শুক্রবার ১৯ ডিসেম্বর ২০২৫ - ১২:৪৭
হাওজা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পারস্পরিক সহযোগিতার বরকত হলো ইসলামি মানববিদ্যা গবেষণার শক্তিশালীকরণ

হাওজা ইলমিয়ার পরিচালক বলেন: হাওজা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগিতা ও পারস্পরিক যোগাযোগ ইসলামি ও মানববিদ্যার বিকাশ এবং এই ক্ষেত্রগুলোর গবেষণার মানোন্নয়নের ভিত্তি তৈরি করে।

হাওজা নিউজ এজেন্সি রিপোর্ট অনুযায়ী, আয়াতুল্লাহ আলিরেজা আরাফি “মক্তব ও সিরাতে রাসূলুল্লাহ (সা.): মানবগঠনকারী ও সমাজগঠনকারী ইসলামি মানববিদ্যা” শীর্ষক সম্মেলনে—যা হাওজা ও বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণা ইনস্টিটিউটে অনুষ্ঠিত হয়—নবী করিম (সা.)-এর অস্তিত্বগত মর্যাদা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন: নবী (সা.)-এর সঙ্গে আল্লাহর সম্পর্ক একটি মৌলিক ও পরিচয়-নির্মাণকারী সম্পর্ক, যা মানুষকে সর্বোচ্চ মর্যাদায় পৌঁছে দেয়। এই সত্য অনুধাবন করাই নবুয়তের মিশন বোঝার চাবিকাঠি।

তিনি এ বিষয়ে নিজের বারবার চিন্তাভাবনার কথা উল্লেখ করে বলেন: আমি বহুবার নবী (সা.)-এর অস্তিত্বগত সম্পর্ক নিয়ে কথা বলেছি এবং এ বিষয়টি জোর দিয়ে বলেছি যে নবীর সত্যতা এমন এক সত্য, যা আল্লাহর সঙ্গে পূর্ণ সংযোগের মাধ্যমেই অর্থবহ হয়। এই সংযোগই মানুষকে মর্যাদার শীর্ষে পৌঁছে দেয়।

আলভি চিন্তাধারা ও নবী (সা.)-এর মর্যাদার ব্যাখ্যা

হাওজা ইলমিয়ার পরিচালক আমিরুল মুমিনিন হযরত আলী (আ.)-এর চিন্তাধারায় নবী করিম (সা.)-এর বর্ণনার অবস্থান তুলে ধরে বলেন: সম্ভবত কোনো চিন্তাধারাই নবী (সা.)-এর মর্যাদা ও অবস্থান ব্যাখ্যায় হযরত আলী (আ.)-এর চিন্তার উচ্চতায় পৌঁছায়নি। তাঁর বক্তব্যে নবীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো আত্মসংযম, অন্তরীণ সংরক্ষণ এবং এমন এক পথে চলা, যার কোনো তুলনা নেই।

আয়াতুল্লাহ আরাফি আরও বলেন: এই বর্ণনা নবী (সা.)-এর ব্যক্তিত্বের এক গভীর সত্যকে তুলে ধরে, যার দিকে বহু মনীষী ইঙ্গিত করেছেন; তবে এই সত্য সাধারণ বর্ণনা ও পরিমাপের ঊর্ধ্বে।

তিনি নবী করিম (সা.)-এর খাতামিয়্যাত (শেষ নবী হওয়া) প্রসঙ্গে বলেন: নবী (সা.) আল্লাহর রিসালাতের শেষ প্রেরিত এবং ইতিহাসের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মানবজাতির হিদায়াতের পথ উন্মুক্তকারী। তাঁর রিসালাতের মাধ্যমে এমন দরজা খুলে যায়, যা আগে মানুষের জন্য বন্ধ ছিল; এই উন্মোচন ছাড়া মানুষের পক্ষে সত্যে পৌঁছানো সম্ভব ছিল না।

নেতৃত্ব পরিষদের সদস্য হিসেবে তিনি বলেন: এই দরজাগুলো জাতি ও জনগণের জন্য উন্মুক্ত হয় এবং এর মাধ্যমে বাতিলের বিপরীতে হক স্পষ্ট হয়ে ওঠে ও মানুষের জন্য হিদায়াতের পথ সহজ হয়।

হকের শৃঙ্খলা ও বাতিলের মুখোমুখি নবী (সা.)

