সোমবার ১৪ এপ্রিল ২০২৫ - ১২:৫৫
হজ্ব-জিয়ারত নাকি ইনফাক? কোনটাকে অগ্রাধিকার দেয়া উচিত?

জিয়ারত এবং অন্যকে সাহায্য বা দানের মধ্যে কোনটি অগ্রাধিকার পাবে? এই প্রশ্নের উত্তর আধ্যাত্মিক মূল্যবোধ ও সামাজিক দায়িত্বের মধ্যে একটি সূক্ষ্ম ভারসাম্য নির্দেশ করে। যদিও ধর্মে জিয়ারত ভ্রমণের বিশেষ স্থান রয়েছে, তবুও সমাজের অত্যাবশ্যকীয় প্রয়োজনগুলিকে উপেক্ষা করা উচিত নয়।

হাওজা নিউজ এজেন্সি: আজকের বিশ্বে ইসলামে আধ্যাত্মিক ও সামাজিক অগ্রাধিকার নিয়ে নৈতিক প্রশ্ন ও সংশয় মুসলমানদের প্রধান চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভালো ইচ্ছা ও দায়িত্ববোধ নিয়ে মানুষ ব্যক্তিগত ইবাদত ও সমাজসেবার মধ্যে ভারসাম্য খুঁজছে। এই প্রসঙ্গে নৈতিক সংশয় বিষয়ক বিশেষজ্ঞ হুজ্জাতুল ইসলাম রেজা পারচে বাফ-  হাওজা নিউজ এজেন্সির সাথে আলোচনায় এই প্রশ্নগুলির বিশ্লেষণ ও উত্তর প্রদান করেছেন। 

প্রশ্ন ও সংশয়: জিয়ারতজনীত ভ্রমণকে কি অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যায়? যেহেতু অর্থ ব্যয় করার একটি উদ্দেশ্য হল সওয়াব অর্জন ও অন্যের সাহায্য করা, তাহলে কেন মক্কা বা কারবালার মতো পবিত্র স্থানে ভ্রমণের খরচ করা উচিত, যখন এই অর্থ কিছু মানুষের পকেটে চলে যায়? এই অর্থের বদলে হাসপাতাল, স্কুল নির্মাণ বা প্রয়োজনমাফিক মানুষের সাহায্যে ব্যয় করা কি ভালো নয়? 

জিয়ারত ভ্রমণের জন্য অর্থ ব্যয় করে অন্য সৎকর্মকে পিছনে রাখা কি ঠিক? 

হুজ্জাতুল ইসলাম পারচে বাফের উত্তর: এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য আমাদের জিয়ারত ভ্রমণের আধ্যাত্মিক ও বিশ্বাসগত দিক এবং সামাজিক ও মানবিক দায়িত্ব উভয়ই বিবেচনা করতে হবে। 

ধর্মীয় দৃষ্টিতে জিয়ারত ভ্রমণ
ইসলামে মক্কা (হজ ও উমরাহ) এবং কারবালা (ইমাম হুসাইনের (আ.) জিয়ারত) এর মতো পবিত্র স্থানগুলির বিশেষ মর্যাদা রয়েছে। হাদিসে এই জিয়ারতের ফজিলত ও সওয়াবের উপর জোর দেওয়া হয়েছে। জিয়ারত কেবল একটি ইবাদতই নয়, বরং এটি নফসের পরিশুদ্ধি, ঈমান বৃদ্ধি, আল্লাহ ও তাঁর অলিদের সাথে সম্পর্ক স্থাপন এবং জ্ঞান ও দৃষ্টিভঙ্গি অর্জনের মাধ্যম। 

ঈমানের উপর জিয়ারতের প্রভাব
হাদিসে এসেছে যে, ইমামদের (আ.) জিয়ারত ঈমানকে পুনর্জীবিত করে এবং গুনাহ মাফ করে। যেমন, ইমাম রেজা (আ.) বলেছেন,
مَنْ زَارَنِی عَلَی بُعْدِ دَارِی أَتَیْتُهُ یَوْمَ الْقِیَامَةِ فِی ثَلَاثِ مَوَاطِنَ حَتَّی أُخَلِّصَهُ مِنْ أَهْوَالِهَا: إِذَا تَطَایَرَتِ الْکُتُبُ یَمِیناً وَ شِمَالًا وَ عِنْدَ الْمِیزَانِ وَ عِنْدَ الصِّرَاطِ
“যে ব্যক্তি দূরত্ব সত্ত্বেও আমাকে জিয়ারত করবে, কিয়ামতের দিন আমি তিন স্থানে তাকে উদ্ধার করব: যখন আমলনামা ডান ও বামে বিতরণ করা হবে, মীযানের সময় এবং সিরাতের সময়।” (মান লা ইয়াহদুরহুল ফকিহ, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ৫৮৫) 

জিয়ারত- মহব্বতের প্রকাশ: জিয়ারত হল আহলে বাইত (আ.) এর প্রতি মহব্বত ও ভালোবাসার প্রকাশ, যা কুরআনে উল্লেখ করা হয়েছে: 

