সোমবার ২২ ডিসেম্বর ২০২৫ - ১৪:৩০
ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় গোপনকৃত ক্ষয়ক্ষতির কথা স্বীকার করল ইসরায়েলি গণমাধ্যম

ইসরায়েলের একটি গণমাধ্যম স্বীকার করেছে যে ১২ দিনের যুদ্ধে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় দেশটিতে উল্লেখযোগ্য ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, যা এতদিন তেল আবিব জনসমক্ষে প্রকাশ করেনি।

হাওজা নিউজ এজেন্সি: ইসরায়েলের রাষ্ট্রীয় সম্প্রচারমাধ্যম কান (Kan) জানায়, ইরানের সঙ্গে সংঘাতে ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র একাধিক গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্যবস্তুতে সফলভাবে আঘাত হানে। এসব হামলায় ক্ষয়ক্ষতি ও হতাহতের ঘটনা ঘটলেও সেগুলো কখনোই সরকারি বিবৃতিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।

প্রতিবেদনে বলা হয়, এই তথ্যগুলো ইচ্ছাকৃতভাবে গোপন রাখা হয়েছিল এবং যুদ্ধকে একটি ‘সফল প্রতিরক্ষামূলক অভিযান’ হিসেবে উপস্থাপন করতে একটি নিয়ন্ত্রিত বয়ানের আওতায় রাখা হয়।

রাজনৈতিক ও সামরিক পর্যায়ে ইসরায়েলের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সম্পূর্ণ কার্যকর—এমন ধারণা প্রচার করা হলেও, কান স্বীকার করেছে যে ইরানি ক্ষেপণাস্ত্রগুলো বাস্তব যুদ্ধক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য কার্যকারিতা দেখিয়েছে এবং দৃশ্যমান প্রভাব ফেলেছে।

ইসরায়েলি সম্প্রচারমাধ্যমটি জোর দিয়ে বলেছে, ইরানি ক্ষেপণাস্ত্রের বাস্তব সক্ষমতা ছিল একটি ময়দানি বাস্তবতা, যা ইসরায়েলের সরকারি যুদ্ধবর্ণনায় প্রতিফলিত হয়নি। ফলে দেশটির সাধারণ জনগণ প্রকৃত ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা সম্পর্কে দীর্ঘদিন অজ্ঞাত ছিল।

এই স্বীকারোক্তি এসেছে এমন এক সময়ে, যখন ইসরায়েল ইরানের সঙ্গে নজিরবিহীন এই যুদ্ধের মনস্তাত্ত্বিক, নিরাপত্তাগত ও গণমাধ্যমগত প্রভাব নিয়ন্ত্রণে রাখতে মরিয়া চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

প্রসঙ্গত, ২০২৫ সালের ১৩ জুন, ওয়াশিংটন ও তেহরানের মধ্যে পারমাণবিক আলোচনার মধ্যেই ইসরায়েল ইরানের বিরুদ্ধে উসকানিমূলক ও বিনা প্ররোচনায় আগ্রাসন চালায়। এর ফলেই ১২ দিনব্যাপী যুদ্ধের সূচনা হয়, যাতে ইরানে অন্তত ১,০৬৪ জন নিহত হন। নিহতদের মধ্যে ছিলেন সামরিক কমান্ডার, পারমাণবিক বিজ্ঞানী এবং সাধারণ বেসামরিক নাগরিক।

পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্রও যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে এবং আন্তর্জাতিক আইনের গুরুতর লঙ্ঘন করে ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় বোমা হামলা চালায়।

এর জবাবে ইরানের সশস্ত্র বাহিনী অধিকৃত ভূখণ্ডজুড়ে একাধিক কৌশলগত স্থাপনায় হামলা চালায়। পাশাপাশি কাতারের আল-উদেইদ বিমানঘাঁটি—যা পশ্চিম এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় সামরিক ঘাঁটিকেও লক্ষ্যবস্তু করা হয়।

২৪ জুন, ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ইরানের সফল পাল্টা অভিযানের মাধ্যমে আগ্রাসন বন্ধ করতে বাধ্য করা হয়।

বিশ্লেষকদের মতে, ইরান-ইসরায়েল এই ১২ দিনের যুদ্ধ ছিল জায়নবাদী শাসনব্যবস্থার ইতিহাসে সবচেয়ে ব্যয়বহুল ও ব্যর্থ সময়গুলোর একটি। সরকারি ও বেসরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ইসরায়েলের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আনুষ্ঠানিকভাবে ১২০ থেকে ২০০ বিলিয়ন ডলার বলা হলেও, প্রকৃত হিসাব অনুযায়ী তা প্রায় ৪০০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে।

ক্ষয়ক্ষতির প্রধান খাতগুলো ছিল—
• সরাসরি সামরিক ব্যয়: ১২.২ বিলিয়ন ডলার
• অর্থনৈতিক অচলাবস্থা ও ব্যবসা বন্ধজনিত ক্ষতি: ২১.৪ বিলিয়ন ডলার
• ইরানি হামলায় অবকাঠামোগত ক্ষয়ক্ষতি: ৪.৫ বিলিয়ন ডলার
• উচ্ছেদ ও পুনর্গঠন ব্যয়: ২ বিলিয়ন ডলার

এমনকি ইসরায়েলের নিজস্ব পরিসংখ্যানও দেশটির ওপর গভীর অর্থনৈতিক, সামরিক ও সামাজিক চাপের স্পষ্ট প্রমাণ দেয়। দীর্ঘমেয়াদে বাজেট ঘাটতি, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হ্রাস, পর্যটন খাতের ক্ষতি, দক্ষ জনশক্তির দেশত্যাগ এবং বিনিয়োগকারীদের আস্থাহীনতার মতো সংকট আরও তীব্র হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

সবশেষে বলা যায়, এই ১২ দিনের যুদ্ধ প্রমাণ করেছে যে ইরানের মোকাবিলায় ইসরায়েলের তথাকথিত ২০ বছরের কৌশলগত পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়েছে। ক্রমবর্ধমান ক্ষয়ক্ষতি ও অর্থনৈতিক বিপর্যয় ঠেকাতে তেল আবিবকে যুদ্ধবিরতিতে যেতে বাধ্য হতে হয়।

ইসরায়েলি গণমাধ্যম ও কর্মকর্তাদের স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে প্রস্তুত এই বিবরণ ইরানের চাপের মুখে জায়নবাদী শাসনের প্রকৃত পরাজয় ও বিপর্যয়ের স্পষ্ট চিত্র তুলে ধরে। সকল দাবি ও প্রচারণা সত্ত্বেও, বাস্তবে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের শক্ত প্রতিরোধে ইসরায়েল কার্যত অচল হয়ে পড়েছিল।

আপনার কমেন্ট

You are replying to: .
captcha