আয়াতুল্লাহ আরাফি নববী সীরাতে হক ও বাতিলের দ্বন্দ্ব প্রসঙ্গে বলেন: হক একটি সুসংগঠিত মানবিক ব্যবস্থা, যার মানদণ্ড, সীমা ও সূচক রয়েছে। বাতিলও কাঠামোবদ্ধ এবং সঠিকভাবে চিহ্নিত করা জরুরি। নবী করিম (সা.) উভয় ক্ষেত্রেই উপস্থিত—ছোট জিহাদে এবং বড় জিহাদে।

তিনি বলেন: বাতিলের ভয়ংকর আধিপত্য ভাঙা, প্রতারণামূলক বাহ্যিক রূপ সরিয়ে দেওয়া এবং বাতিলের কাঠামো চূর্ণ করা নবীর রিসালাতের অংশ—চাই তা সামাজিক ও ঐতিহাসিক অঙ্গনে হোক কিংবা মানুষের অন্তরীণ জগতে।

হাওজা ইলমিয়ার পরিচালক জোর দিয়ে বলেন: নবী করিম (সা.) বাহ্যিক ও অন্তরীণ—উভয় ক্ষেত্রেই বাতিলের বিরুদ্ধে সংগ্রাম ও হক প্রতিষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ আদর্শ উপস্থাপন করেন। তাঁর সীরাত সব যুগে ব্যক্তি ও সমাজের উৎকর্ষের জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ রোডম্যাপ।

নবীর রিসালাত: মিথ্যা জৌলুস ভাঙা ও ঐশী মহিমা প্রতিষ্ঠা

আয়াতুল্লাহ আরাফি বলেন: নবী করিম (সা.) দুটি অঙ্গনে বাতিলের মোকাবিলা করেন—একটি ছোট জিহাদের ময়দানে, অন্যটি বড় জিহাদের ক্ষেত্রে। উভয় ক্ষেত্রেই বাতিলের কৃত্রিম ও অলংকৃত জৌলুস ভেঙে যায় এবং বাতিলের আসল রূপ প্রকাশ পায়।

তিনি আরও বলেন: বাতিলের জৌলুস ভাঙা একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া, যা নবীর বায়সাত থেকে শুরু করে ইসলামের ঐতিহাসিক ও সভ্যতাগত উত্থান পর্যন্ত বিস্তৃত। এটি কোনো সাময়িক বা সীমিত মিশন নয়; যতদিন সত্যের সঠিক ব্যাখ্যা ও দায়িত্ব বিদ্যমান থাকবে, ততদিন এই পথ চলতে থাকবে।

হক ও বাতিলের সভ্যতাগত দ্বন্দ্ব প্রসঙ্গে তিনি বলেন: নববী বাণী সবসময় এমন বাতিলের মুখোমুখি হয়, যা মিথ্যা জৌলুস ও বাহ্যিক চাকচিক্যে নিজেকে উপস্থাপন করে। কখনো তা সংস্কৃতির রূপে, কখনো সভ্যতার মুখোশে, আবার কখনো শয়তানি ধর্মীয়তার আকারে প্রকাশ পায়—যেমন কুরআনে শয়তানের অলংকরণের কথা বলা হয়েছে।

তিনি বলেন: এই ক্ষেত্রে বাতিল অন্যায়কে সুন্দর করে দেখাতে এবং সত্যকে আড়াল করতে চায়; কিন্তু যখনই নববী সত্যের আলো সমাজে প্রবাহিত হয়, তখন এই কৃত্রিম জৌলুস ভেঙে পড়ে এবং ঐশী মহিমা প্রকাশ পায়।

