হযরত ফাতিমা যাহরা (সা.আ.)-এর পবিত্র বেলাদাত দিবস উপলক্ষে হাওজা নিউজ এজেন্সি’র সঙ্গে বাংলাদেশের ইমামিয়া উলামা কাউন্সিলের সাধারণ সম্পাদক হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমিন ড. আব্দুল কুদ্দুস বাদশা একটি বিশেষ সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। পাঠকদের জন্য সেই সাক্ষাৎকারটি তুলে ধরছি:
হাওজা নিউজ এজেন্সি: আধুনিক বিশ্বের বহুমাত্রিক চ্যালেঞ্জের প্রেক্ষাপটে হযরত ফাতিমা যাহরা (সা.আ.)-এর ব্যক্তিত্বের কোন দিকগুলো আজকের মুসলিম নারীদের জন্য সর্বাধিক শিক্ষণীয়?
হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমিন ড. আব্দুল কুদ্দুস বাদশা: আজকের বিশ্ব বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ এবং সন্দেহে জর্জরিত। এই কারণে, হযরত ফাতিমা যাহরা (সা.আ.)-এর ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে জানা এবং তাঁর পথ অনুসরণ করা এই সংকটগুলির সমাধানে সহায়ক হতে পারে। বিশেষ করে ধর্মীয় বিকৃতি মোকাবিলার ক্ষেত্রে।
ফাতেমীয় জ্ঞান আমাদেরকে আজকের এই অশান্তিতে ভরা পৃথিবীতে সত্য ও ন্যায়ের পথে থাকতে সাহায্য করে, যেখানে অনেক ধর্মীয় কনসেপ্ট বিকৃতির শিকার। তাই বিশেষ করে, আমরা ফাতেমীয় জ্ঞানের অসামান্য বৈশিষ্ট্যগুলি উল্লেখ করতে পারি, যা বর্তমান পরিস্থিতিতে মুসলমানদের জন্য একটি মডেল এবং পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করতে পারে। ফাতেমীয় জ্ঞানের প্রথম বৈশিষ্ট্য হলো আল্লাহর সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান এবং আন্তরিক ভক্তি।
হযরত যাহরা (সা.আ.)- তাঁর সমস্ত সত্তা দিয়ে সর্বশক্তিমান আল্লাহর নিকটবর্তী ছিলেন এবং জীবনের সকল বিষয়ে সর্বদা তাঁর উপর নির্ভর করতেন। তাঁর রাতের তাহাজ্জুদ নামাজ, দারিদ্র্য এবং সরল জীবনযাপনের মাধ্যমে তিনি মানবতার জন্য ব্যবহারিক একত্ববাদের এক উদাহরণ স্থাপন করেছিলেন। হযরত যাহরা (সা.আ.)- এর অনুসারী হিসেবে, আমাদের নারীদেরকে সকল সময় এবং সকল স্থানে তাঁর সীরাতের উপর ভিত্তি করে কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে হবে, যাতে তারা পরিবারে ও সমাজে সর্বদা সাংস্কৃতিক, সামাজিক এবং ধর্মীয় হুমকির বিরুদ্ধে অবিচল এবং প্রতিরোধী থাকতে পারি।
হাওজা নিউজ: পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র নির্মাণে ফাতিমা (সা.আ.) যে নৈতিক মূল্য তুলে ধরেছেন—আজকের বৈশ্বিক অস্থিরতায় এগুলো কীভাবে পথনির্দেশ দিতে পারে?
