হাওজা নিউজ এজেন্সি রিপোর্ট অনুযায়ী,
রিপোর্ট: মুস্তাক আহমদ
১১ হিজরী থেকে জুলুমের সফর ৬১ হিজরী'তে যখন পৌঁছায়, জুলুম তখন কারবালায়৷ কারবালা ঘটেছে পঞ্চাশ বছর আগে৷ আমি আজ তুলে ধরবো কিভাবে মদিনার ঘটনা কারবালায় রূপ নিলো — এটি গবেষণামূলক বিশ্লেষণের দৃষ্টি'তে পাঠ করতে হবে এবং তা খোলা মনে অনুভব করতে হবে৷
দেখুন ইতিহাস কখনো হঠাৎ রক্তাক্ত হয় না। যুগে যুগে যত রক্তক্ষয়ী মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছে সবই সূচিত হয়েছে আনেক আগে, আর ফলাফল ঘটেছে পরে৷ ইতিহাসের পাতায় আমরা যত ঘটনা পড়ি সব ঘটনার ঊৎস অন্যস্থানে ঘটেছে অনেক বছর আগে৷
তেমনই কারবালার আগুন একদিনে জ্বলে ওঠেনি।
এই আগুনের স্ফুলিঙ্গ জন্ম নিয়েছিল— মদিনার সেই অশ্রুভেজা ঘরগুলোতে, যেখানে নবী (সঃ)-এর দাফনের আগেই নোংরা রাজনীতি শুরু হয়ে গিয়েছিল, যেখানে পর্দার আড়ালে জমছিল অবৈধ্য বিষাক্ত ক্ষমতার হিসাব-নিকাশ, যেখানে আহলে বাইতকে একের পর এক সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল নেতৃত্ব থেকে। এবং আহলে বাইতের মৌলিক ফজিলত গুলি তাদের নামের সঙ্গে জুড়ে দিয়েছিল, যারা এর হকদার ছিলো না৷
কারবালা একটি দিনের নাম নয়—এটি একটি ধারাবাহিক ইতিহাসের চূড়ান্ত অধ্যায়। আমি আজ এই প্রবন্ধ সেই দীর্ঘ পথচলার কাহিনী তুলে ধরবো না, বরং কিছু মূল কারন তুলে ধরবো, যার প্রতিফল স্বরূপ কারবালা ঘটেছিল।
(১)নবী (সঃ)-এর ইন্তেকাল ও “নেতৃত্ব” প্রশ্ন — প্রথম রাজনৈতিক বিভাজনঃ
৬৩২ খ্রিষ্টাব্দ। নবী (সঃ) ইন্তেকাল করেন।
দাফন এখনো হয়নি। নবী (সঃ)-এর ঘর প্রিয়জনের কান্নায় ভরা। আর ঠিক সেই মুহূর্তে— নবীর লাশ ফেলে রেখে বেশকিছু ব্যক্তি সাকিফা বনি সায়িদায় নেতৃত্ব দখলের সভায় বসে যায়।
এদিকে মওলা আলি ও অল্পকিছু সাহাবী নবীর লাশ নিয়ে মদিনায় বসে আছেন৷ উনারা যাদের অপেক্ষায় আছেন, তারা তখন সাকিফায় ক্ষমতার সিদ্ধান্ত নিয়ে চূড়ান্ত কথা কাটাকাটিতে ব্যস্ত।
নবীর পরে ক্ষমতায় বসা নিয়ে এই বিভাজনের পথ তৈরি হয়— অথচ গাদীরে খুমে মওলা আলী (আঃ) ছিলেন মনোনীত নেতা৷ কিন্তু যারা গাদীরে খুমে আল্লাহ ও নবীর ঐশী সিন্ধান্তকে যথেষ্ট মনে করেন নি, তারা ক্ষমতার ভাগাভাগিতে নবীর লাশ ফেলে রেখে পলায়ন করেন সকিফা হলে৷
ক্ষমতার এই প্রথম দ্বন্দ্ব পরবর্তী প্রতিটি রাজনৈতিক ঘটনার ভিত তৈরী হয়৷
(২)ফাতিমা (আঃ)-এর ঘর, দ্বার, পাঁজর আক্রোশের শিকার— মদিনার সবচেয়ে বেদনাময় অধ্যায়ঃ
ফাতিমা (আঃ)-এর ঘরে আগুন ধরানো, দরজা চাপা পড়ে পাঁজর ভাঙা, গর্ভস্থ সন্তান মুহসিনের শাহাদাত— অবশেষে নবীকন্যার শাহাদত৷
এই ঘটনার মূল প্রভাব: আহলে বাইতের মানসিক আঘাত, মদিনায় ক্ষমতাকেন্দ্র থেকে তাদের দূরে সরানো, আলী (আঃ)-এর রাজনৈতিক বিচ্ছিন্নতা
নবী (সঃ)-এর ঘরের প্রতি অশ্রদ্ধার নজির তৈরি
এই আঘাতই পরবর্তী প্রজন্মে উমাইয়াদের প্রতিকূলতা তৈরি করে, যা পরিণামে কারবালায় বিস্ফোরিত হয়।
