হাওজা নিউজ এজেন্সি: তেহরানের হোসাইনিয়ায় আয়াতুল্লাহ আলভী তেহরানীর স্মরণে আয়োজিত ধর্মীয় সভায় তিনি আল্লাহর নামসমূহ ও আহলে বাইতের (আ.) মর্যাদা নিয়ে গভীর আলোচনা করেন।
আল্লাহর নামসমূহের তাৎপর্য
বক্তা বলেন, “আল্লাহ তায়ালা নিজের জন্য তিন হাজার নাম নির্ধারণ করেছেন। এর মধ্যে এক হাজার নাম মানুষের কাছে প্রকাশিত হয়েছে এবং সেগুলো দোয়া জওশন কাবির-এ এসেছে। এসব নামের মধ্যে কোনোটি আগুন, রোষ বা ক্রোধের ইঙ্গিত বহন করে না; বরং প্রতিটি নামই আল্লাহর সত্তা, গুণাবলি ও কর্মের এক মহাসমুদ্র।”
তিনি বলেন, “আল্লাহর এসব নাম আসলে একটিই বাস্তবতা ও একটিই নূর। সত্তা ও গুণাবলির মধ্যে কোনো বিভেদ নেই। যে ব্যক্তি সত্তা থেকে গুণাবলিকে আলাদা ভাবে, সে প্রকৃতপক্ষে শিরকে লিপ্ত হয়।”
তিনি যোগ করেন, “হাজার নাম নবীদের শেখানো হয়েছে, আর অপর হাজারটি ‘আসমা-এ-মুস্তাআসার’—যেগুলো আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট, কেউ সেগুলোর জ্ঞান রাখে না। সেগুলো কিয়ামতের দিনে প্রকাশ পাবে।”
তিনি বলেন, “নবী করিম (সা.) বলেছেন: এই হাজার নামের মধ্যে নিরানব্বইটি ‘আসমাউল হুসনা’। এগুলোর প্রতিফলন মানবসমাজেও দেখা যায়, এমন মানুষ আছেন যাঁদের বলা যায় ‘জীবন্ত ও চলমান আসমাউল হুসনা’। ”
আহলে বাইত (আ.) আল্লাহর সর্বোচ্চ নিদর্শন
তিনি ইমাম বাকের (আ.)-এর বাণী উদ্ধৃত করেন: «ما لله آيةٌ أعظم منّى»
“আল্লাহর এমন কোনো নিদর্শন নেই যা আমার চেয়ে মহান।”
তিনি বলেন, ইমাম আলী (আ.)-ও একইভাবে বলেছেন: «ما لله آيةٌ أكبر منّي»
“আল্লাহর এমন কোনো নিদর্শন নেই যা আমার চেয়ে বড়।”
বক্তা নবী করিম (সা.আ.)-এর হাদিসও উল্লেখ করেন:
«أنا وعليّ من شجرةٍ واحدة، وسائر الناس من أشجار شتّى»
“আমি ও আলী একই বৃক্ষের অংশ, আর অন্য মানুষ বিভিন্ন বৃক্ষের।”
তিনি বলেন, “ইমাম আলী (আ.)-কে জীবন থেকে বাদ দেওয়া মানে নবুয়তকে একটি নির্জীব ধারণায় পরিণত করা। নবুয়ত আলী (আ.) ছাড়া শুকনো বৃক্ষের মতো।”
ইসলামী ইতিহাসে বিকৃতি ও প্রকৃত ঈশ্বরের ধারণা
হুজ্জাতুল ইসলাম আনসারিয়ান বলেন, “বনু উমাইয়া ও বনু আব্বাস মানুষের জন্য এক ভ্রান্ত ঈশ্বর গড়ে তুলেছিল। অথচ আহলে বাইতের (আ.) ঈশ্বরই সেই প্রকৃত আল্লাহ, যিনি কুরআনের ভাষায় ‘لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ’ — যার কোনো তুলনা নেই।”
তিনি সতর্ক করে বলেন, “মানুষ যতটা আল্লাহ থেকে দূরে যায়, শয়তান তত দ্রুত তার হৃদয়ে প্রবেশ করে। শয়তান এক মুহূর্তও দেরি করে না।”
নামকরণ ও পিতার দায়িত্ব
তিনি বলেন, “আল্লাহ নিজেই অনেক কিছুর নাম রেখেছেন—যেমন পৃথিবীর নাম ‘আর্দ’, আকাশের নাম ‘সামা’ এবং প্রথম মানুষের নাম ‘আদম’। কিন্তু সব নামই আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য নয়; জাহেলিয়াত যুগে অনেকেই সন্তানদের অনুচিত নাম দিত।”