ড. আব্দুল কুদ্দুস বাদশা: জনদরদী এবং সমাজের প্রতি মনোযোগ হযরত যাহরা (সা.আ.)- এর অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল। তিনি নিজে যখন অনেক সমস্যার সাথে লড়াই করছিলেন, তখন তিনি সর্বদা জনগণের সাথে ছিলেন এবং তাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক চাহিদা পূরণের জন্য কাজ করতেন।
অন্যায় ও শোষণ মুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠায় তিনি নিপীড়ন বিরোধী এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের মনোভাব পোষণ করতেন। ইসলামী সমাজে নিপীড়ন ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে তাঁর দৃঢ় অবস্থান ছিল, বিশেষ করে ফাদাকের ঘটনায় এবং আহলে বাইত (সা.)-এর অধিকার রক্ষায় কঠিন পরিস্থিতিতে এবং রাজনৈতিক হুমকির মুখে তিনি কখনও তাঁর ন্যায্য অবস্থান থেকে বিচ্যুত হননি।
ফাতেমীয় জীবনধারা ইসলামী আদর্শ এবং মহানবী (সা.)-এর হাতে কলমে শিক্ষা থেকে গড়ে ওঠা এবং এর বিস্তৃত মাত্রা রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল নৈতিক মূল্যবোধ এবং সামাজিক সম্পর্ক। ফাতেমীয় জীবনধারায় সামাজিক নৈতিকতার গুরুত্বপূর্ণ আবেদন রয়েছে, এই আবেদনের দুইটি প্রাণশক্তি রয়েছে। একটি হলো ধর্মপারয়নতা এবং অপরটি হলো জনহিতকর কর্মপন্থা। হযরত ফাতিমা (সা. আ.) এর জীবনাদর্শ দুটি নীতির সঠিক এবং যৌক্তিক সংযোগ প্রকাশ করে।
সমাজে কার্যকর উপস্থিতি, সামাজিক সম্পর্কে ধর্মীয় রীতিনীতি পালন, আত্মকেন্দ্রিকতা পরিহার, ন্যায়বিচার-কেন্দ্রিকতা এবং নিষ্ঠুরতা-বিরোধীতা হল ফাতেমীয় জীবনধারার প্রধান পরিচয়। আজকের বৈশ্বিক অস্থিরতা নিরসনে এসবগুলো মূল্যবোধই বিশেষ অবদান রাখতে পারে বলে আমার বিশ্বাস।
হাওজা নিউজ: ইসলামী ইতিহাসে নারীর অধিকার, মর্যাদা ও পরিচয় প্রতিষ্ঠায় সায়্যিদাতুন নিসায়িল আলামিন (সা.আ.)-এর ভূমিকা কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
ড. আব্দুল কুদ্দুস বাদশা: নারীর অবস্থান ও মর্যাদা সম্পর্কে হযরত ফাতিমা যাহরা (সা.আ.)- একটি উত্তম উদাহরণ। এই বিষয়টি একজন নারীর মাকাম নির্দেশ করে যে সে কতটা উঁচ্চ মর্যাদায় পৌঁছতে পারে। একইভাবে নারী অধিকার প্রতিষ্ঠায় হযরত ফাতিমা (সা.আ.)- এর ভূমিকা কেবল তাঁর সময়েই নয়, বরং ইসলাম ও ইসলামী সমাজের ইতিহাসেও প্রভাবশালী ছিল। তাঁর শিক্ষা ও আচরণ ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে আদর্শ হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছে এবং একটি নারী অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল সংস্কৃতি গঠনে সহায়তা করেছে।
ইসলামী সমাজে, নারীরা তাদের অধিকার আদায়ের জন্য এবং সমাজে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণের জন্য তাঁর চরিত্র এবং আচরণ দ্বারা অনুপ্রাণিত হতে পারে। হযরত ফাতিমা (সা.আ.)-এর সময়ে উত্থাপিত নারী অধিকার, শিক্ষা এবং সামাজিক ন্যায়বিচার সম্পর্কিত বিষয়গুলি আজকের বিশ্বে এখনও প্রাসঙ্গিক এবং সমসাময়িক নারীদের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে পথ দেখাতে পারে।
হাওজা নিউজ: দক্ষিণ এশিয়ার পরিবারকেন্দ্রিক সমাজে নারীর আত্মমর্যাদা, শিক্ষা বিস্তার ও পারিবারিক স্থিতিশীলতায় ফাতিমা (সা.আ.)-এর জীবন থেকে কোন বাস্তব শিক্ষা নিতে পারি?
