শুক্রবার ১৬ মে ২০২৫ - ১১:৪৮
গায়েবাতের ধারণা ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট

গায়েবাত বা অদৃশ্য হওয়ার ঘটনা ইমাম মাহদী (আ.ফা.)-এর ক্ষেত্রেই প্রথম ঘটেনি। বহু হাদিস থেকে জানা যায়, অনেক নবীই তাদের জীবনের একটি অংশ গোপনে বা অদৃশ্য অবস্থায় কাটিয়েছেন। এটি ছিল আল্লাহর বিশেষ হিকমত ও কল্যাণের কারণে, ব্যক্তিগত ইচ্ছা বা পারিবারিক কারণে নয়।

হাওজা নিউজ এজেন্সি: ইমাম মাহদী (আ.ফা.)-এর জীবন ও মিশন নিয়ে আলোচনা সিরিজের এ পর্বে গায়েবাতের ধারণা ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট নিয়ে আলোচনা করব:

গায়েবতের প্রকৃতি: প্রথমেই বুঝতে হবে, ‘গায়েবাত’ অর্থ ‘চোখের আড়ালে থাকা’, অনুপস্থিত থাকা নয়। অর্থাৎ এই সময়ে ইমাম মাহদী (আ.ফা.) মানুষের দৃষ্টির অন্তরালে থাকেন, কিন্তু তিনি মানুষের মাঝেই বসবাস করেন। মাসুম ইমামগণের (আ.) বর্ণনায় এই সত্য বিভিন্নভাবে উল্লেখিত হয়েছে।

ইমাম আলী (আ.) বলেছেন,
فَوَ رَبِّ عَلِیٍّ إِنَّ حُجَّتَهَا عَلَیْهَا قَائِمَةٌ مَاشِیَةٌ فِی طُرُقِهَا دَاخِلَةٌ فِی دُورِهَا وَ قُصُورِهَا جَوَّالَةٌ فِی شَرْقِ هَذِهِ اَلْأَرْضِ وَ غَرْبِهَا تَسْمَعُ اَلْکَلاَمَ وَ تُسَلِّمَ عَلَی اَلْجَمَاعَةِ تَرَی وَ لاَ تُرَی إِلَی اَلْوَقْتِ وَ اَلْوَعْدِ

“আলীর রবের কসম! নিশ্চয়ই সে সময়ের হুজ্জাত (ইমাম) তাদের মধ্যে সক্রিয়ভাবে বিচরণ করেন। তিনি তাদের রাস্তায় চলাফেরা করেন, বাড়ি-ঘর ও প্রাসাদে প্রবেশ করেন, পৃথিবীর পূর্ব-পশ্চিমে ভ্রমণ করেন। তিনি মানুষের কথা শোনেন, তাদের সমাবেশে সালাম দেন। তিনি সব দেখেন কিন্তু তাকে দেখা যায় না - নির্ধারিত সময় পর্যন্ত।” [আল-গায়বাহ: নুমানি, পৃষ্ঠা- ১৪৪]

যদিও ইমাম মাহদী (আ.ফা.)’র জন্য ভিন্ন ধরণের গায়েবাতের বর্ণনাও বিদ্যমান হয়েছে।

ইমাম সাদিক (আ.) থেকে বর্ণিত হয়েছে,
إِنَّ فِی صَاحِبِ هَذَا اَلْأَمْرِ سنن [سُنَناً] مِنَ اَلْأَنْبِیَاءِ عَلَیْهِمُ السَّلاَمُ ... وَ أَمَّا سُنَّتُهُ مِنْ یُوسُفَ فَالسِّتْرُ یَجْعَلُ اَللَّهُ بَیْنَهُ وَ بَیْنَ اَلْخَلْقِ حِجَاباً یَرَوْنَهُ وَ لاَ یَعْرِفُونَهُ.
“এই ইমামের মধ্যে নবীদের সুন্নত বিদ্যমান... আর ইউসুফ (আ.)-এর সুন্নত হলো গোপন থাকা। আল্লাহ তার ও মানুষের মধ্যে একটি পর্দা সৃষ্টি করবেন, তারা তাকে দেখবে কিন্তু চিনতে পারবে না।”
[কামালুদ্দীন, খণ্ড- ২, পৃষ্ঠা- ৩৫০]

গায়েবতের প্রকারভেদ:

