সোমবার ৫ মে ২০২৫ - ১৯:৪৮
পরিবারের প্রতি অমনোযোগী: আত্মপ্রবঞ্চনা নাকি ইবাদত?

ইসলাম কেবল মসজিদ, মেহরাব কিংবা মানুষের সামনে নিজেকে ধার্মিক প্রমাণ করার নাম নয়। প্রকৃত দ্বীনদারী শুরু হয় ঘর থেকে— স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের দায়িত্বশীলতা, সন্তানের সঠিক পরিচর্যা, মা-বাবার সম্মান ও ভালোবাসা, এবং সংসারের প্রয়োজন পূরণের মাধ্যমে।

 হাওজা নিউজ এজেন্সি রিপোর্ট অনুযায়ী, 
কিন্তু পরিবারের প্রতি অমনোযোগী: আত্মপ্রবঞ্চনা নাকি ইবাদত?
قَالَ الإِمَامُ الصَّادِقُ (ع):
"لَيْسَ مِنَّا مَنْ ضَيَّعَ عِيَالَهُ."
"সে ব্যক্তি আমাদের অন্তর্ভুক্ত নয়, যে তার পরিবার-পরিজনকে অবহেলা করে।"
- (উসুলে কাফী,খন্ড ৫)

ভূমিকা:
ইসলাম কেবল মসজিদ, মেহরাব কিংবা মানুষের সামনে নিজেকে ধার্মিক প্রমাণ করার নাম নয়। প্রকৃত দ্বীনদারী শুরু হয় ঘর থেকে— স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের দায়িত্বশীলতা, সন্তানের সঠিক পরিচর্যা, মা-বাবার সম্মান ও ভালোবাসা, এবং সংসারের প্রয়োজন পূরণের মাধ্যমে।
দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের সমাজে অনেককে দেখা যায় বাইরে দ্বীনি বেশভূষায় সুসজ্জিত, ইসলামী আলোচনায় পারদর্শী, মানুষের কাছে সম্মানিত; অথচ পরিবারের মাঝে দায়িত্বহীন, উদাসীন,এমনকি নির্দয়।
আসলে বাইরের পৃথিবীতে ভালো হওয়ার চেহারা যদি ঘরের ভিতরের চরিত্রের সঙ্গে না মেলে, তাহলে সে দ্বীনদারী আল্লাহর কাছে কোনো মূল্য রাখে না। দ্বীনের প্রকৃত সৌন্দর্য হলো— ঘর ও বাইরে উভয় জায়গায় আল্লাহর বিধান অনুসারে জীবন গড়া।
এই আলোচনায় আমরা কুরআন এবং আহলুল বায়েত (আ.)-এর হাদীসের আলোকে বোঝার চেষ্টা করবো  সত্যকার পরহেজগারি কাকে বলে এবং পরিবারের অধিকার অবহেলা করলে আল্লাহর বিচারে সেই ইবাদত ও দীনি প্রচেষ্টা কতটুকু গ্রহণযোগ্য হবে।

১. দ্বীন শুধুমাত্র বাহ্যিক পরিবেশে দেখানো উচিত নয়:
ইমাম জাফর সাদিক (আ.) বলেন:
"তোমাদের মধ্যে সেই শ্রেষ্ঠ, যে নিজের পরিবার-পরিজনের জন্য উত্তম।"
— (বিহারুল আনওয়ার, খণ্ড ৭১, পৃ. ৩৮৪)

এই হাদীস আমাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা দেয় যে, মানুষের প্রকৃত চরিত্র তার ঘরের মধ্যে প্রকাশ পায়। বাইরের মুখোশ দিয়ে আসল দ্বীনদারীকে তুলে ধরা যায় না।

২. পরিবারের দায়িত্ব পালন না করলে ইবাদত অগ্রহণযোগ্য হতে পারে:
কুরআনে আল্লাহ বলেন:
﴿قُوا أَنفُسَكُمْ وَأَهْلِيكُمْ نَارًا﴾
"তোমরা নিজেদের এবং তোমাদের পরিবারকে আগুন থেকে রক্ষা করো।"
— (সূরা তাহরীম ৬)

এ আয়াতে পরিবারকে রক্ষা করা শুধু উপার্জনের দিক থেকে নয়, বরং তাদের ইসলামী শিক্ষায় গড়ে তোলা ও তাদের নৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করাও অন্তর্ভুক্ত।

৩. স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের গুরুত্ব:
ইমাম আলী (আ.) বলেন:
"স্ত্রীর প্রতি উত্তম ব্যবহার করো। সে তোমার হৃদয়ের প্রশান্তি এবং ধর্মের রক্ষাকারী।"
— (তুহফুল উকূল)

একজন ব্যক্তি  দ্বীনি খেদমতে যতই ব্যস্ত থাক না কেন, স্ত্রীকে অবহেলা, তুচ্ছ জ্ঞান করা কিংবা তার সঙ্গে নির্দয় আচরণ করা, তার দ্বীনদারীর দাবিকে সংশয়ের মধ্যে ফেলে।

৪. সন্তানদের অবহেলা করা শুধু দুনিয়ার ক্ষতি নয়, আখিরাতেরও ক্ষতি:
ইমাম সাদিক (আ.) বলেন:
"তোমাদের সন্তানদেরকে ধর্মীয় জ্ঞান শেখাও, এর আগে যে দুশ্চরিত্র লোকেরা তাদেরকে বিভ্রান্ত করে।"
— (উসূলে কাফি, খণ্ড ৬)