ড. আব্দুল কুদ্দুস বাদশা: হযরত ফাতিমা যাহরা (সা.আ.)-এর জীবনে পরিবার এবং ঘর ছিল ঐশ্বরিক মানবতা ও একটি সুস্থ সমাজ গঠনের কেন্দ্র। মহানবী (সা.)-এর কন্যার এই কেন্দ্র পরিচালনা ছিল আধ্যাত্মিকতা এবং ব্যবহারিক জীবন দক্ষতার এক বিজ্ঞতাপূর্ণ সমন্বয় যা এটিকে একটি অনবদ্য মডেলে পরিণত করেছিল।
প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য যে, হযরত ফাতিমা যাহরা (সা.আ.)-এর সবচেয়ে বড় সুখ ছিল এটা যে, তাঁকে এমন কোনও দায়িত্ব দেওয়া হয়নি যার জন্য তাঁকে ঘরের বাইরে না-মাহরাম পুরুষদের সাথে সরাসরি এবং অবিচ্ছিন্নভাবে যোগাযোগ করতে হয়। এই বক্তব্য নারীর শালীনতা ও আত্ম-মর্যাদা রক্ষার বিষয়ে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গির গভীরতা প্রকাশ করে। ধর্মীয় মানদণ্ড পালন করে এবং সতীত্ব রক্ষা করে সমাজে একজন নারীর উপস্থিতি ইসলামী মূল্যবোধগুলির মধ্যে একটি। নারীদের জন্য মানসিক প্রশান্তি একান্ত প্রয়োজন। অপরিচিত পুরুষদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলা একজন নারীর জন্য অতিরিক্ত মানসিক বোঝা এবং দায়িত্ব তৈরি করতে পারে। এই বোঝা থেকে মুক্ত হয়ে হযরত ফাতিমা যাহরা (সা. আ.) যে স্বাচ্ছন্দ্য ও শান্তি অনুভব করেছেন তা নারীর মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি ইসলামের মনোযোগ এবং অপ্রয়োজনীয় উত্তেজনা ও চাপ এড়ানোর ইঙ্গিত দেয়। আর নারীর এই মানসিক শান্তি ও স্থিতিশীলতার আবেশ ছড়িয়ে পড়ে গোটা পরিবারে।
হাওজা নিউজ: পশ্চিমা নারীবাদের তুলনায় ফাতিমা (সা.আ.)-এর আদর্শকে কেন অধিকতর পূর্ণাঙ্গ, ভারসাম্যপূর্ণ ও মানবিক মডেল বিবেচনা করা হয়?
ড. আব্দুল কুদ্দুস বাদশা: পশ্চিমা নারীবাদের সারকথা হলো সমান অধিকারের নামে নারীকে পুরুষে পরিণত করা এবং পুরুষের কাতারে শামিল করা। এই কাজ কখনোই নারীর মর্যাদা বৃদ্ধিতে সহায়ক ছিল না। বরং নারীর নারীত্বকেই বিপাকে ফেলে দিয়েছে এবং যতই সময় গড়াচ্ছে ততই এই সত্যটা নারীর কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
অপরদিকে প্রাচ্যের নারী জন্যও পুরুষতান্ত্রিকতার গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দিয়ে নিজেকে সমাজের বৃহৎ অঙ্গন থেকে বিচ্ছিন্ন করে শুধু গৃহকোণে বন্দী জীবনের অভিজ্ঞতা সুখকর হয়নি।
এমতাবস্থায় হযরত ফাতিমা যাহরা (সা. আ.) প্রকৃতপক্ষে সেই নারীর জন্য তৃতীয় মডেল, যে নারী পাশ্চাত্যেরও নয়, প্রাচ্যেরও নয়। অর্থাৎ যে নারী পাশ্চাত্যের অশ্লীলতাকে মডেল হিসাবে গ্রহণ করে না, আবার প্রাচ্যের বিচ্ছিন্নতার মডেলকেও অনুসরণ করে না। বরং, তার সামনে রয়েছে তৃতীয় একটি আদর্শ, যার গর্বের জায়গাটা অন্য কিছু যার একটি উচ্চ মর্যাদা এবং অবস্থান রয়েছে।
ইতিহাসে কোথাও এমন কোন উল্লেখ নেই যে, কেউ ফাতিমা যাহরা (সা.আ.)-এর একটি চুলও দেখেছে। এর মধ্যে একটি গভীর বার্তা রয়েছে- পবিত্রতা, মর্যাদা এবং ইসলামে নারীর প্রকৃত পর্দার বার্তা। একই সাথে সামাজিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ ও দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি সন্তানের জন্য একজন আদর্শ মা আর স্বামীর জন্য একজন আদর্শ স্ত্রী হয়ে ওঠার স্পৃহা। হযরত ফাতিমা যাহরা (সা. আ.) এর জীবনে এই সবগুলো দিকের সুসমন্বিত রূপ পরিপূর্ণ মাত্রায় প্রকাশ পাওয়ার কারণেই তাঁকে অধিকতর পূর্ণাঙ্গ, ভারসাম্যপূর্ণ ও মানবিক মডেল হিসাবে বিবেচনা করা হয়।
আপনার কমেন্ট