শুক্রবার ১৭ জানুয়ারী ২০২৫ - ১২:৪৩
হযরত জয়নাব (সা.আ.)

হাওজা / কারবালার মর্মান্তিক ঘটনা অতিবাহিত হয়ে গেল, কিন্তু আমৃত্যু হযরত জয়নাব (সা.আ.)-এর শোক ও দুঃখের কোনো পরিবর্তন হল না। তিনি সর্বদা কারবালার কষ্টের কথা স্মরণ করে কাঁদতেন। যখন মদীনায় দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়, তখন তার উদার ও দানশীল স্বামী জনাব আবদুল্লাহ তাকে মদীনা থেকে সিরিয়ায় নিয়ে যান। সেখানেই তিনি ভাই ইমাম হোসাইনের (আ.) রক্তমাখা জামা বুকে আগলে রেখে কাঁদতে কাঁদতে পরলোক গমন করেন।

হাওজা নিউজ এজেন্সি রিপোর্ট অনুযায়ী, হযরত জয়নাব (সা.আ.)’র জীবনী থেকে গুরুত্বপূর্ণ কিছু শিক্ষা তুলে ধরা হল:

হায়া, লজ্জাশীলতা ও আত্মসংযম

ইয়াহিয়া মাজনী বলেন যে, আমি কিছুদিন মদীনায় আমিরুল মু'মিনিন হযরত আলী (আ)-এর প্রতিবেশী ছিলাম। আমার বাড়ি হযরত জয়নাব (সা.আ)-এর বাসস্থানের পাশেই ছিল। কিন্তু মাহরামবিহীন কেউ তাঁকে কখনো দেখতে পায়নি বা কখনো তাঁর কণ্ঠস্বর শুনতে পায়নি। হযরত জয়নব (সা.আ.) যখন তার নানা হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর রওজা জিয়ারত করতে চাইতেন তিনি রাতের অন্ধকারে এমনভাবে যেতেন যে, তাঁর পিতা হযরত আলী (আ.) তার সামনে এবং ইমাম হাসান ও হুসাইন (আ.) তার ডানে ও বামে অবস্থান করতেন। তিনি যখনি হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর পবিত্র রওজার কাছে পৌঁছাতেন, তখনি আমিরুল মু'মিনিন হযরত আলী (আ.) প্রজ্জ্বলিত বাতি নিভিয়ে দিতেন। একদিন ইমাম হাসান (আ.)-এর কারণ জিজ্ঞাসা করলেন এবং আমিরুল মুমিনীন (আ.) বললেন, আমি আশঙ্কা থাকি যে কেউ তোমার বোন জয়নাব (সা.আ.)-কে আলোতে দেখে না ফেলে।

[ফাতিমাতুজ্ জাহরা বাহজাতু কাল্বিল মুস্তফা (সা.), রাহমানী আল-হামদানী, পৃষ্ঠা- ৬৪২]

আত্মত্যাগ ও কুরবানী

একদিন আমিরুল মু'মিনিন হযরত আলী (আ.)-এর ঘরে একজন মেহমান উপস্থিত হলেন। ইমাম হযরত ফাতিমা যাহরা (সা.আ.) কে জিজ্ঞাসা করলেন, অতিথি আপ্যায়নের জন্য ঘরে কী আছে? বিবি ফাতিমা (সা.আ.) জবাব দিলেন: সকলেই তাদের ভাগের খাবার খেয়ে ফেলেছে, কেবল জয়নব (সা.আ)-এর খাওয়া বাকি রয়েছে। হযরত জয়নব (সা.আ.) মাকে অনুরোধ করলেন, অতিথিকে তার ভাগের খাবার খাওয়াতে। যদিও তখন তাঁর বয়স মাত্র চার বছর, তিনি সেই অল্প বয়সেই আত্মত্যাগের এক মহান উদাহরণ স্থাপন করলেন।

হযরত জয়নাব (সা.আ.)-এর দুই পুত্র অওন এবং মুহাম্মদকে কারবালার ময়দানে শহীদ করা হয়। তাদের শাহাদাতের পর, তাদের দেহ মোবারক তাঁবুতে আনা হয়েছিল, কিন্তু তিনি তাঁর পুত্রদের শাহাদাতের জন্য কাঁদেননি এবং শোকও করেননি যেমনটি তিনি তাঁর ভাইপো ইমাম হুসাইন (আ.)-এর পুত্র আলী আকবর (আ.)-এর শাহাদাতের পর যেমনটি করেছিলেন। তিনি তার পুত্রদের জানাজার জন্য তাঁবু থেকে বের হননি, কিন্তু যখন আলী আকবর (আ.)-এর জানাজা উপস্থিত হয়, তখন তিনি তাঁবু থেকে বেরিয়ে আসেন।

