সোমবার ৭ জুলাই ২০২৫ - ১৩:২৪
মহররমের একাদশ তারিখের ঘটনাবলি

মানব ইতিহাসের সূচনা ঘটে হযরত আদম (আ.)-এর ইন্তেকালের মাধ্যমে—তিনি তাঁর পুত্র শীস (আ.)-এর কাছে হিদায়তের ঐশী আমানত হস্তান্তর করে, বিশেষ মর্যাদা ও আনুষ্ঠানিকতার সঙ্গে দাফন হন। ইতিহাসের আরেক সন্ধিক্ষণে, কারবালার মর্মান্তিক ঘটনার পর আহলুল বাইত (আ.)-এর এক বিষাদপূর্ণ ও লাঞ্ছনাময় সফর শুরু হয়, যা মাকতাল থেকে কুফা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল এবং নারীদের কান্না ও শিশুদের বিলাপের মধ্যে সম্পন্ন হয়।

হাওজা নিউজ এজেন্সি: এই নিবন্ধে হযরত আদম (আ.)-এর ইন্তেকাল থেকে শুরু করে কারবালার পরে আহলুল বাইতের (আ.) বন্দিত্বের দুঃখময় সফর এবং আল্লামা হিল্লি (রহ.)-এর মতো শিয়া আলেমদের অবদান তুলে ধরা হয়েছে, যাঁরা বিভিন্ন যুগে আহলুল বাইতের শিক্ষা ও মাযহাব প্রচারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন।

১. হযরত আদম (আ.)-এর ইন্তেকাল
আদম (আ.)-এর পুত্র শীস (আ.) প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর আল্লাহর নির্দেশে আদম (আ.) তাঁকে নিজের উত্তরসূরি নিযুক্ত করেন এবং নবুয়তের গোপন বিষয়সমূহ তাঁর হাতে অর্পণ করেন। তিনি বলেন, আমাকে গোসল দেবে, কাফন পরাবে, জানাজা পড়াবে এবং আমার দেহ একটি কফিনে রাখবে। মৃত্যুর সময় আমি যা কিছু তোমাকে শিক্ষা দিয়েছি, তা তোমার উত্তম সন্তানদের একজনকে অর্পণ করবে।

বিভিন্ন বর্ণনায় এসেছে, আদম (আ.) ৯৩০ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। শীস (আ.) তাঁকে আবু কুবাইস পর্বতে দাফন করেন। পরবর্তীতে হযরত নূহ (আ.) তাঁর কফিনটি প্লাবনের সময় নৌকায় তুলে কুফায় নিয়ে আসেন এবং তাঁকে নাজাফে পুনরায় দাফন করেন। হযরত আদম (আ.) ও নূহ (আ.)-এর কবর হযরত আমিরুল মু’মিনিন আলী (আ.)-এর কবরের নিকটেই অবস্থিত।

হাওয়া (আ.)-ও এক বছর পর অসুস্থ হয়ে ১৫ দিন রোগভোগের পর ইন্তেকাল করেন এবং হযরত আদম (আ.)-এর পাশেই দাফন হন।

হাবিল নিহত হওয়ার পর হযরত আদম (আ.) গভীরভাবে শোকাহত হন এবং সিরিয়াক ভাষায় তাঁর জন্য শোকগাথা রচনা করেন। মৃত্যুর আগে শীস (আ.)-কে তা সন্তানদের শেখাতে বলেন, যেন তারা উপদেশ গ্রহণ করে। এই শোকগাথা পরবর্তীতে ইয়ারব ইবনে কাহতান-এর মাধ্যমে আরবি ভাষায় ছন্দবদ্ধ হয়:
تغيرت البلاد ومن عليها
ووجه الأرض مغيّر قبيح
تغير كل ذي طعم ولون
قلّ بشاشة الوجه الصبيح

পরিবর্তন হয়েছে ভূমি ও তার অধিবাসীরা,
পৃথিবীর চেহারা হয়েছে বিকৃত ও মলিন।
প্রতিটি স্বাদ ও রঙ হারিয়ে গেছে,
উজ্জ্বল মুখশ্রীর হাসিও ফিকে হয়ে গেছে।
 

২. কারবালা থেকে আহলুল বাইতের (আ.) কুফার উদ্দেশ্যে যাত্রা (৬১ হিজরি)
অমর ইবনে সাদ (লা.) একাদশ মহররম রাত থেকে দুপুর পর্যন্ত কারবালায় অবস্থান করেন। তিনি তাঁর সেনাদের জানাজা পড়ে দাফন করেন। তারপর আদেশ দেন, রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর পরিবারবর্গকে উটের পিঠে বন্দির মতো বসিয়ে নিয়ে যাওয়া হোক এবং ইমাম আলী ইবনে হুসাইন (আ.)-এর গলায় লোহার বেড়ি পরানো হয়। তাঁদেরকে কারবালার ময়দানে শহীদদের দেহাবশেষের পাশ দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়।

নারীরা যখন তাঁদের আপনজনদের নিথর দেহ দেখেন, তখন শোকভারে কেঁদে ওঠেন, মুখে আঘাত করেন এবং কান্নায় উট থেকে ঝাঁপিয়ে পড়েন।

জনাবা জয়নাব (সা.আ.) যখন ভাই ইমাম হুসাইন (আ.)-এর পবিত্র দেহ দেখেন, তখন বলেন,
السلام علیک یا ذبیحا من القفا
হে গলা থেকে জবেহ হওয়া শহীদ, আপনাকে সালাম।

তিনি দেহটি বুকে জড়িয়ে ধরে বলেন, “হে রাসুলের সন্তান! হে যাহরার নয়নমণি! আমার জীবন তোমার জন্য উৎসর্গ হোক।”