বাহ্যিক চাকচিক্যের বিপরীতে ইসলামের আধ্যাত্মিক মহিমা

আয়াতুল্লাহ আরাফি বলেন: নবী করিম (সা.) যখন মক্কা থেকে মদিনায় আসেন, তখন ইসলামের কোনো বাহ্যিক জৌলুস বা প্রচলিত সভ্যতাগত প্রদর্শন ছিল না; কিন্তু অর্থ, সত্য, আধ্যাত্মিক দীপ্তি ও ঐতিহাসিক উপস্থিতির দিক থেকে এমন এক মহিমা সৃষ্টি হয়, যা ইতিহাসকে পাল্টে দেয়। এই আধ্যাত্মিক মহিমা রিসালাত, ঈমান, ইচ্ছাশক্তি ও ন্যায়পরায়ণতা থেকে উৎসারিত ছিল এবং তা ঐতিহাসিক ও সভ্যতাগত বাতিলকে চ্যালেঞ্জ জানাতে সক্ষম হয়।

তিনি আরও বলেন: এই আধ্যাত্মিক মহিমাই ব্যক্তিত্ব গড়ে তোলে, সাহাবিদের প্রশিক্ষণ করে এবং একটি টেকসই ঐতিহাসিক ধারার জন্ম দেয়—যা চাকচিক্যের ওপর নয়, বরং হক, ঈমান ও দৃঢ়তার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত।

কোম হাওজা ইলমিয়ার শিক্ষক সমাজের সদস্য হিসেবে তিনি বলেন: আজও যদি এই বাণী আন্তরিকতার সঙ্গে, সময়ের প্রয়োজন অনুযায়ী এবং নতুন প্রশ্নের জবাবে পুনর্পাঠ করা হয়, তবে তা আলোকবর্তিকা হয়ে উঠতে পারে এবং সত্যকে উন্মোচিত করতে পারে। এই সক্ষমতা এখনো জীবিত এবং সমাজকে বাতিলের ধুলো থেকে মুক্ত করতে পারে।

পরিশেষে আয়াতুল্লাহ আরাফি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও গবেষকদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন: আমি অধ্যাপক, গবেষক ও বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্টদের প্রচেষ্টার জন্য ধন্যবাদ জানাই এবং হাওজা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা, সহমর্মিতা ও সমন্বয়ের অঙ্গীকারের ওপর জোর দিচ্ছি। দেশের অগ্রগতি এবং সমাজের বৈজ্ঞানিক ও সাংস্কৃতিক উৎকর্ষের জন্য এই সহযোগিতা অপরিহার্য।

তিনি এসব কর্মসূচির আয়োজনকারীদের প্রতিও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলেন: যারা এই অনুষ্ঠানগুলোর প্রস্তুতি ও বাস্তবায়নে ভূমিকা রেখেছেন, তাঁদের সবাইকে আন্তরিক ধন্যবাদ। একই সঙ্গে গবেষণা ও অনুসন্ধান কেন্দ্রগুলোর মধ্যে সমন্বয় বৃদ্ধির উদ্যোগের জন্যও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি, যার ফল মানবিক উপলব্ধি বৃদ্ধিতে ও মানুষের হৃদয়ে প্রভাব ফেলতে স্পষ্ট।

সবশেষে তিনি বলেন: এই পথে চলতে গিয়ে বৈজ্ঞানিক আলোচনাকে উত্তেজক বা উসকানিমূলক ধারায় নিয়ে যাওয়া উচিত নয়। বরং বিশেষ করে ইসলামি মানববিদ্যা ও মানুষের হৃদয়ের প্রশ্নে জ্ঞান ও ধর্মের মধ্যে গভীর, যুক্তিবাদী ও সুসংহত সম্পর্ক গড়ে তোলার ওপর সবসময় জোর দিতে হবে।

আপনার কমেন্ট

You are replying to: .
captcha