[হজরত জয়নাব (সা.আ.)-এর জীবনী, পৃষ্ঠা- ২৬]

জ্ঞান ও প্রজ্ঞা সম্পন্ন ব্যক্তিত্ব

হযরত জয়নাব (সা.আ.) তাঁর পিতা হযরত আমিরুল মুমিনীন (আ.) এর মতোই বাগ্মী ও সুবক্তা ছিলেন। যখন তিনি কুফায় খুতবা দিচ্ছিলেন, তখন ইমাম জয়নুল আবেদীন (আ.) বললেন: হে ফুপু! মেহেরবানী করে শান্ত থাকুন। সকল প্রশংসা মহান আল্লাহর, আপনি এমন একজন পণ্ডিত যাকে কেউ শিক্ষা দেয়নি এবং এমন একজন বোধগম্য ও অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন ব্যক্তি যাকে কেউ তা শিক্ষা দেয়নি (কেউ আপনাকে বুঝাননি)।

[বিহারুল আনওয়ার, খণ্ড- ৪৫, পৃষ্ঠা- ১৬৪)

ইমাম জয়নুল আবেদীন (আ.)’র এই হাদিসটি তাঁর পণ্ডিতিপূর্ণ মহত্ত্বের প্রমাণ।

ইবাদি সিরাত (ইবাদত)

হযরত ইমাম জয়নুল আবেদীন (আ.) বলেন, কারবালা থেকে কুফা, কুফা থেকে শাম পর্যন্ত সমস্ত কষ্ট ও যন্ত্রণা সত্ত্বেও আমার ফুপু জয়নব (সা.আ.) কখনও তাহাজ্জদ কাযা করেননি। [ওয়াফিয়াতিল আয়াম্মাহ, পৃষ্ঠা- ৪৪১]

যখন এটিই তার মুস্তাহাব আমল পালনের জ্ঞান ও দৃঢ়তা, তখন ফরজ আমল পালন কোন পর্যায়ে হবে?

আল্লাহর উপর ভরসা

ইমাম জয়নুল আবেদীন (আ.) হযরত জয়নব (সা.আ.)-এর সম্পর্কে অন্যত্র বলেন, হযরত জয়নব (সা.আ.)’র জীবনে কখনো আগামীকালের জন্য কিছু (ধন-সম্পদ) জমিয়ে রাখেননি। অর্থাৎ তিনি কখনো আগামীকালের জন্য কোনো কিছু জমিয়ে রাখতেন না; বরং আল্লাহ তাকে যা দিয়েছেন, তা তিনি আল্লাহর পথে ব্যয় করেছেন।

[ওয়াফিয়াতিল আয়াম্মাহ, পৃষ্ঠা- ৪৪১]

জয়নাব (সা.আ.)র জন্য শোকের প্রতিদান

বর্ণিত আছে যে, হযরত জয়নব (সা.আ.) যখন জন্মগ্রহণ করেন সময়টা ছিল ভীষণ খুশির। সেই সময় হযরত ইমাম হুসাইন (আ.) তিন বা চার বছর বয়সী ছিলেন। তিনি তাঁর নানা আল্লাহর রাসূল (সা.) এর নিকট এসে বললেন, “আল্লাহ আমাকে একটি বোন দান করেছেন।” এই খবর শোনার সাথে সাথে রাসূল (সা.) বিচলিত ও দুঃখিত হয়ে পড়লেন এবং তাঁর চোখে অশ্রুধারা ফুটে উঠল। ইমাম হোসাইন (আ.) জিজ্ঞাসা করলেন, “হে নানা! আপনি কেন দুঃখিত এবং কেন কাঁদছেন?” মহানবী (সা.) বললেন, “হে আমার চোখের আলো! তুমি শীঘ্রই আমার দুঃখ, শোক এবং কান্নার কারণ জানতে পারবে।”

