সোমবার ৩ ফেব্রুয়ারী ২০২৫ - ২১:৫৫

হাওজা নিউজ এজেন্সি রিপোর্ট অনুযায়ী,

ইমাম বাকির (আ.) বলেছেন:
"كان علي بن الحسين (عليه السلام) إذا قال، قال جميع الناس: صدق، وكان أعلم الناس بما نزل في القرآن، فإذا فسر القرآن، أبهر الناس من ذلك."
"যখন আলী ইবনুল হুসাইন (আ.) কিছু বলতেন, তখন সবাই বলত: তিনি সত্য বলেছেন। তিনি ছিলেন কুরআনে অবতীর্ণ জ্ঞানের সর্বাধিক অভিজ্ঞ ব্যক্তি। যখন তিনি কুরআনের ব্যাখ্যা দিতেন, তখন মানুষ বিস্মিত হয়ে যেত।"
সূত্র: বিহারুল আনওয়ার, খণ্ড ৪৬, পৃষ্ঠা ৩০২

ইমাম আলী ইবনুল হুসাইন জয়নুল আবেদীন (আ.) ৩৮ হিজরির ৫ শাবান (৬৫৮ খ্রিষ্টাব্দ) মদিনায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন ইসলামের চতুর্থ ইমাম এবং মহান নেতা।

পিতৃপরিচয়: তাঁর পিতা ছিলেন ইমাম হুসাইন (আ.), যিনি কারবালার মহাবীর শহীদ। আর তাঁর মাতার নাম ছিল শাহরবানু, যিনি পারস্যের সম্রাট ইয়াজদগির্দের কন্যা ছিলেন।

উপাধি: তিনি ইবাদতে অতুলনীয় ছিলেন এবং "সাজ্জাদ" (অধিক সিজদাকারী) ও "সাইয়্যিদুস সাজিদীন" (সিজদাকারীদের নেতা) উপাধিতে পরিচিত ছিলেন। তাঁর জীবন ছিল ধৈর্য, ইবাদত ও মানবতার অনন্য দৃষ্টান্ত।

আমরা সাধারণত ইমাম জয়নুল আবেদীন (আ.)-কে কারবালার পরের অসুস্থ বন্দি হিসেবে জানি। তবে এটি তাঁর জীবনের একটি ছোট অংশ মাত্র। প্রকৃতপক্ষে, তিনি ছিলেন এক মহান মনীষী, সমাজ সংস্কারক, ইবাদতে অনন্য, এবং জ্ঞান ও নৈতিকতার বাতিঘর। তাঁর জীবন আমাদের জন্য বহু শিক্ষা রেখে গেছে, যা আমাদের আত্মগঠন ও সমাজ গঠনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

১. ধৈর্যের শ্রেষ্ঠ উদাহরণ:

কারবালার ঘটনার পর ইমাম (আ.)-এর জীবন ছিল সীমাহীন কষ্ট ও পরীক্ষার সম্মুখীন। বন্দি অবস্থায় থেকেও তিনি কখনো হতোদ্যম হননি, বরং ধৈর্য এবং দৃঢ়তা প্রদর্শন করেছেন। তিনি আমাদের শেখান, বিপদে ধৈর্যই প্রকৃত বিজয়ের চাবিকাঠি।

কারবালার হৃদয়বিদারক ঘটনার পর ইমাম জয়নুল আবেদীন (আ.)-কে অন্য বন্দিদের সঙ্গে শামে (দামেস্ক) নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে উমাইয়া শাসকেরা তাদেরকে রাস্তার মধ্য দিয়ে অপমানজনকভাবে নিয়ে গিয়েছিল, আর সাধারণ জনগণ ভুল তথ্যের কারণে তাঁদের শত্রু মনে করত।
একদিন এক ব্যক্তি ইমাম (আ.)-কে দেখে বিদ্রুপ করে বলতে লাগল, "আল্লাহ তোমাদের ধ্বংস করেছেন! তোমরা তো বিদ্রোহী!"
ইমাম (আ.) ধৈর্য ধরে শান্তভাবে তার দিকে তাকিয়ে বললেন: "হে ব্যক্তি! তুমি কি কুরআন পড়েছ?"
সে বলল: "হ্যাঁ, পড়েছি।"
ইমাম (আ.) জিজ্ঞাসা করলেন: "তুমি কি এই আয়াত পড়েছ?
"বলুন, আমি তোমাদের নিকট এর (রিসালাতের) বিনিময়ে আত্মীয়তার ভালোবাসা ছাড়া অন্য কিছু চাই না।" (সূরা শূরা: ২৩)

