হাওজা নিউজ এজেন্সি: রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম) মানবসমাজকে এমন এক মহান নৈতিক সত্যের দিকে আহ্বান করেছেন, যা ইসলামী মানবিকতার গভীরতম স্তরকে প্রতিফলিত করে। তিনি ইরশাদ করেছেন,
الخَلقُ عِیالُ اللّه، فأحَبُّ الخَلقِ إلی اللّه مَن نَفعَ عِیالَ اللّه
অর্থাৎ—সমস্ত সৃষ্টি আল্লাহর ই’য়াল, তাঁরই প্রতিপাল্য; আর আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয় সে-ই, যে তাঁর এ বান্দাদের সবচেয়ে বেশি উপকার করে।
এই মহিমান্বিত বক্তব্যে মানবতার মূল দর্শন নিহিত—সমস্ত মাখলুক আল্লাহর দস্তরখান থেকে রুজি পাচ্ছে এবং সবাই তাঁর দয়ার ছায়ায় আশ্রিত। তাই যে মানুষ আল্লাহর মাখলুকের কল্যাণে নিজেকে বিলিয়ে দিতে পারে, তার হৃদয়ই আল্লাহর নিকট সর্বাধিক প্রিয় হয়ে ওঠে।
হুজ্জতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমিন মুহাম্মদ হাদী ফাল্লাহ তাঁর এক বক্তৃতায় “আল্লাহর প্রিয়তম সৃষ্টির বৈশিষ্ট্য” বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাখ্যা পেশ করেন। তিনি এই হাদিসের ধারণাকে আরও গভীরভাবে বিশ্লেষণ করে মানবিকতার প্রকৃত রূপ পাঠকদের সামনে উপস্থাপন করেন।
রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর বাণীর ব্যাখ্যায় বলা হয়— সকল সৃষ্টিই আল্লাহর পরিবার; এই অর্থে যে, তারা অস্তিত্বধারার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আল্লাহরই নেয়ামত, রহমত, দয়া ও রিজিকের উপর নির্ভরশীল। এই বিস্তৃত ব্যাখ্যার আলোকে, সমগ্র সৃষ্টি আল্লাহর দস্তরখানে বসে তাঁর দান-অনুগ্রহে জীবিত। তাই যে-ব্যক্তি এই ‘আল্লাহর দস্তরখানভুক্ত’ মানুষের কল্যাণে আসে, তাদের উপকারে নিজেদের নিয়োজিত করে, আল্লাহ তাঁকে তাঁর নিকটবর্তী বান্দার মর্যাদা দান করেন।
বাস্তবে, আল্লাহর দেওয়া সম্পদ, ক্ষমতা বা কোনো নেয়ামত শুধু নিজস্ব মালিকানার বস্তু নয়—এটি পরীক্ষা ও আমানত। তাই যার হাতে সামর্থ্য আছে, তার দায়িত্ব হলো নিজের সীমার মধ্যে যতটা পারে—অন্যদের সুখ, উপকার ও স্বস্তি এনে দেওয়া; মানবমৈত্রীর এই আচরণই আল্লাহর গুণাবলির প্রতিফলন।
এই বক্তব্যে নবী করিম (সা.) মানবসমাজকে ‘খোদাগুণ ধারণে’ বা ‘তাখাল্লুক্ বিআখলাকিল্লাহ’—অর্থাৎ আল্লাহর গুণাবলি চরিত্রে ধারণ করতে আহ্বান করছেন। যেমন আল্লাহ সমগ্র সৃষ্টির জন্য দয়া ও অনুগ্রহের বিশাল দস্তরখান বিস্তৃত করেছেন, তেমনি মানুষও উচিত তার হৃদয়কে প্রশস্ত করা, তার ক্ষমতাকে কল্যাণের পথেই ব্যবহার করা, এবং তার আচরণে আল্লাহর নৈতিক গুণাবলির প্রতিফলন ঘটানো।
তাই উদারতা, দানশীলতা, প্রশস্ত হৃদয়, আত্মত্যাগ ও মানবকল্যাণে এগিয়ে আসা—এসবই ইসলামী চরিত্রের মৌলিক স্তম্ভ। একজন মু’মিন কখনো কৃপণ, সংকীর্ণমনা কিংবা আত্মকেন্দ্রিক হতে পারে না। বরং তার উচিত মানুষের উপকারে নিজের সম্পদ, সময়, সামর্থ্য—যা পারে তা ব্যয় করা।
তবে দানশীলতা শুধু অর্থ-সম্পদ দেওয়ায় সীমাবদ্ধ নয়। প্রকৃত উদারতা হলো—
• হৃদয়ের প্রশস্ততা,
• মনের মহত্ত্ব,
• মানুষের প্রতি দয়া,
• ক্ষমাশীলতা,
• এবং এমন একটি চরিত্র, যা দেখলেই অন্যেরা প্রশান্তি পায়।
বিশেষত পরিবার-পরিজন, আত্মীয়স্বজন ও নিকটতম মানুষের সুখের কারণ হওয়া, তাদের সমস্যার সমাধানে এগিয়ে আসা ও তাদের জীবনে স্বস্তি ফিরিয়ে দেওয়া—সত্যিকার ‘সফরাদারি’ বা উদারতার অন্যতম শ্রেষ্ঠ রূপ।
তবে অনেক সময় কেবল কথার মাধ্যমে কারও মন খুশি করা সম্ভব হয় না। মানুষকে প্রকৃত আনন্দ দেওয়ার জন্য আগে তার কষ্ট, দুঃখ ও সমস্যাগুলো দূর করা প্রয়োজন। যখন তার জীবনের সংকটগুলো দূর হয়, তখনই তার মনে প্রকৃত আনন্দ ও প্রশান্তি ফিরে আসে। আর এটাই নবী করিম (সা.)-এর শিক্ষা—মানুষের সমস্যার সমাধানে এগিয়ে যাওয়াই হলো খোদাগুণ ধারণের সর্বোচ্চ প্রকাশ।
পরিশেষে বলা যায়— যে হৃদয় মানুষকে নিজের মতো ভালোবাসে, যে হাত মানুষের উপকারে প্রসারিত হয়, যে মন মানুষের সুখে নিজের সুখ খুঁজে পায়—সেই মানুষই আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয় বান্দা।
আপনার কমেন্ট