শুক্রবার ১৬ মে ২০২৫ - ১১:২৬
দুনিয়া থেকে আখিরাত—মানুষের পবিত্র হওয়ার স্তরসমূহ

ইরানের ধর্মীয় নগরী কোমে অবস্থিত হযরত ফাতিমা মাসুমা (সা.আ.)’র মাজারের এক বক্তৃতায় হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমিন তাওয়াক্কুল বলেছেন, আল্লাহ তাআলার ইচ্ছা হলো মানুষকে পবিত্র করা, যাতে তারা জাহান্নামে প্রবেশ না করে। তিনি ব্যাখ্যা করেন, দুনিয়ায় নেমে আসা বিপদ-মুসিবত, মৃত্যুর সময়ের কষ্ট (সাকরাত) এবং রূহ কবজ করার সময়ের কঠিনতা—এগুলো দুনিয়াতে মানুষের পবিত্র হওয়ার তিনটি ধাপ। যদি এতেও পবিত্রতা অর্জন না হয়, তাহলে তাকে বারযাখে শাস্তি দেওয়া হয়। সেখানেও যদি পবিত্র না হয়, তবে কিয়ামতের দিন তাকে অপেক্ষায় রাখা হয়। সর্বশেষে যদি তবুও পবিত্রতা অর্জিত না হয়, তাহলে তাকে জাহান্নামে প্রবেশ করানো হয়, যাতে তার গুনাহ পুড়ে নির্মূল হয়। তবে কিছু গুনাহ এমন আছে, যা জাহান্নামের আগুনেও পুড়ে নির্মূল হয় না। ফলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি চিরকাল জাহান্নামে থাকবে।

হাওজা নিউজ এজেন্সি: হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমিন সৈয়দ রহীম তাওয়াক্কুল বলেন, আত্মিক উন্নয়নের পথে কিছু নিয়ম রয়েছে, যা আমাদের অগ্রগতিকে ত্বরান্বিত করে। তিনি বলেন, এর মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ নিয়ম হলো পথ ও পথিকের মধ্যে সামঞ্জস্য থাকা। এটি একটি সাধারণ সত্য যে, সব স্থানে সবাইকে প্রবেশাধিকার দেওয়া হয় না। 

তিনি বলেন, আল্লাহ তাআলার একটি নাম হলো 'নূর' (আলো)। যখন আল্লাহ নূর হন, তখন তাঁর পথও আলোকিত। পাপাচারে লিপ্ত ব্যক্তির জন্য এই পথে চলা সম্ভব নয়, কারণ পাপের অন্ধকার তাড়ায় বাধা সৃষ্টি করে। তবে পাপের অন্ধকার দূর হলে পথ চলা সম্ভব হয়। 

পবিত্র মাজারের এই বক্তা আরও বলেন, আল্লাহকে 'পবিত্র' ও 'পবিত্রকারী' হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। তাই তাঁর পথও পবিত্র ও পরিশুদ্ধ। বহু হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, গুনাহের দুর্গন্ধ রয়েছে এবং গুনাহগার ব্যক্তি দুর্গন্ধযুক্ত। তাকে আল্লাহর পথে চলতে দেওয়া হয় না, যতক্ষণ না এই দুর্গন্ধ দূর হয়। 

তিনি বলেন, দুনিয়া থেকে জান্নাত বা জাহান্নাম পর্যন্ত তিনটি জগত অতিক্রম করতে হয় এবং ছয়টি ধাপ পার হতে হয়। প্রথমটি দুনিয়ার জগত, তারপর বারযাখের জগত এবং সর্বশেষ কিয়ামতের জগত। দুনিয়ার জগতে তিনটি ধাপ রয়েছে: প্রথম ধাপ হলো বিপদ-মুসিবত ও পরীক্ষা, যা মানুষের পবিত্র হওয়ার মাধ্যম। যদি গুনাহগার ব্যক্তি দুনিয়ার পরীক্ষার মাধ্যমে পবিত্র না হয়, তাহলে সে মৃত্যুর সময় সাকরাতের (কষ্টের) ধাপে উপনীত হয়। যদি তার গুনাহ বেশি হয়, তাহলে তার রূহ কবজ করা কঠিন করা হয়, যাতে এই ধাপে তার গুনাহ মোচন হয়। 