সে বলল: "হ্যাঁ, পড়েছি।"
ইমাম (আ.) বললেন: "আমরা সেই আত্মীয়, যাদের ভালোবাসার নির্দেশ আল্লাহ দিয়েছেন।"
লোকটি তখন অনুতপ্ত হয়ে কাঁদতে লাগল এবং ইমামের (আ.) পায়ের কাছে পড়ে ক্ষমা চাইতে লাগল।

এই ঘটনার শিক্ষা:
ইমাম (আ.) প্রচণ্ড কষ্ট ও অপমান সহ্য করেও ধৈর্য হারাননি।
তিনি প্রতিহিংসা নেননি, বরং জ্ঞানের মাধ্যমে মানুষের ভুল ভেঙে দিয়েছেন।
ধৈর্য এবং নৈতিক শক্তিই প্রকৃত বিজয়ের চাবিকাঠি।

২. ইবাদতের পূর্ণতা—'সাজ্জাদ' উপাধির কারণ:

ইমাম (আ.) এত বেশি ইবাদত করতেন যে, তাঁর কপালে সিজদার দাগ পড়ে গিয়েছিল। এজন্য তাঁকে "সাজ্জাদ" বলা হতো। তিনি প্রতিটি দুঃখ ও পরীক্ষাকে ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টিতে রূপান্তরিত করতেন। তাঁর দোয়া ও মুনাজাতগুলো ইসলামী আধ্যাত্মিকতার শ্রেষ্ঠ নমুনা, যা আজও "সাহিফা সাজ্জাদিয়া" নামে সংকলিত আছে।

ইবাদতে অতুলনীয় ইমাম (আ.)—একটি বাস্তব ঘটনা।
একবার ইমাম জয়নুল আবেদীন (আ.) গভীর রাতে নামাজ ও দোয়া করছিলেন। হঠাৎ তাঁর ঘরে আগুন ধরে যায়। সেবকদের কেউ এসে বললেন, “ইমাম! আগুন লেগেছে! ঘর পুড়ে যাচ্ছে!” কিন্তু ইমাম (আ.) তখনও ধ্যানমগ্ন ছিলেন এবং তাঁর ইবাদতে এতটাই নিমগ্ন ছিলেন যে, তিনি কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালেন না।

যখন আগুন নেভানো হলো, তখন কেউ ইমাম (আ.)-কে জিজ্ঞাসা করলেন, “হে নবি-পরিবারের সন্তান! আপনাকে যখন আগুনের কথা বলা হলো, তখন আপনি সাড়া দিলেন না কেন?”

ইমাম (আ.) তখন শান্ত স্বরে বললেন, “এই আগুন আমাকে এতটা ভীত করেনি, যতটা আমি জাহান্নামের আগুন নিয়ে ভাবছিলাম। আমি তখন আল্লাহর সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম, তাঁর ভয়ে এতটাই ব্যস্ত ছিলাম যে, দুনিয়ার আগুন আমাকে বিচলিত করতে পারেনি।”

এই ঘটনা আমাদের শেখায় যে, ইমাম (আ.)-এর ইবাদত ছিল পরিপূর্ণভাবে আল্লাহমুখী এবং তিনি সবকিছুর ঊর্ধ্বে আল্লাহর ভয়কে প্রাধান্য দিতেন। এটি আমাদের জন্য এক মহান শিক্ষা যে, ইবাদত শুধু আনুষ্ঠানিকতা নয়, বরং হৃদয়ের গভীর সংযোগের একটি মাধ্যম।

৩. সমাজ সংস্কারের নীরব বিপ্লব:

