হাওজা নিউজ এজেন্সি রিপোর্ট অনুযায়ী, ইমাম জাফর সাদিক (আঃ)-এর শাহাদাত: হেদায়েতের দীপ্ত প্রদীপের নিভে যাওয়া
বংশ পরিচয় ও জন্ম:
ইমাম জাফর সাদিক (আঃ) ৮৩ হিজরিতে (৭০২ খ্রিষ্টাব্দে) পবিত্র মদীনায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন ইমাম মুহাম্মাদ বাকির (আঃ)-এর পুত্র এবং তাঁর মাতার নাম ছিল উম্মে ফারওয়া। তাঁর পিতামহ ইমাম আলী ইবনে হুসাইন (আঃ) এবং পরদাদার নাম ইমাম হুসাইন (আঃ)। তিনি নবীজী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর সরাসরি ষষ্ঠ উত্তরসূরি।
ইমামত ও নেতৃত্ব:
ইমাম জাফর সাদিক (আঃ) ১১৪ হিজরিতে পঞ্চম ইমাম ইমাম বাকির (আঃ)-এর শাহাদাতের পর ইমামত লাভ করেন এবং ১৪৮ হিজরি পর্যন্ত প্রায় ৩৪ বছর উম্মাহর হেদায়েতের দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর ইমামত ছিল ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ সময়, যখন উমাইয়া ও আব্বাসীয়দের মধ্যকার ক্ষমতার পালাবদল চলছিল। এই রাজনৈতিক অস্থিরতার মাঝে তিনি ধর্মীয় শিক্ষা প্রসারে নিজেকে উৎসর্গ করেন।
ব্যক্তিগত জীবন ও চরিত্র:
ইমাম (আঃ)-এর ব্যক্তিত্ব ছিল বিনয়, ধৈর্য, শুদ্ধতা এবং পূর্ণ মানবিকতা ও আধ্যাত্মিকতার প্রতীক। তিনি ছিলেন অত্যন্ত দানশীল ও সদয়, তাঁর দরজায় কোনো অভাবী ফেরত যেত না। তিনি সর্বদা নম্রতা ও সহনশীলতার মাধ্যমে মানুষকে ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা দিতেন।
তিনি বলতেন:
“তিনটি জিনিস যার মধ্যে থাকবে, সে প্রকৃত মু’মিন—যখন রাগ করবে, তখন সত্য ছাড়বে না; যখন সন্তুষ্ট হবে, তখন অন্যায়ে সহায়তা করবে না; যখন ক্ষমতা পাবে, তখন অন্যায় করবে না।”
— (আল-কাফি)
কওমের খিদমত ও দাওয়াহ:
ইমাম জাফর সাদিক (আঃ) ইসলামের বিভিন্ন শাখায় জ্ঞানের দরজা খুলে দেন। তিনি প্রায় চার হাজারের অধিক ছাত্রদের শিক্ষা দেন, যার মধ্যে ইমাম আবু হানিফা ও ইমাম মালিকের মত উল্লেখযোগ্য ফকীহগণও ছিলেন। তিনি শুধু ফিকহ নয়, বরং তাফসীর, হাদীস, দর্শন, বিজ্ঞান, রসায়ন, জ্যোতির্বিদ্যা, চিকিৎসা, ইত্যাদিতেও অবদান রাখেন।
তিনি বলতেন:
“জ্ঞান হচ্ছে আলো, এবং আল্লাহ যার অন্তরকে আলোকিত করতে চান তাকেই সেই আলো দান করেন।”
— (বিহারুল আনোয়ার)
শিক্ষার প্রসারে অবদান:
তাঁর হাতে গড়ে উঠেছিল একটি জ্ঞানের বিপ্লব। তিনি এমন একটি দারস (শিক্ষা কেন্দ্র) প্রতিষ্ঠা করেন, যা বিভিন্ন ধর্ম ও দর্শনের মানুষের জ্ঞানের তৃষ্ণা মেটাত। তাঁর শিক্ষার ভিত্তি ছিল কুরআন, সহীহ হাদীস, এবং তাওহিদের গভীরতা। তাঁর ছাত্ররা ইসলামি চিন্তাধারার বিভিন্ন দিককে ব্যাখ্যা ও প্রতিষ্ঠা করে একটি জ্ঞানের জ্যোতির্ময় সভ্যতার ভিত্তি গড়ে তোলে।
