হাওজা নিউজ এজেন্সি: আজকের দুনিয়ায় মানুষ তার আধ্যাত্মিক শূন্যতা পূরণের জন্য আশ্রয়ের খোঁজে থাকে। নিরাপত্তা ও প্রশান্তি লাভের আকাঙ্ক্ষায় অনেকে এসব নতুন আধ্যাত্মিক প্রবাহের ফাঁদে পড়ে যায়। কিন্তু কী কারণে কিছু মানুষ প্রকৃত ইসলামী আধ্যাত্মিকতার পরিবর্তে ভুয়া ও ছদ্ম-আধ্যাত্মিকতার দিকে ঝুঁকে পড়ে?
এই প্রবণতার পেছনে শুধু আধুনিক প্রচারকৌশলই নয়, আরও বহু গভীর ব্যক্তিগত ও সামাজিক কারণ রয়েছে। তা মূলত দুই ভাগে ভাগ করা যায়:
(ক) ব্যক্তিগত কারণসমূহ
১. গাফিলতি: ‘গাফিলতি’ শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো—“কোনো কিছুর অদৃশ্য হয়ে যাওয়া বা ভুলে যাওয়া”। এটি সেই অবস্থাকে বোঝায় যেখানে মানুষ সচেতনতা ও আত্মজ্ঞান হারিয়ে ফেলে। কুরআনে বলা হয়েছে: “তাদের অন্তর আছে কিন্তু তারা তা দিয়ে উপলব্ধি করে না, চোখ আছে কিন্তু দেখে না, কানে শুনে না। তারা চতুষ্পদ জন্তুর মতো, বরং তার চেয়েও অধম। তারাই গাফেল।” [সূরা আ'রাফ, আয়াত ১৭৯]
এই আয়াত থেকে বোঝা যায়, যারা আল্লাহর স্মরণ ভুলে যায়, তারা গাফিল হয়ে যায় এবং পথভ্রষ্টতায় পড়ে। ছদ্ম-আধ্যাত্মিকতায় ঝুঁকে পড়া এমন গাফিলতারই পরিণতি।
২. কৌতূহল: মানবজীবনে কৌতূহল একটি স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। মানুষ অনেক সময় গূঢ় ও রহস্যময় বিষয়ের প্রতি আকৃষ্ট হয় এবং গভীর চিন্তা ছাড়াই সেই পথে হাঁটতে শুরু করে। এ প্রবণতা কখনো কখনো তাকে ভুল পথে পরিচালিত করে।
৩. ব্যক্তিগত বিদ্বেষ: ধর্মীয় বা সামাজিক কাঠামোর প্রতি বিরূপ মানসিকতা থেকে কেউ কেউ ভিন্নমত গ্রহণ করে, সমাজবিরোধী আচার-আচরণে লিপ্ত হয় এবং ছদ্ম-আধ্যাত্মিক গোষ্ঠীগুলোর সদস্য হয়ে পড়ে। এটি অনেক সময় ব্যক্তিগত প্রতিবাদের রূপও নেয়।
৪. আলাদা কিছু হওয়ার আকাঙ্ক্ষা: মানুষের স্বাভাবিক এক প্রবণতা হলো নিজেকে অন্যদের থেকে আলাদা প্রমাণ করা বা নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশ করা। অনেকে যখন এ প্রবণতাকে ইতিবাচকভাবে পরিচালনা করতে ব্যর্থ হয়, তখন তারা ব্যতিক্রমী বিশ্বাস বা কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে।
(খ) সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কারণসমূহ
১. আধুনিক যুগে মানুষের আধ্যাত্মিক পিপাসা:
আধুনিকতার যুগে বিজ্ঞানের প্রতি অতিমাত্রায় নির্ভরতা ও ধর্মবিমুখতার পরিণতিতে মানুষ আধ্যাত্মিক শূন্যতায় ভুগছে। পরবর্তীকালে পোস্টমডার্ন চিন্তাধারার মধ্যে দিয়ে মানুষ আবার ‘আধ্যাত্মিকতা’র দিকে ফিরে আসছে—যদিও তা অনেক সময় প্রকৃত নয়, বরং বিকৃত রূপে প্রকাশ পাচ্ছে।
২. বাস্তবধর্মী দিকনির্দেশনার চাহিদা: মানুষ এমন আধ্যাত্মিকতা খোঁজে যা বাস্তব জীবনে উপকারী ও প্রযোজ্য। যখন প্রকৃত ধর্ম এই প্রয়োজন পূরণে ব্যর্থ হয় বা সে উপলব্ধি করা কঠিন হয়ে পড়ে, তখন ছদ্ম-আধ্যাত্মিকতা এর স্থান দখল করে নেয়। কারণ, তা সহজ, শ্রেণিবদ্ধ এবং মনোমুগ্ধকর প্যাকেজে উপস্থাপিত হয়।
৩. মানবিক প্রবৃত্তির সঙ্গে ছদ্ম-আধ্যাত্মিকতার সামঞ্জস্য: ফিতরা (প্রকৃতি) এবং গরীজাহ (প্রবৃত্তি)—এই দুই মানুষের ভেতরে থাকা শক্তি। ছদ্ম-আধ্যাত্মিক প্রবাহগুলো এমন সব চাহিদার সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নেয়—যেমন আরামপ্রিয়তা, স্বার্থপরতা, ক্ষমতা, যৌন আকর্ষণ, অলৌকিক কাজের আকাঙ্ক্ষা ইত্যাদি। ফলে এগুলো সহজেই জনপ্রিয়তা পায়।
৪. ধর্ম ও ধর্মীয় অনুশাসনের ভুল ব্যাখ্যা:
অনেকে ধর্মের ভুল ব্যাখ্যার কারণে বা অযৌক্তিক প্রত্যাশা পূরণ না হওয়ায় প্রকৃত ধর্ম থেকে সরে গিয়ে ছদ্ম-আধ্যাত্মিক পথ গ্রহণ করে। এসব মানুষ ভিন্নধর্ম বা বিশ্বাসের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ে এবং সহজেই বিভ্রান্ত হয়।
৫. পেশাদার প্রচারকৌশল: ছদ্ম-আধ্যাত্মিক গোষ্ঠীগুলো গণমাধ্যম, ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অত্যন্ত সুসংগঠিত ও কৌশলী প্রচার চালায়। তারা অল্প সময়ের মধ্যেই সাধারণ মানুষের বিশ্বাসের গভীরে প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়।
পরিসমাপ্তি: ভুয়া ও ছদ্ম-আধ্যাত্মিকতার ফাঁদে পড়া একটি বহুমাত্রিক সামাজিক ও ব্যক্তিগত সমস্যা। এর প্রতিকারে প্রয়োজন আত্মসচেতনতা, প্রকৃত ধর্মের যথাযথ উপস্থাপন ও সমসাময়িক ভাষায় এর বিশ্লেষণমূলক প্রচার।
সূত্রসমূহ:
১. লিসানুল আরব, ইবনে মানজুর
২. আল-মুফরাদাত, রাগিব ইসফাহানি
৩. তাহকিক ফি কালিমাতুল কুরআন, হুসাইন মুস্তাফাভি
৪. ফিতরাত, মুর্তজা মোতাহহারি, সাদরা প্রকাশন
আপনার কমেন্ট