যদিও উমাইয়া শাসকদের চাপে তিনি প্রকাশ্যে বক্তৃতা দিতে পারতেন না, তবুও তিনি দোয়ার মাধ্যমে এবং শিক্ষাদান পদ্ধতিতে সমাজে নৈতিকতা, মানবতা ও তাওহিদের শিক্ষা প্রচার করেন।

দাসদের মুক্ত করা: তিনি বহু দাসকে কিনে শিক্ষা দিয়ে স্বাধীন করতেন, যাতে তারা সমাজে আল্লাহর দাস হিসেবে দাওয়াতের কাজ করতে পারে।

ইমাম জয়নুল আবেদীন (আ.) কেবল দাসদের মুক্তই করেননি, বরং তাদের আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতেন। এমনই এক ঘটনা হলো—

একবার ইমাম (আ.)-এর একজন দাস ছিল, যাকে তিনি দীর্ঘদিন শিক্ষা ও আখলাকের দীক্ষা দিয়েছিলেন। একদিন ইমাম (আ.) তাকে মুক্ত করে দিলেন এবং বললেন, "তুমি এখন স্বাধীন, কিন্তু তোমার দায়িত্ব হলো আল্লাহর পথে চলা ও মানুষকে সত্যের দিকে আহ্বান করা।"

এই দাস, যিনি একসময় সমাজের অবহেলিত ছিলেন, ইমামের শিক্ষার আলোয় আলোকিত হয়ে এত বড় পরহেজগার ব্যক্তি হয়ে ওঠেন যে, তিনি মদীনায় ন্যায়পরায়ণ ও জ্ঞানী ব্যক্তিদের একজন হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। পরবর্তীতে তিনি দাওয়াত ও শিক্ষার কাজ চালিয়ে যান এবং বহু মানুষকে ইসলামের প্রকৃত আদর্শ সম্পর্কে শিক্ষা দেন।

এই ঘটনার শিক্ষা:
ইমাম (আ.) দাসদের শুধু মুক্ত করতেন না, বরং তাদের এমনভাবে গড়ে তুলতেন যাতে তারা সমাজের সম্মানিত ও জ্ঞানী ব্যক্তি হয়ে ওঠেন।

তিনি দেখিয়ে দিলেন, সত্যিকারের স্বাধীনতা কেবল শারীরিক মুক্তি নয়, বরং আত্মিক ও জ্ঞানগত উন্নতি।

একজন মানুষ শিক্ষার মাধ্যমে যে কোনো অবস্থান থেকে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতে পারে।

গোপনে সাহায্য করা: মদীনার দরিদ্ররা জানতেন না কে প্রতিদিন রাতে তাদের ঘরে খাদ্য রেখে যায়। ইমাম (আ.)-এর শাহাদাতের পর তাঁর কাঁধের কালো দাগ দেখে সবাই বুঝতে পারে যে তিনিই এতদিন তাদের সাহায্য করে আসছিলেন।

ইমাম জয়নুল আবেদীন (আ.) ছিলেন দানের প্রতীক। তিনি রাতের আঁধারে মদিনার দরিদ্র পরিবারগুলোর কাছে খাদ্য ও প্রয়োজনীয় সামগ্রী পৌঁছে দিতেন।

ইবনে সা'দ তার "ত্বাবাকাতুল কুবরা" গ্রন্থে লিখেছেন:
"তিনি প্রতি রাতে একটি বস্তা ভর্তি রুটি ও খাদ্যসামগ্রী নিজের পিঠে বহন করে মদিনার দরিদ্রদের ঘরে পৌঁছে দিতেন। যখন তিনি শাহাদাত বরণ করলেন, তখন মদিনার প্রায় ৪,০০০ পরিবার বুঝতে পারল যে, এতদিন যিনি তাদের গোপনে সাহায্য করতেন, তিনি ছিলেন আলী ইবনুল হুসাইন (আ.)।"
(ত্বাবাকাত ইবনে সা'দ, খণ্ড ৫, পৃষ্ঠা ১৬২)