শাহাদাত:
২৫ শাওয়াল, ১৪৮ হিজরি (৭৬৫ খ্রিষ্টাব্দে) আব্বাসি খলিফা মানসুরের আদেশে তাঁকে বিষ প্রয়োগ করে শহীদ করা হয়। তাঁর শাহাদাত ছিল ইসলামের জ্ঞান ও হেদায়েতের এক উজ্জ্বল দীপ্ত প্রদীপের নিভে যাওয়া। তাঁকে মদীনার বাকি গোরস্থানে দাফন করা হয়।আজও তাঁর পবিত্র রওযা সেখানে অবস্থিত, যদিও বর্তমানে তা ধ্বংসপ্রাপ্ত অবস্থায় রয়েছে।
অবশ্যই, ইমাম জাফর সাদিক (আঃ)-এর শাহাদাতের ঘটনাটি অত্যন্ত মর্মান্তিক এবং ইতিহাসের এক গোপন ব্যথাবোধ। এখানে তাঁর শাহাদাতের বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো:
রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট:
ইমাম জাফর সাদিক (আঃ) এমন এক যুগে ইমামত করেছেন, যখন উমাইয়া খিলাফত শেষের দিকে এবং আব্বাসীয় খিলাফতের সূচনা। আব্বাসীয়রা প্রথমে আহলুল বায়ত (আঃ)-এর নাম ব্যবহার করে জনগণের সহানুভূতি আদায় করে, কিন্তু ক্ষমতায় আসার পর তারাই সবচেয়ে বেশি অত্যাচার করে আহলুল বায়তের উপর।
বিশেষ করে খলিফা আবু জাফর মানসুর ছিলেন ইমামের অন্যতম শত্রু। তিনি ইমামের জনপ্রিয়তা ও জ্ঞানের প্রভাব দেখে ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়েছিলেন। মানুষ দলে দলে ইমামের দরবারে আসতো—জ্ঞান অর্জনের জন্য, বিচার চাইতে, এমনকি দাওয়াহ গ্রহণের জন্যও।
কার দ্বারা শহীদ হন ও কিভাবে:
খলিফা আবু জাফর মানসুর-এর আদেশে ইমাম জাফর সাদিক (আঃ)-কে বিষ প্রয়োগে শহীদ করা হয়। এটি সরাসরি কোনো যুদ্ধ বা প্রকাশ্য হত্যা ছিল না, বরং অত্যন্ত নিরব, পরিকল্পিত ও কুটিল হত্যাকাণ্ড। তাঁকে একাধিকবার ডেকে এনে কারাবন্দি করা হয় এবং অত্যন্ত তীব্র নজরদারির মধ্যে রাখা হতো।
একবার তাঁকে মানসুরের রাজপ্রাসাদে ডেকে এনে খাদ্যে বা পানীয়তে বিষ মিশিয়ে খাওয়ানো হয় বলে অধিকাংশ বর্ণনায় উল্লেখ আছে। বিষক্রিয়ায় তিনি দীর্ঘ সময় ধরে ব্যথা ও যন্ত্রণায় ভুগেন। তাঁর দেহ ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ে, তবুও তিনি ধৈর্য, সবর ও আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল নিয়ে ছিলেন।
কেনো শহীদ করা হয়:
ইমামকে শহীদ করার পেছনে মূল কারণ ছিল—
1. আহলুল বায়তের প্রতি জনগণের ভালোবাসা: মানুষ ইমাম জাফর সাদিক (আঃ)-কে প্রকৃত নেতা হিসেবে মানতো। তাঁর কথা ও ফতোয়া মানুষ সম্মান করতো। এই ভালোবাসা ও গ্রহণযোগ্যতা খলিফার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়।
