সোমবার ৩ ফেব্রুয়ারী ২০২৫ - ০৮:০০

হাওজা নিউজ এজেন্সি রিপোর্ট অনুযায়ী, 

ইমাম জাফর সাদিক (আ.) বলেন:

إِنَّ لِلْعَبَّاسِ عِنْدَ اللَّهِ مَنْزِلَةً يَغْبِطُهُ بِهَا جَمِيعُ الشُّهَدَاءِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ

"নিশ্চয়ই আল্লাহর দরবারে আব্বাসের এমন এক মর্যাদা রয়েছে, যা দেখে কিয়ামতের দিনে সমস্ত শহীদগণ তাঁকে ঈর্ষা করবে।"

সূত্র: বিহারুল আনওয়ার, খণ্ড ৪৪, পৃষ্ঠা ১৯০

হযরত আব্বাস ইবনে আলী (আলাইহিস সালাম) ইসলামের ইতিহাসে এক অনন্য চরিত্রের অধিকারী, যিনি কেবল বীরত্বের জন্যই নন, বরং আনুগত্য, আত্মত্যাগ ও সত্যের পথে অবিচল থাকার জন্যও স্মরণীয়। তাঁর জীবন কেবল শিয়া মুসলমানদের জন্য নয়, বরং সমগ্র মানবতার জন্য এক অনন্য শিক্ষা ও অনুপ্রেরণার উৎস।

হযরত আব্বাস (আ.)-এর জন্ম ও পরিবার:

হযরত আব্বাস (আ.) জন্মগ্রহণ করেন ২৬ হিজরির ৪ঠা শাবান (৬৪৬ খ্রিস্টাব্দ) পবিত্র মদিনা নগরীতে। তিনি ছিলেন ইসলামের প্রথম ইমাম হযরত আলী (আ.) ও মহিয়সী নারী উম্মুল বানীন (আ.)-এর পুত্র। তাঁর পিতামহ ছিলেন বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) এবং মাতামহ ছিলেন আরবের প্রখ্যাত বীর হযরত হারিস ইবনে খালিদ।
হযরত আব্বাস (আ.) ছোটবেলা থেকেই ইমাম হাসান (আ.) ও ইমাম হুসাইন (আ.)-এর সান্নিধ্যে লালিত হন এবং তাঁদের কাছ থেকে জ্ঞান, ধৈর্য, ন্যায়পরায়ণতা ও আত্মত্যাগের শিক্ষা লাভ করেন।

জ্ঞান ও শিক্ষা:

হযরত আব্বাস (আ.) কেবল যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শী ছিলেন না, বরং ইসলামী জ্ঞানেও ছিলেন অনন্য। তিনি তাঁর পিতা হযরত আলী (আ.) থেকে ইসলামের গভীর শিক্ষা অর্জন করেন। তিনি কুরআনের তাফসির, হাদিস, ফিকহ ও আধ্যাত্মিকতা সম্পর্কে গভীর জ্ঞান রাখতেন।

চারিত্রিক মহত্ত্ব ও গুণাবলী:

হযরত আব্বাস (আ.)-এর চরিত্র ছিল এক অনন্য আদর্শ। তাঁর জীবনের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল—

1. আনুগত্য ও বিশ্বস্ততা: তিনি ইমাম হুসাইন (আ.)-এর প্রতি সর্বোচ্চ আনুগত্য প্রদর্শন করেছেন এবং কখনোই ইমামের নির্দেশ অমান্য করেননি।

2. বীরত্ব ও সাহস: ইসলামের ইতিহাসে তিনি ‘বাবুল হাওয়া’ (বীরদের দরজা) নামে খ্যাত। কারবালার যুদ্ধে তিনি ছিলেন শত্রুদের জন্য এক ভয়ঙ্কর প্রতিপক্ষ।

3. ধৈর্য ও সংযম: কারবালার কঠিন পরিস্থিতিতেও তিনি কখনো হতাশ হননি।

4. আত্মত্যাগ ও ত্যাগের চেতনা: পানির নিকটে পৌঁছেও নিজে না খেয়ে তাঁকে ফিরে আসতে দেখা যায়, যা আত্মত্যাগের এক অনন্য উদাহরণ।

কারবালায় হযরত আব্বাস (আ.)-এর ভূমিকা:

কারবালা প্রান্তরে হযরত আব্বাস (আ.)-এর ভূমিকা ছিল অতুলনীয়। তিনি ছিলেন ইমাম হুসাইন (আ.)-এর বাহিনীকে রক্ষার মূল শক্তি। তাঁর সর্বশেষ ও অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব ছিল শিশুদের জন্য পানি সংগ্রহ করা।