একদিন ফেরেশতা জিব্রাইল (আ.) অবতরণ করলেন এবং তিনি কাঁদছিলেন। মহানবী (সা.) তাকে তার কান্নার কারণ জিজ্ঞাসা করলেন। হযরত জিব্রাইল হযরত জয়নাব (সা.সা.)-এর দিকে ইঙ্গিত করে বললেন, “আপনার এই সন্তান (নাতনী) সারা জীবন নানাবিধ কষ্ট ও যন্ত্রণার সম্মুখীন হবে। কখনও সে আপনার বিচ্ছেদের যন্ত্রণা সহ্য করবে, কখনও তার মায়ের অন্যায় শাহাদাতের জন্য কাঁদবে। কখনও সে তার পিতার বেদনাদায়ক শাহাদাতের জন্য শোক করবে, আবার কখনও সে তার ভাই ইমাম হাসান (আ.)-এর শাহাদাতের জন্য বিলাপ করবে। এমনকি সে কারবালার ভয়াবহ ও মর্মান্তিক যন্ত্রণাও সহ্য করবে, যা তার পিঠ বাঁকিয়ে দেবে এবং তার চুল সাদা করে দেবে।”

এটা শোনার পর আল্লাহর রাসূল (সা.) অঝোরে কাঁদলেন এবং হযরত জয়নাব (সা.আ.)-এর মুখমন্ডলের উপর তাঁর মুখ রেখে ডুকরে কেঁদে উঠলেন। হযরত ফাতেমা যাহরা (সা.আ.) তার কাঁন্নার কারণ জিজ্ঞাসা করলেন, রাসূল (সা.) হযরত জয়নাবের কিছু দুঃখ ও মসিবতের কথা উল্লেখ করলেন।

হযরত ফাতেমা যাহরা (সা.আ.) জিজ্ঞাসা করলেন: পিতা, যে আমার মেয়ের দুঃখ ও শোকের উপর কাঁদবে তার জন্য কি কোনো সিয়াব ও প্রতিদান রয়েছে? রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন: যে জয়নাব (সা.আ.) দুঃখ ও শোকের উপর কাঁদবে সে হাসান ও হোসাইন (আ.)-এর শোকের উপর কাঁদার সওয়াবের সমান সওয়াব পাবে।

[খাসায়েসুল-যায়নাবিয়্যাহ, পৃ. ১৫৫, নাসিখুল-তাওয়ারিখ্ জয়নাব (সা.আ.)-এর ৪৭ পৃষ্ঠা]

জয়নাব (সা.আ.) জীবনের শেষ দিনগুলি

কারবালার মর্মান্তিক ঘটনা অতিবাহিত হয়ে গেল, কিন্তু হযরত জয়নাব (সা.আ.)-এর শোক ও দুঃখের কোনো পরিবর্তন হল না। তিনি সর্বদা কারবালার কষ্টের কথা স্মরণ করে কাঁদতেন। যখন মদীনায় দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়, তখন তার উদার ও দানশীল স্বামী হযরত আবদুল্লাহ তাকে মদীনা থেকে সিরিয়ায় নিয়ে যান।

শামেও (সিরিয়া) তার শোক ও আহাজারি অব্যাহত ছিল। শোক ও ক্রমাগত আহাজারির কারণে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। একদিন দুপুরের সময় তিনি তার স্বামীকে ডেকে বললেন: “আমার বিছানাটি সূর্যের নীচে উঠোনে বিছিয়ে দিন।” হযরত আবদুল্লাহ (আ.) বলেন যে, আমি দেখলাম যে তিনি তার বুকে কিছু আগলে ধরে আছেন এবং ফিসফিস করে কিছু পুনরাবৃত্তি করছেন। যখন আমি কাছে গেলাম, দেখলাম যে তিনি ইমাম হোসাইন (আ.)-এর রক্তমাখা পবিত্র জামাটি তার বুকে আগলে ধরে আছেন এবং হোসাইন (আ.)-এর নাম পুনরাবৃত্তি করে কাঁদছেন এবং হোসাইন (আ.)-এর নাম পুনরাবৃত্তি এবং আল্লাহর জিকির করতে করতেই তিনি এই পৃথিবী থেকে চলে গেলেন।

[আক্বীলাহ্ বনি হাশিম, পৃষ্ঠা- ৫৭, ৫৮]

অনুবাদ: উম্মে যাহরা আহমেদ

Tags

আপনার কমেন্ট

You are replying to: .
captcha