2. ইসলামের প্রকৃত ব্যাখ্যার প্রসার: ইমাম এমন এক ইসলাম প্রচার করছিলেন যা ছিল অত্যন্ত মানবিক, যুক্তিনির্ভর ও বিশুদ্ধ। খলিফাদের স্বৈরাচারী ইসলামিক শাসনের সাথে এটা সাংঘর্ষিক ছিল।
3. রাজনৈতিক শঙ্কা: মানসুর ভয় পেয়েছিল যে ইমামের জনপ্রিয়তা ক্রমশ তাঁর বিরুদ্ধে রাজনৈতিক আন্দোলনে রূপ নিতে পারে, যদিও ইমাম কখনো রাজনৈতিক বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেননি।
ইমামকে কীভাবে কষ্ট দেওয়া হয়:
১. একাধিকবার কারাবন্দি: তাঁকে রাজপ্রাসাদে এনে অনেক সময় জেলে রাখা হতো।
২. গোপন নজরদারি: তাঁর প্রতি প্রতিটি কথা, কাজ ও সাক্ষাতকারের ওপর নজর রাখা হতো।
৩. শিষ্যদের নির্যাতন: তাঁর অনেক ছাত্রকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ, নির্যাতন ও হত্যা করা হয়।
৪. অর্থনৈতিক চাপে রাখা: ইমামের আর্থিক সম্পদ নিয়ন্ত্রণ করে দাওয়াহ কাজকে বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা চালানো হতো।
শেষ সময় ও ওসিয়্যত:
শাহাদাতের আগের দিন ইমাম (আঃ) তাঁর পরিবার ও ঘনিষ্ঠদের ডেকে আনেন এবং তাঁদেরকে ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা ও ইমান ধরে রাখার নির্দেশ দেন। তাঁর বিখ্যাত ওসিয়্যতের মধ্যে একটি ছিল:
> "আমাদের শাফা'আত তার জন্য নয়, যে নামাজকে হালকা মনে করে।"
— (বিহারুল আনোয়ার)
তাঁর মৃত্যুর পর মানসুর নির্দেশ দেয়, যাতে কেউ ইমামের উত্তরসূরি ঘোষণা না করে, যাতে ইমামতের ধারা ছিন্ন হয়ে যায়। এমনকি তিনি ইমামের পরিবারের ওপর নজরদারি চালান।
আমাদের জন্য শিক্ষা:
ইমাম জাফর সাদিক (আঃ)-এর জীবন আমাদের শেখায়-
১. জ্ঞান চর্চা করা ঈমানের অংশ।
২. দীন ও দুনিয়ার সমন্বয় করাই প্রকৃত ইসলাম।
৩. শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান, নম্রতা ও সহানুভূতির মাধ্যমে দাওয়াহ করতে হয়।
৪. কঠিন পরিস্থিতিতেও সত্য ও ন্যায়ের পথে অটল থাকা ঈমানের পরিচায়ক।
ইমাম বলেন:
“তোমাদের মধ্যে যার চরিত্র উত্তম, সে-ই আমার সবচেয়ে প্রিয় এবং কিয়ামতের দিন আমার সবচেয়ে কাছে থাকবে।”
— (আল-কাফি)
উপসংহার:
ইমাম জাফর সাদিক (আঃ)-এর জীবন ও শাহাদাত আমাদের জন্য একটি আলোকবর্তিকা। তিনি যেমন জ্ঞানের বিস্তার ঘটিয়েছেন, তেমনি দ্বীনের বিশুদ্ধ রূপ মানুষকে পৌঁছে দেওয়ার জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন। তাঁর আদর্শ অনুসরণ করলেই আমরা দুনিয়া ও আখিরাতে সফলতা অর্জন করতে পারি।
লেখক: কবির আলী তরফদার কুম্মী।
তারিখ:২৩/০৪/২০২৫
আপনার কমেন্ট