা ও বিদ্বেষও বিরোধের মূল কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম। এমনকি হাসি-ঠাট্টা বা রসিকতাও যদি সীমা অতিক্রম করে, তা কষ্ট ও বিরূপতার জন্ম দিতে পারে। অনুপযুক্ত রসিকতা মানুষের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করতে পারে, সম্পর্ক ভেঙে দিতে পারে এবং শত্রুতা সৃষ্টি করতে পারে।

তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) রসিকতা করতেন, কিন্তু কখনো কারও মনোবেদনা সৃষ্টি করতেন না।

শেষে হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমিন রাফিয়ি বলেন, মতভেদ একটি স্বাভাবিক বিষয়, কিন্তু প্রকৃত মুমিন সেই ব্যক্তি, যিনি এই মতভেদ দূর করতে উদ্যোগী হন; জেদ, অভিমান বা বিদ্বেষের মাধ্যমে তা বাড়ান না। যে সমাজে ভ্রাতৃত্ব, ক্ষমাশীলতা ও উদারতা জীবিত থাকে, সেই সমাজ শয়তানের কুমন্ত্রণা ও বিভেদের হাত থেকে নিরাপদ থাকে।

আপনার কমেন্ট

You are replying to: .
captcha