একজন পিতা বা মাতা যদি সন্তানের প্রতি যত্নবান না হন,বা তাদের সঠিক শিক্ষা ও লালন পালন নিশ্চিত না করেন – তবে সেটা শুধু দ্বীনি দায়িত্ব নয়, আখিরাতের জবাবদিহিতার একটি বড় দায়।

৫. মা-বাবাকে অবহেলা: ঈমান ধ্বংসের পথে:
কুরআন বলে:
﴿وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا﴾
"আর মা-বাবার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করো।"
— (সূরা বনী ইসরাইল ২৩)

ইমাম বাকির (আ.) বলেন:
"যে ব্যক্তি তার পিতামাতার প্রতি অবাধ্য, তার ইবাদত আল্লাহর দরবারে উড়িয়ে দেওয়া হয়।"
— (বিহারুল আনওয়ার)

৬. বাজার ঘাট বা সংসারিক দায়িত্বে গাফেল: ইবাদতের অন্তরায়:
ইমাম সাদিক (আ.) বলেন:
"পরিবারের প্রয়োজন মেটানো এবং হালাল রুজির জন্য পরিশ্রম করা – তা-ও আল্লাহর পথে জিহাদের সমতুল্য।"
— (উসূলে কাফি)

যে ব্যক্তি তার পরিবারের মৌলিক দায়িত্ব যেমন বাজার করা, খাবার, ঔষধ বা অন্য জরুরি বিষয়গুলো অবহেলা করে – সে আসলে দ্বীনের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ উপেক্ষা করছে।

উপরের বিষয়টি আরো সুন্দর করে বোঝার জন্য নিম্নে কয়েকটি ঘটনা তুলে ধরছি ।তাহলে আমরা আমাদের পারিবারিক ও দ্বীনি দায়িত্ব সঠিক ভাবে বুঝতে পারবো এবং নিজেদের উত্তমভাবে গড়তে পারব।ফলত আমাদের দুনিয়া ও আখেরাত সফলতা পাবে।

১. এক নামাজি ব্যক্তি ও ইমাম সাদিক (আ.)-এর প্রতিক্রিয়া:

ঘটনা:
ইমাম সাদিক (আ.)-এর এক অনুসারী প্রতিদিন মসজিদে জামাতের নামাজ, ইবাদতে অংশগ্রহণ করত। সবাই তাকে খুব ধার্মিক মনে করত। কিন্তু এক ব্যক্তি এসে বলল, "ইয়া ইমাম, সে ব্যক্তি তার স্ত্রী ও সন্তানদের সময় দেয় না, তাদের প্রাপ্য রিযিকও দেয় না ঠিকমত।"

ইমাম (আ.) বললেন:
"সে ব্যক্তি আল্লাহর ইবাদতকারী নয়, বরং সে নিজের খেয়ালে জীবন কাটাচ্ছে। তার দ্বীন কেবল মুখে আছে, বাস্তবে নয়।"
— (রেওয়ায়েত: উসূলে কাফি, খণ্ড ২)

শিক্ষা:
পরিবারের অধিকার আদায়ে ব্যর্থ ব্যক্তির ইবাদত আল্লাহর কাছে গ্রাহ্য হয় না। বাইরের ধার্মিকতা যদি ঘরে প্রতিফলিত না হয়, তবে তা ভণ্ডামি।

২. ইমাম আলীর (আ.) খাদেম ও পারিবারিক দায়িত্ব:

ঘটনা:
এক ব্যক্তি ইমাম আলী (আ.)-এর খেদমতে নিয়োজিত ছিল। প্রতিদিন দ্বীনি কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকত, কিন্তু তার স্ত্রী ও সন্তানরা অভুক্ত থাকত, সংসার অগোছালো ছিল।

ইমাম (আ.) বলেন:
"তুমি যদি নিজের ঘরের দায়িত্ব পালন না করো, তবে এই খেদমত আল্লাহর পথে নয়। প্রথমে তোমার ঘর ঠিক করো, তারপর অন্যদের খেদমত করো।"

শিক্ষা:
ইমাম আলী (আ.) স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন— ঘর যদি ঠিক না থাকে, তবে বাইরের খেদমত দ্বীনের নামে হলেও তা গ্রহণযোগ্য নয়।

ইমাম আলী (আ.) বলেন:
"যে নিজের ঘরের লোকদের প্রতি যুলুম করে, সে সবচেয়ে দুর্ভাগা ব্যক্তি।"
— (নাহজুল বালাগা)

উপসংহার: 
বাইরের ভালো মানুষ হওয়ার আগে ঘরের ভিতর ভালো হওয়া জরুরি।ইবাদত, হাদীস পড়া, কুরআন তিলাওয়াত, মজলিসে অংশগ্রহণ — এগুলোর সবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু ঘরের মানুষের অধিকার নষ্ট করে কেবল বাইরের মানুষকে দেখানোর মতো ভালো মানুষ হলে তা শুধু আত্মপ্রবঞ্চনা। কুরআন ও আহলুল বায়েত (আ.) আমাদের শিখিয়েছেন যে, একজন সত্যিকার মুমিন সেই, যার ঘর এবং বাইরের জীবন – উভয় জায়গায় একই রকম খোদাভীতি ও দায়িত্বশীলতা দেখা যায়।

আল্লাহ আমাদের সবাইকে দ্বীন ও দুনিয়ার ভারসাম্য রক্ষা করে, পরিবার এবং সমাজ উভয়ের প্রতি দায়িত্বশীল হওয়ার তাওফিক দিন।

লেখক: কবির আলী তরফদার কুম্মী।
তারিখ: ০৫/০৫/২০২৫

আপনার কমেন্ট

You are replying to: .
captcha