তিনি বলেন, যদি মানুষের গুনাহ অনেক বেশি হয়, তাহলে পবিত্র হওয়ার প্রক্রিয়া বারযাখের জগতে স্থানান্তরিত হয়। কিয়ামতের মতো বারযাখেও জাহান্নাম ও জান্নাত রয়েছে। যদি মানুষ দুনিয়ায় পবিত্র না হয়, তাহলে বারযাখে তাকে নেককার ব্যক্তিদের থেকে আলাদা করা হয়, যারা ‘ওয়াদিউস সালাম’-এ (শান্তির উপত্যকা) অবস্থান করেন। তাকে ইয়ামনের মরুভূমিতে নিয়ে শাস্তি দেওয়া হয়। 

পবিত্র মাজারের বক্তা বলেন, যদি বারযাখের শাস্তির মাধ্যমে তার গুনাহ মোচন হয়, তাহলে তাকে ইয়ামনের মরুভূমি থেকে বের করে নাজাফের 'ওয়াদিউস সালাম'-এ নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু যদি তার গুনাহ এত বেশি হয় যে বারযাখের শাস্তিতেও পবিত্রতা অর্জিত না হয়, তাহলে পবিত্র হওয়ার প্রক্রিয়া কিয়ামতের জগতে স্থানান্তরিত হয়। 

তিনি বলেন, কিয়ামতের জগতে দুটি ধাপ রয়েছে। প্রথম ধাপে গুনাহগার ব্যক্তিকে মাহশারের ময়দানে রাখা হয়, ভয় ও উদ্বেগের মধ্যে তাকে অপেক্ষায় রাখা হয়, যাতে তার গুনাহ মোচন হয়। কিন্তু যদি তার গুনাহ এতটাই বেশি হয় যে তবুও পবিত্রতা অর্জিত না হয়, তাহলে শেষ ধাপে তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হয়। সেখানে তার পাপের অন্ধকার ও অপবিত্রতা দগ্ধ করা হয়। যদি সে পবিত্র হয়ে যায়, তাহলে জান্নাতে প্রবেশের সুযোগ পায়। কিন্তু কিছু মানুষের অন্তরে আহলে বাইত (আ.)-এর প্রতি বিদ্বেষ এতটাই গভীর যে, তারা কখনই পবিত্র হতে পারে না। 

হুজ্জাতুল ইসলাম তাওয়াক্কুল জোর দিয়ে বলেন, আল্লাহ তাআলার মূল পরিকল্পনা হলো মানুষকে পবিত্র করা, যাতে তারা জাহান্নামে প্রবেশ না করে। তিনি বলেন, "আল্লাহ দুনিয়ায় মানুষকে সতর্ক হওয়ার সুযোগ দেন। যদি কেউ সতর্ক না হয়, তাহলে তিনি বিপদ পাঠান। হাদিসে এসেছে, বিপদ গুনাহগার ব্যক্তিকে সঠিক পথে আনার জন্য। যদি সে গুনাহ ত্যাগ করে তাওবা করে, তাহলে আল্লাহ তার সব গুনাহ মাফ করে দেন।" 

তিনি আরও বলেন, "যদি একটি বিপদেও কেউ সতর্ক না হয়, তাহলে আল্লাহ বিপদ বাড়িয়ে দেন। তবে এটা এমন নয় যে, যত গুনাহ করবে, তত বিপদ বাড়বে। বরং বিপদ তখনই আসে, যখন সংশোধনের সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু যদি কেউ গুনাহে এতটাই নিমজ্জিত হয় যে বিপদেও ফায়দা হয় না, তখন বিপদ বন্ধ হয়ে যায়। বরং সে যত গুনাহ করে, আল্লাহ তত বেশি নিয়ামত দিতে থাকেন।" 

পবিত্র মাজারের এই বক্তা বলেন, "দুনিয়ার বিপদ ও মৃত্যুর সময়ের কষ্টের মধ্যে বিশাল পার্থক্য রয়েছে। দুনিয়ার বিপদ শারীরিক কষ্ট দেয়, কিন্তু সাকরাতুল মাউত (মৃত্যুকালীন যন্ত্রণা) সরাসরি রূহকে আঘাত করে। তাই এটি দুনিয়ার যেকোনো কষ্টের চেয়ে অনেক বেশি তীব্র।"

আপনার কমেন্ট

You are replying to: .
captcha