বৃহস্পতিবার ৬ নভেম্বর ২০২৫ - ২১:২৬
মানুষের হৃদয়ে প্রভাব বিস্তারে আয়াতুল্লাহ সুবহানির নির্দেশনা

ইরানের ধর্মীয় শহর কোমে আয়োজিত সাপ্তাহিক নৈতিকতা পাঠে আয়াতুল্লাহিল উজমা সুবহানি বলেন, মানুষের মন জয় করতে জোরজবরদস্তি বা কঠোরতা নয়, বরং উত্তম চরিত্র ও কোমল সামাজিক আচরণই সবচেয়ে কার্যকর। তিনি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সীরাত ও ঐতিহাসিক উদাহরণ উপস্থাপন করে বলেন—সমাজে গ্রহণযোগ্যতা ও দাওয়াতের সাফল্য মূলত আচার–আচরণ ও হৃদয়গ্রাহী ব্যবহারের মাধ্যমেই অর্জিত হয়।

হাওজা নিউজ এজেন্সি: ১৪ রাবিউস্‌সানি ১৪৪৬, বৃহস্পতিবার রাতে কোমের পার্দিসান অঞ্চলে ইমাম সাদিক (আ.) ইনস্টিটিউটে আয়াতুল্লাহ সুবহানির সাপ্তাহিক নৈতিকতা পাঠ অনুষ্ঠিত হয়। এতে বহু আলেম, ছাত্র এবং তাদের পরিবার অংশ নেন।

নৈতিকতা: মানুষের স্বভাবগত সম্পদ
পাঠের শুরুতে তিনি বলেন যে নৈতিক গ্রন্থগুলোতে দুইটি পৃথক অধ্যায় থাকে—“আখলাক” ও “মু’আশারাত”।
আখলাক মানুষের স্বভাব ও সৃষ্টিগত চরিত্রের প্রতিফলন—যেমন সত্যবাদিতা, অন্যায়কে ঘৃণা— যা মানবপ্রকৃতিতে স্বভাবতই নিহিত।

রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সীরাতে নৈতিকতা ও সামাজিক আচরণের সমন্বয়
তিনি বলেন, ইসলামে সামাজিক আচরণের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে, কারণ এটি মানুষের সম্পর্ক, দাওয়াত ও সমাজগঠনে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখে। রাসুলুল্লাহ (সা.) দাওয়াতে দুই পদ্ধতি ব্যবহার করতেন—
• যুক্তি–তর্ক ও প্রমাণ (আক্বল নাযারি),
• এবং উত্তম আচরণ, কোমল ব্যবহার ও বাস্তব আচরণিক শিক্ষা (আক্বল আমালি)।

এই কোমল আচরণ সবসময়  ফরজ না হলেও মানুষের হৃদয়ে প্রবেশের সবচেয়ে সফল পদ্ধতি ছিল।

রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর আচরণ থেকে শিক্ষণীয় দিকগুলো
তিনি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর আচরণের নানাবিধ উদাহরণ তুলে ধরেন—
• মানুষকে সালামে অগ্রাধিকার দিতেন।
• কথা বলার সময় সম্পূর্ণ মনোযোগ দিতেন।
• সর্বদা হাসিমুখে থাকতেন।
• ভুল হলে কাউকে ভর্ৎসনা করতেন না।
• বন্ধু–শত্রু, সবাইকে সম্মান করতেন।
• অনুপস্থিতদের খোঁজ নিতেন।
• কর্মী থেকে নেতা পর্যন্ত সবাইকে সমানভাবে মর্যাদা দিতেন।
• প্রয়োজনীয় স্থানে বসতেন, দুঃস্থদের সাহায্য করতেন এবং তা না পারলে মিষ্টি কথায় সান্ত্বনা দিতেন।
• তাঁর মজলিস ছিল শান্ত, মার্জিত; কারও কথা মাঝপথে থামাতেন না।

সামাজিক আচরণ: সমাজে প্রভাব বিস্তারের মূল চাবিকাঠি
তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর গুণাবলি অসীম; তবে এ আচরণগুলোই ছিল তাঁর সামাজিক প্রভাবের রহস্য। কুরআনেও বলা হয়েছে—
“আর যদি তুমি কঠোর ও কঠিন;হৃদয়ের হতে, তারা তোমার চারপাশ থেকে দূরে সরে যেত।”

তাই সমাজে প্রভাব বা গ্রহণযোগ্যতা অর্জন হয় মূলত উন্মুক্ত আচরণ ও উত্তম ব্যবহারের মাধ্যমে।