তৃষ্ণার্ত শিশুদের জন্য তিনি দজলা নদীতে প্রবেশ করে পানি সংগ্রহ করেন, কিন্তু শত্রুরা তাঁকে চারপাশ থেকে আক্রমণ করে। একের পর এক আঘাতে তাঁর হাত কেটে ফেলা হয়, কিন্তু তিনি কখনোই তাঁর দায়িত্ব থেকে সরে যাননি। শেষ পর্যন্ত শাহাদত বরণ করলেও তাঁর আত্মত্যাগ চিরস্মরণীয় হয়ে থাকে।

হযরত আব্বাস (আ.) থেকে আমাদের শিক্ষা (বিশেষত শিয়াদের জন্য):

হযরত আব্বাস (আ.)-এর জীবন আমাদের জন্য বহু মূল্যবান শিক্ষা বহন করে, বিশেষত শিয়া মুসলমানদের জন্য তাঁর জীবন এক আদর্শ—

১. ইমামের প্রতি পরিপূর্ণ আনুগত্য:

হযরত আব্বাস (আ.) আমাদের শেখান, ইমামের প্রতি সর্বোচ্চ আনুগত্য প্রদর্শন করতে হবে, এমনকি যদি তার জন্য জীবনও দিতে হয়। আজও শিয়ারা তাঁদের যুগের ইমামের (ইমাম মাহদি আ.জ.) প্রতি একই রকম আনুগত্য প্রদর্শনের জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।

২. সত্যের পথে অবিচল থাকা:

কারবালার শিক্ষা হলো, কোনো অবস্থাতেই অন্যায়ের কাছে মাথা নত করা যাবে না। আমাদের জীবনে যখনই সত্য-মিথ্যার লড়াই আসে, তখন হযরত আব্বাস (আ.)-এর মতো দৃঢ়চিত্ত হতে হবে।

৩. ধৈর্য ও আত্মত্যাগের চেতনা:

শিয়াদের অন্যতম শিক্ষা হলো, ধৈর্য ও ত্যাগের মাধ্যমে ন্যায়ের পথে টিকে থাকা। জীবনের কঠিন সময়েও হযরত আব্বাস (আ.)-এর মতো ধৈর্য ধরে লড়াই করতে হবে।

৪. নিষ্কলুষ চরিত্র ও বিশ্বস্ততা:

হযরত আব্বাস (আ.) ছিলেন একনিষ্ঠ ও বিশ্বস্ত ব্যক্তি। আমাদের প্রতিটি কাজে সততা, বিশ্বস্ততা ও দায়িত্ববোধ বজায় রাখতে হবে।

৫. ইমাম মাহদির (আ.) সহযোদ্ধা হওয়ার প্রস্তুতি:

যদি আমরা সত্যিকার অর্থে হযরত আব্বাস (আ.)-এর অনুসারী হতে চাই, তবে আমাদের ইমাম মাহদির (আ.)-এর সৈনিক হওয়ার প্রস্তুতি নিতে হবে এবং সত্য ও ন্যায়ের পথে লড়াই করতে হবে।

উপসংহার:

হযরত আব্বাস (আ.)-এর জীবন আমাদের জন্য সাহস, আনুগত্য, ধৈর্য ও আত্মত্যাগের এক উজ্জ্বল উদাহরণ। তিনি আমাদের শেখান, কিভাবে সত্যের পথে অবিচল থাকতে হয়, কীভাবে ইমামের প্রতি বিশ্বস্ত হতে হয় এবং কীভাবে ন্যায়বিচারের জন্য জীবন উৎসর্গ করতে হয়।

আজও, যখন আমরা কারবালার শিক্ষা হৃদয়ে ধারণ করি, তখন আমাদের উচিত হযরত আব্বাস (আ.)-এর পথ অনুসরণ করা—আমাদের ইমামের পাশে দাঁড়ানো, অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করা এবং ধৈর্য ও বিশ্বস্ততার মাধ্যমে প্রকৃত মুসলিম হওয়া।

“আসসালামু আলাইকা আইউহাল আব্বাস ইবনে আমিরিল মু’মিনিন।”
("সালাম হোক তোমার প্রতি, হে আব্বাস, হে আমিরুল মু’মিনিন-এর পুত্র!")

লেখক: কবির আলী তরফদার কুম্মি।
তারিখ: ০৩/০২/২০২৫

আপনার কমেন্ট

You are replying to: .
captcha