এই ঘটনার শিক্ষা:
ইমাম (আ.) দেখিয়েছেন, সত্যিকারের নেতৃত্ব মানে শুধু শাসন করা নয়, বরং মানুষের দায়িত্ব নেওয়া।
গোপন দান ও নিঃস্বার্থ সেবাই প্রকৃত ইখলাস (আল্লাহর জন্য কাজ করা)।
সমাজের দুর্বল শ্রেণির পাশে দাঁড়ানো ইসলামের অন্যতম শিক্ষা।

৪. জ্ঞানের শ্রেষ্ঠ খনি:

ইমাম (আ.) শিক্ষা ও জ্ঞানের মাধ্যমে সমাজকে বদলাতে চেয়েছিলেন। তাঁর শিক্ষার কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক:

নৈতিকতা ও আখলাক: তিনি মানুষকে শিখিয়েছেন কীভাবে উত্তম চরিত্র গঠন করতে হয়।

আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক: তাঁর দোয়াগুলো মানুষকে তাওহিদের গভীরতা বুঝতে সাহায্য করে।

অধিকার ও দায়িত্ব: তাঁর বিখ্যাত "রিসালাতুল হুকুক" (অধিকার পত্র) মানবাধিকারের একটি শ্রেষ্ঠ দলিল, যেখানে বাবা-মা, সন্তান, শিক্ষক, শাসক, জনগণ—সবার অধিকার ও দায়িত্ব বর্ণনা করা হয়েছে।

৫. বীরত্ব—মজলুম হয়েও ন্যায় প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম:

যদিও তিনি বাহ্যিকভাবে রাজনৈতিক ক্ষমতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেননি, কিন্তু জ্ঞান ও নৈতিকতার মাধ্যমে উমাইয়া শাসকদের ভিত্তিকে দুর্বল করেছেন। কারবালার পর ইয়াজিদের দরবারে সাহসিকতার সঙ্গে সত্য তুলে ধরে তিনি উমাইয়া শাসনের মুখোশ উন্মোচন করেছিলেন। ইমাম(আঃ) এর খুতবার কিছু অংশ এখানে তুলে ধরা হলো।

ইমাম (আ.) বললেন:
"হে মানুষ! যে আমাকে চেনে, সে তো চেনে; আর যে আমাকে চেনে না, সে জেনে রাখো—আমি মুহাম্মাদ (সা.)-এর পুত্র। আমি মক্কা ও মদিনার সন্তান। আমি জমজম ও সাফার সন্তান। আমি সেই ব্যক্তির সন্তান, যাকে আল্লাহ রাতের সফরে মিরাজে নিয়ে গিয়েছিলেন। আমি সেই ব্যক্তির সন্তান, যিনি বদর ও হুনাইনে যুদ্ধ করেছেন, আর যারা কাফের ছিল, তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। আমি সেই ব্যক্তির সন্তান, যার ওপর ফেরেশতা কেঁদেছে, যার জন্য সূর্যগ্রহণ হয়েছে, যার জন্য আকাশ, জমিন এবং পাহাড় কেঁদেছে..."

(সূত্র: আল-লুহুফ, সাইয়্যিদ ইবনে তাওস)

এই বক্তৃতার পর উপস্থিত জনতা চুপ হয়ে যায়। ইয়াজিদের সভায় থাকা অনেকে তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহী মনোভাব পোষণ করতে শুরু করে। এভাবে ইমাম (আ.)-এর সত্যের বাণী উমাইয়া শাসনের ভিত্তিকে দুর্বল করে দেয়, এবং তাদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে মানুষের মনে ঘৃণা সৃষ্টি করে।

উপসংহার: 
ইমাম জয়নুল আবেদীন (আ.)-এর জীবন থেকে আমাদের শিক্ষা:

1- ধৈর্য ও সবরের মাধ্যমে বিপদ মোকাবিলা করা।
2- নীরবে সমাজ সংস্কারের জন্য কাজ করা।
3- আখলাক ও ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করা।
4- মানবতার সেবা করা।
5- জ্ঞান ও শিক্ষা দ্বারা সত্যের প্রচার করা।

লেখক: কবির আলী তরফদার কুম্মি।
তারিখ: ০৩/০২/২০২৫

আপনার কমেন্ট

You are replying to: .
captcha