তিনি যোগ করেন যে পাশ্চাত্যেও নৈতিকতার বহু শিষ্টাচার ইসলাম থেকেই গ্রহণ করা হয়েছে। আজকের আলেম, মুবাল্লিগ ও দাঈদের উচিত—রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর মু’আশারাতকে নিজেদের জীবনে বাস্তবায়িত করা।

হাসিমুখে মানুষকে আকর্ষণ
তিনি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর বনি আবদুল মুতালিবকে উদ্দেশ করে বলা বাণী উল্লেখ করেন—

“তোমরা সম্পদ দিয়ে মানুষের মন জয় করতে পারবে না; (তাই) উত্তম চরিত্র দিয়ে তাদের মন জয় করো।”

তিনি বলেন, মানুষের সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলা, শান্তভাবে শোনা এবং বিনয়ের সঙ্গে মিশে থাকা—এগুলোই দাওয়াতের মূল পদ্ধতি। এটি কোনো ভণ্ডামি নয়; বরং অন্তরগত কোমলতার প্রকাশ।

ইসলামের সমৃদ্ধ রেওয়ায়েত ভান্ডার
তিনি উল্লেখ করেন যে “ওয়াসায়েলুশ্‌শিয়া” ও “মুহাজ্জাতুল বাইজা”–এর মতো গ্রন্থে সামাজিক শিষ্টাচার নিয়ে বহুসংখ্যক বর্ণনা সংগ্রহ করা হয়েছে, যা মুসলমানদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা।

ইতিহাসে সামাজিক আচরণের অনন্য উদাহরণ

১. ইমাম আলী (আ.)-এর সহযাত্রী একটি অমুসলিমের ইসলাম গ্রহণ: ইমাম আলী (আ.) পথের শেষভাগে অমুসলিম সহযাত্রীকে কয়েক কদম এগিয়ে দিয়ে বিদায় জানান। এতে মুগ্ধ হয়ে সে পরে ইসলাম গ্রহণ করে।

২. আয়াতুল্লাহ বুরুজার্দি ও আয়াতুল্লাহ হুজ্জাতের বিনয়: উভয়ের পারস্পরিক সম্মান ও নম্রতা ছিল নৈতিক আচরণের উজ্জ্বল নিদর্শন।

৩. আয়াতুল্লাহ মামাকানি ও আয়াতুল্লাহ শারিয়ানির পারস্পরিক মর্যাদাবোধ: আয়াতুল্লাহ মামাকানির ইরান সফর উপলক্ষে আয়াতুল্লাহ শারিয়ানির প্রশংসাপূর্ণ বার্তা ছিল তাদের উচ্চ নৈতিকতার প্রতিফলন।

৪. শেখ হাসান ফালসাফির বিনয়: উচ্চ মর্যাদার আলেম হয়েও সাধারণ মানুষের মতো রুটির দোকানের লাইনে দাঁড়াতেন; বিশেষ সুবিধা গ্রহণ করতেন না।

৫. লেবাননে শিয়াদের উত্থান— হযরত আবুযার গিফারির চরিত্রের প্রভাব: হযরত আবুযর (রা.) তাঁর আচরণ ও দাওয়াতের মাধ্যমে লেবাননে আহলে বাইতের (আ.) ভালোবাসার বীজ বপন করেন।

আচরণের মাধ্যমেই দাওয়াত—ইমাম সাদিক (আ.)-এর শিক্ষা
শেষে তিনি ইমাম সাদিক (আ.)-এর বাণী উল্লেখ করেন—

“মানুষকে শুধু কথায় নয়—তোমাদের কর্ম, সততা ও পরহেজগারিতে দাওয়াত দাও।”

তিনি ব্যাখ্যা করেন যে মানুষের কাছে নিম্ন তিনটি গুণ স্পষ্ট হওয়া জরুরি—

১. সৎকাজে পরিশ্রম

২. সত্যবাদিতা

৩. অঙ্গীকার রক্ষা

আয়াতুল্লাহ সুবহানি বক্তব্যের শেষাংশে জোর দিয়ে বলেন, ইসলামের প্রকৃত শক্তি নিহিত রয়েছে চরিত্রে, আচরণে ও মানুষের প্রতি আন্তরিকতায়। ধর্মীয় দাওয়াত, নেতৃত্ব ও সমাজগঠনের ভিত্তি হলো উত্তম আচার–আচরণ। তিনি উপস্থিত আলেম ও ছাত্রদের আহ্বান জানান—রাসুলুল্লাহ (সা.) ও আহলে বাইতের সীরাত থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজস্ব আচরণে উন্নতি ঘটানোই মানুষের হৃদয় জয় ও সমাজে ইতিবাচক প্রভাব বিস্তারের সবচেয়ে কার্যকর পথ।

আপনার কমেন্ট

You are replying to: .
captcha