পরবর্তীকালে একটি বাতিল নিজাম তৈরী হয়, সেই বাতিল নিজামটি হলঃ ক্ষমতার জন্য মানুষ হত্যা জায়েজ, এমনকি মানুষ এর এক কদম উপরে উঠে বলতে লাগে - ক্ষমতার বিপরীতে নবীর পরিবারদের হত্যাকরা জায়েজ৷
(৩) ফাদাক দখল — অর্থনৈতিকভাবে আহলে বাইতকে দুর্বল করাঃ
ফাদাক ছিল নবী (সঃ)-এর দেওয়া ফাতিমা (আঃ)-এর মালিকানাধীন বাগান, নবী (সঃ)-এর ওফাতের পর এটি রাষ্ট্রীয় খাজানায় নিয়ে নেওয়া হয়। ফাদাকের অধিকারহানি মানে— আহলে বাইতকে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল করা, তাদের রাজনৈতিক প্রভাব ক্ষতিগ্রস্ত করা, উমাইয়াদের আর্থিক শক্তি বৃদ্ধি পেতে থাকে, ক্ষমতার লড়াইয়ে অর্থ একটি প্রধান ভূমিকা রাখে।
এটাই উমাইয়া রাজনীতিকে শক্ত ভিত্তি দেয়।
(৪)আলী (আঃ) বনাম উমাইয়া — রাজনৈতিক সম্পর্কের শত্রুতা শুরুঃ
মুয়াবিয়া (ইয়াজিদের বাবা) ছিলেন সিরিয়ার গভর্নর। তিনি আলীর শাসন কখনো মেনে নেননি।
এরফলে নানান অজুহাতে গৃহযুদ্ধ তৈরী করা হলো, এর ফলেই হলো সিফফিন যুদ্ধ, নাটকপূর্ণ সালিসি,
তাহকিম ঘটনা, খারেজিদের তৈরী করা, আলী (আঃ)-এর শাহাদাত (৬৬১ খ্রি.) মুয়াবিয়ার হাতে সিরিয়া হয়ে ওঠে উমাইয়াদের সামরিক রাজধানী,
এবং এখান থেকেই গড়ে উঠতে থাকে এক “রাজনৈতিক পরিবার” -যার পরিণতিতে রাজতন্ত্র জন্ম নেয়।
(৫) হাসান (আঃ)-এর সুলাহ ও উমাইয়া ক্ষমতার প্রতিষ্ঠাঃ
হাসান (আঃ) শান্তির খাতিরে সুলাহ করেন মুয়াবিয়ার সাথে, যেমন নবী সঃ সুলাহ করেছিলেন মক্কার কাফেরদের সাথে, যেটি হোদাবিয়ার সুলাহ বলা হয়৷
ইমাম হাসান আঃ সুলাহ শর্ত রাখেনঃ
(ক) তার পরে ক্ষমতা বংশানুক্রমে চলবে না,
(খ) নেতৃত্ব ফিরে আসবে যুগের যোগ্য ব্যক্তির কাছে৷
(গ) নবী পরিবারকে গালি দেওয়া যাবে না৷
— কিন্তু মুয়াবিয়া সব প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেন,এবং এখানেই প্রথম রাজতন্ত্রের বীজ পোঁতা হয়। ক্ষমতার রদবদল অর্থাৎ খিলাফত থেকে রাজতন্ত্রে রূপ নিলো৷ দুটোই ছিল জুলুমে ভরা৷
(৬) ইয়াজিদের মনোনয়ন — রাজতন্ত্রের পূর্ণ প্রতিষ্ঠাঃ
মুয়াবিয়া মৃত্যুর আগে জোরপূর্বক সকল প্রদেশ থেকে ইয়াজিদের নামে বায়াত আদায় করেন। কিন্তু স বিরোধীতা করেন- হযরত হুসাইন (আঃ), আবদুল্লাহ ইবনে জুবায়ের, আবদুল্লাহ ইবনে ওমর
আবদুর রহমান ইবনে আবু বকর (রাঃ)৷
ইয়াজিদের চরিত্র নিয়ে সবকিছু প্রকাশ্যে ছিল—মদ, নাচগান, অত্যাচারী শাসন, ধর্মীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ
এমন ব্যক্তির হাতে মুসলিম নেতৃত্ব দেওয়া ছিল নবী (সঃ)-এর যুগের আদর্শ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন।
এরপর ৬১-হিজরী ইয়াজিদ তৈরী করে কারবালায় জুলুম ও অত্যাচার৷ সেই জুলুম যেটি মদিনা থেকে শুরু হয়েছিল, ইয়াজিদ শুধু বড় জালেমের অনুসরন করেছে মাত্র৷
গাদীরে খুমের ঐশী বার্তা পরিত্যাগ করে যারা সকিফা হলে গিয়েছিল, সেই সকিফা হলে তারা যে পথ রচনা করেছিল, ইয়াজিদ কারবালায় প্রকাশ করেছে মাত্র৷
আপনার কমেন্ট