قُلْ لا أَسْئَلُکُمْ عَلَیْهِ أَجْراً إِلَّا الْمَوَدَّةَ فِی الْقُرْبی
বলুন, আমি এ (রিসালাতের) জন্য তোমাদের কাছে কোনো প্রতিদান চাই না, শুধু আত্মীয়দের প্রতি ভালোবাসা চাই। (সূরা শুরা, আয়াত ২৩) 

জিয়ারতের সামাজিক প্রভাব
জিয়ারত ভ্রমণের ব্যক্তিগত প্রভাব ছাড়াও সামাজিক ইতিবাচক প্রভাব রয়েছে। এটি মুসলমানদের মধ্যে ঐক্য ও সম্প্রীতি গড়ে তোলে, ইসলামী সংস্কৃতি শক্তিশালী করে এবং নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধ প্রচার করে। 

খরচের অগ্রাধিকার নির্ধারণ
তবে, ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা যা মানুষের জীবনের সব দিক বিবেচনা করে। জিয়ারত ও ইবাদতের পাশাপাশি সামাজিক ও মানবিক দায়িত্বের উপরও ব্যাপক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। 

গরীব-দুস্থদের সাহায্য করা, হাসপাতাল ও স্কুল নির্মাণ এবং সমাজের সমস্যা সমাধান ইসলামে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব!

ইনফাক ও সাহায্য সংক্রান্ত আয়াত ও হাদিস
কুরআন ও হাদিসে গরীবদের সাহায্য করা ও ইনফাককে সর্বোত্তম আমল হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। যেমন, আল্লাহ কুরআনে বলেন: 
مَثَلُ الَّذِینَ یُنْفِقُونَ أَمْوالَهُمْ فِی سَبِیلِ اللَّهِ کَمَثَلِ حَبَّةٍ أَنْبَتَتْ سَبْعَ سَنَابِلَ فِی کُلِّ سُنْبُلَةٍ مِائَةُ حَبَّةٍ وَ اللَّهُ یُضاعِفُ لِمَنْ یَشاءُ وَ اللَّهُ واسِعٌ عَلِیمٌ

“যারা আল্লাহর পথে নিজেদের সম্পদ ব্যয় করে, তাদের উদাহরণ একটি বীজের মতো, যা থেকে সাতটি শীষ জন্মায়, প্রতিটি শীষে একশত দানা থাকে। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা বহুগুণ বৃদ্ধি করে দেন।” (সূরা বাকারা, আয়াত ২৬১) 

অত্যাবশ্যকীয় প্রয়োজনের অগ্রাধিকার
সমাজে যখন দারিদ্র্য, রোগ ও অশিক্ষার মতো অত্যাবশ্যকীয় প্রয়োজন থাকে, তখন সেগুলো সমাধান করা অগ্রাধিকার পাবে। অর্থাৎ, যদি কারও আর্থিক সীমাবদ্ধতা থাকে, তাহলে তার উচিত প্রথমে এই প্রয়োজনগুলো পূরণ করা, তারপর জিয়ারত করা। 

জিয়ারত ও গরীব-দুস্থদের সাহায্যের মধ্যে সম্পর্ক
জিয়ারত ও গরীবদের সাহায্যের মধ্যে কোনো বিরোধ নেই। উভয়ই সৎকর্ম এবং একে অপরের পরিপূরক। একজন মুসলমান জিয়ারত ও গরীব-দুস্থদের সাহায্য—উভয়ই করতে পারে। গুরুত্বপূর্ণ হল এখানে ভারসাম্য বজায় রাখা এবং নিজের অবস্থান ও সামর্থ্য অনুযায়ী সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া। 

জিয়ারত না গরীব-দুস্থদের সাহায্য—কখন অগ্রাধিকার নির্ধারণ করতে হবে?
জিয়ারত ও গরীবদের সাহায্যের মধ্যে অগ্রাধিকার নির্ভর করে বিভিন্ন অবস্থার উপর: 

১. আর্থিক সামর্থ্য: যদি কারও আর্থিক সীমাবদ্ধতা থাকে, তাহলে সমাজের অত্যাবশ্যকীয় প্রয়োজন পূরণ অগ্রাধিকার পাবে। 

২. সমাজের প্রয়োজন: যদি সমাজে ব্যাপক দারিদ্র্য ও রোগ থাকে, তাহলে গরীবদের সাহায্য করা অগ্রাধিকার পাবে। 

৩. জিয়ারতের প্রভাব: যদি জিয়ারত কারও আত্মা ও মনে গভীর প্রভাব ফেলে এবং তার জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন আনে, তাহলে তা অগ্রাধিকার পেতে পারে। 

৪. নিয়ত: যে কোনো কাজে নিয়ত গুরুত্বপূর্ণ। যদি কেউ খালেস নিয়তে জিয়ারত করে বা গরীবদের সাহায্য করে, উভয়ই মূল্যবান ও আল্লাহর দরবারে গ্রহণযোগ্য। 

Tags

আপনার কমেন্ট

You are replying to: .
captcha