এরপর ব্যথাভারাক্রান্ত হৃদয়ে চিৎকার করে বলেন, “হে আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মাদ (সা.)! ফেরেশতারা আপনাকে সালাম জানাচ্ছে। দেখুন, আপনার হুসাইন রক্তাক্ত অবস্থায়, দেহ খণ্ডবিখণ্ড হয়ে পড়ে আছে। আর আপনার কন্যারা বন্দি অবস্থায় আছে।”

তিনি বিলাপ করে বলেন, “আমার পিতা কোরবান সেই শহীদের জন্য, যার ক্ষত আর নিরাময় পায় না;
যিনি দুঃখভারাক্রান্ত হয়ে দুনিয়া ছেড়েছেন; যিনি পিপাসার্ত অবস্থায় শাহাদত বরণ করেছেন।”

অপর একটি বর্ণনায় এসেছে, জনাবা জয়নব কুবরা (সা.আ.) যখন ভাই ইমামের বিদীর্ণ হৃদয় ও কাটা গলা লক্ষ্য করেন, তখন ব্যথাভারাক্রান্ত হৃদয়ে আহাজারি করে বলেন, “হে ভাই! যদি এই তীর আমার হৃদয়ে বিঁধতো! যদি তোমার পরিবর্তে আমাকেই জবেহ করা হতো!”

সাকিনা (সা.) পিতার দেহ জড়িয়ে ধরে বিলাপ করেন, “হে পিতা! আপনার শাহাদাতে শত্রুরা আনন্দিত হয়েছে। বনু উমাইয়া আমাকে এত অল্প বয়সে এতিম করেছে। এখন রাত হলে, আমাকে কে রক্ষা করবে?
আমার কানের দুল কেড়ে নিয়েছে, চাদরও ছিনিয়ে নিয়েছে।”

আল্লামা কাফ’আমি (রহ.) বর্ণনা করেন, সাকিনা (সা.) বলেন, “আমি যখন পিতার দেহকে বুকে জড়িয়ে ধরলাম, তখন অজ্ঞান হয়ে পড়ি।
তখন শুনতে পাই, পিতা বলছেন,
يا شيعتي مهما شربتم ماء عذب فاذكروني
أو سمعتم بغريب أو شهيد فاندبونی
হে আমার শিয়া সম্প্রদায়! যখনই মিষ্টি পানি পান করো, আমাকে স্মরণ করো। যখন কোনো শহীদ বা নির্জন মুসাফিরের কথা শুনো, আমার জন্য আহাজারি করো।”

৩. আল্লামা হিল্লি (রহ.)-এর ইন্তেকাল
আয়াতুল্লাহ আবু মনসুর হাসান ইবনে ইউসুফ হিল্লি, যিনি “আল্লামা হিল্লি” নামে প্রসিদ্ধ, ৭২৬ হিজরিতে হিল্লায় ইন্তেকাল করেন এবং তাঁকে নাজাফে দাফন করা হয়।

তিনি ছিলেন শিয়া ইমামিয়ার শীর্ষস্থানীয় আলেম; যুক্তি ও বর্ণনার উভয় শাখায় পারদর্শী, মুলহিদদের কুফর রোধকারী এবং ‘আল্লামা’ উপাধির যথার্থ অধিকারী। তিনি প্রায় ১২০টি গ্রন্থ রচনা করেছেন—যেগুলো শীর্ষস্থানীয় ইসলামি গ্রন্থাগারসমূহে স্থান পেয়েছে। তাঁর বিখ্যাত কিতাবগুলোর মধ্যে রয়েছে:
تبصرة المتعلمین, ألفين, غاية الأصول, تذکرة الفقهاء, کشف المراد প্রভৃতি।

তিনি খাজা নাসিরুদ্দিন তুসি, কাতিবী কাযভিনি ও অন্যান্য জ্ঞানী পণ্ডিতদের থেকে শিক্ষা লাভ করেন। এমনকি শৈশবেই তিনি ইজতেহাদের মর্যাদা অর্জন করেন।

তাঁর বিখ্যাত ঘটনা হলো: শিয়া মাযহাবে মোঙ্গল সম্রাট ওলজাইতু (মুহাম্মদ খোদাবন্দ)-এর দীক্ষিত হওয়া।

একবার রাজা স্ত্রীর প্রতি রাগ করে বলেন, “তোমাকে তিন তালাক।” পরে অনুতপ্ত হয়ে সুন্নি আলেমদের পরামর্শ নেন। তাঁরা বলেন, তালাক কার্যকর হয়েছে, মুতাহাল্লিল ছাড়া উপায় নেই।

তখন এক মন্ত্রী বলেন, “হিল্লায় এক আলেম আছেন, যিনি বলেন এই তালাক বাতিল।” আলেমদের বিরোধিতা সত্ত্বেও রাজা আল্লামা হিল্লিকে ডেকে পাঠান।

আল্লামা হিল্লি, জ্ঞানে ও যুক্তিতে চার মাযহাবের আলেমদের পরাজিত করেন এবং প্রমাণ করেন, প্রকৃত ইসলামি ফিকাহ আহলুল বাইতের ইমামদের মাধ্যমেই প্রচারিত হয়েছে।

শেষমেশ রাজা শিয়া মাযহাব গ্রহণ করেন, বারো ইমামের (আ.) নামে খুতবা ও মুদ্রা জারি করেন এবং সমগ্র রাজ্যে তা প্রবর্তন করেন।

উৎস: হাওয়াদিসুল আয়াম, সাইয়্যেদ মাহদি মারআশি নাজাফি

আপনার কমেন্ট

You are replying to: .
captcha