এরপর তিনি ইমাম আলী (আ.)-এর বাণী উদ্ধৃত করেন: «حقّ الولد على والده أن يُحسِنَ اسمَه»
“সন্তানের ওপর পিতার অন্যতম অধিকার হলো, তার জন্য সুন্দর নাম নির্বাচন করা।”
‘ফাতিমা’ নামের অর্থ ও আধ্যাত্মিক তাৎপর্য
তিনি বলেন, “আল্লাহ তায়ালা নবী করিম (সা.আ.)-কে নির্দেশ দিয়েছিলেন, যেন তাঁর কন্যার নাম ‘ফাতিমা’ রাখা হয়। শব্দটি এসেছে ‘فَطَنَ’ মূল থেকে, যার অর্থ ‘বিচ্ছিন্ন হওয়া’ বা ‘পৃথক হওয়া’। আহলে বাইত (আ.) এই নামের তিনটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন, এবং তিনটিই হযরত ফাতিমা (সা.আ.)-এর জীবনে পরিপূর্ণভাবে প্রতিফলিত হয়েছে।”
তিনি বলেন, “হযরত ফাতিমা (সা.আ.) সকল প্রকার নৈতিক, মানসিক ও আচরণগত অপবিত্রতা থেকে মুক্ত ছিলেন। এজন্যই আল্লাহ কুরআনে বলেন—” «إِنَّمَا يُرِيدُ اللَّهُ لِيُذْهِبَ عَنكُمُ الرِّجْسَ أَهْلَ الْبَيْتِ وَيُطَهِّرَكُمْ تَطْهِيرًا»
(সূরা আহযাব, আয়াত ৩৩)
“আল্লাহ চান, তোমাদের (আহলে বাইত) থেকে সকল অপবিত্রতা দূর করতে এবং তোমাদের পরিপূর্ণরূপে পবিত্র করতে।”
হযরত ফাতিমা (সা.আ.)-এর জ্ঞানের অলৌকিকতা
তিনি ইমাম বাকের (আ.)-এর একটি রেওয়ায়েত উল্লেখ করে বলেন, “যখন হযরত খাদিজা (সা.আ.) তাঁর কন্যা ফাতিমা (সা.আ.)-কে দুধ থেকে বিরত করতে চাইলেন, তখন আল্লাহ তাঁর অস্তিত্বকে জ্ঞানে পূর্ণ করে দেন। এরপর তিনি আর দুধের প্রয়োজন অনুভব করেননি। পরবর্তী জীবনে তিনি যে দুটি খুতবা প্রদান করেন—একটি নবীর মসজিদে, অন্যটি নিজ গৃহে—তা পনের শতাব্দী ধরে আলেমরা ব্যাখ্যা করছেন, এখনো শেষ হয়নি।”
কিয়ামতের দিন ফাতিমা (সা.আ.)-এর মুক্তিদান
শেষে তিনি বলেন, “ইমামগণ (আ.) বলেছেন, আল্লাহ তাঁকে ‘ফাতিমা’ নাম দিয়েছেন, কারণ কিয়ামতের দিন তিনি দাঁড়িয়ে তাঁর পিতা ও স্বামীর শিয়াদের আগুন থেকে পৃথক করবেন এবং বলবেন—” «اللهم هذا شيعتى وشيعة أبى وبعلي، فحرّم أجسادهم على النار»
“হে আল্লাহ! এরা আমার, আমার পিতা ও আমার স্বামীর অনুসারী। তুমি তাঁদের দেহকে আগুনের ওপর হারাম করে দাও।”
তিনি বলেন, “এ থেকেই প্রমাণিত হয় যে, হযরত ফাতিমা যাহরা (সা.আ.) কেবল নিষ্পাপতার প্রতীকই নন, বরং কিয়ামতের দিন শিয়াদের মুক্তিদাত্রীও। তাঁর মর্যাদা ও ক্ষমতা আল্লাহর অনুমতিক্রমে এমন উচ্চ যে, তিনি জান্নাত ও জাহান্নামের সীমারেখা নির্ধারণে ভূমিকা রাখবেন।”
হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমিন আনসারিয়ান বলেন, “যে হৃদয়ে ফাতিমা (সা.আ.)-এর ভালোবাসা আছে, সে হৃদয়ে কখনও আগুন প্রবেশ করবে না; কারণ তাঁর ভালোবাসা আল্লাহর সন্তুষ্টির প্রতীক, আর তাঁর সন্তুষ্টিই নবীর সন্তুষ্টি।”
আপনার কমেন্ট