১. সম্পূর্ণ অদৃশ্য থাকা ২. দৃশ্যমান থাকলেও পরিচয় গোপন রাখা 

গায়েবতের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট:
গায়েবাতের ঘটনা ইমাম মাহদী (আ.ফা.)-এর ক্ষেত্রেই প্রথম নয়। হযরত ইদ্রিস, নূহ, সালিহ, ইব্রাহিম, ইউসুফ, মুসা, শোয়াইব, ইলিয়াস, সুলাইমান, দানিয়াল ও ঈসা (আ.)-সহ অনেক নবীর জীবনেই গায়েবাতের ঘটনা ঘটেছে। প্রত্যেকেই তাদের সময়ের প্রেক্ষাপটে কিছু বছর গোপনে কাটিয়েছেন।

ইমাম সাদিক (আ.) বলেন,
إِنَّ لِلْقَائِمِ مِنَّا غَیْبَةً یَطُولُ أَمَدُهَا
“প্রকৃতপক্ষে আমাদের (ইমামে) ক্বায়েমের জন্য দীর্ঘ গায়েবাত নির্ধারিত আছে।”
জিজ্ঞাসা করা হলো: হে রাসুলুল্লাহর সন্তান! এর কারণ কী? 
ইমাম উত্তর দিলেন: “কারণ আল্লাহ তাআলা চান নবীদের গায়েবাতের সুন্নত তার ক্ষেত্রেও কার্যকর হোক।”
[ইলালুশ শারাই, খণ্ড- ১, পৃষ্ঠা- ২৪৫]

উপরের আলোচনা থেকে এটি স্পষ্ট হয় যে, ইমাম মাহদী (আ.ফা.)-এর জন্মের বহু বছর আগেই তাঁর গায়েব (অদৃশ্য) হওয়ার বিষয়টি আলোচিত হয়েছে। ইসলামের নেতৃবৃন্দ, রাসূলুল্লাহ (সা.) থেকে শুরু করে ইমাম হাসান আল আসকারী (আ.) পর্যন্ত, ঐ মহান ইমামের গায়েব হওয়া, এর কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য এবং গায়েবের সময়কালে ঘটনাবলি সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন। তারা ঐ সময়ের মুমিনদের করণীয় কী হবে তাও বর্ণনা করেছেন। 

রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,
اَلْمَهْدِیُّ مِنْ وُلْدِی اِسْمُهُ اِسْمِی وَ کُنْیَتُهُ کُنْیَتِی أَشْبَهُ اَلنَّاسِ بِی خَلْقاً وَ خُلْقاً تَکُونُ بِهِ غَیْبَةٌ وَ حَیْرَةٌ تَضِلُّ فِیهَا اَلْأُمَمُ ثُمَّ یُقْبِلُ کَالشِّهَابِ اَلثَّاقِبِ یَمْلَؤُهَا عَدْلاً وَ قِسْطاً کَمَا مُلِئَتْ جَوْراً وَ ظُلْماً
“মাহদী আমার বংশধর। তার নাম আমার নাম, উপনাম আমার উপনাম। সৃষ্টি ও চরিত্রে সে আমার সবচেয়ে সাদৃশ্যপূর্ণ। তার জন্য গায়েবাত (নির্ধারিত হয়েছে) ও (যার ফলে) হতবুদ্ধিকর অবস্থা আসবে, যাতে জাতিগুলো পথভ্রষ্ট হবে। অতঃপর সে উজ্জ্বল উল্কার মত আবির্ভূত হবে এবং পৃথিবীকে ন্যায় ও ইনসাফে পূর্ণ করবে, যেমনটা জুলুম ও অত্যাচারে পূর্ণ ছিল।”
[কামালুদ্দীন, খণ্ড- ১, পৃষ্ঠা- ২৮৬]

মূল শিক্ষা: গায়েবাত আল্লাহর একটি সুন্নত যা পূর্ববর্তী নবীদের মধ্যেও দেখা গেছে। ইমাম মাহদী (আ.ফা.)-এর গায়েবাত সম্পর্কে রাসুল (সা.) ও ইমামগণ (আ.) আগে থেকেই ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন এবং এই সময়ে মুমিনদের কর্তব্য বর্ণনা করেছেন।

(চলবে...)
 
সূত্র: ‘নেগিনে অফারিনেশ’ গ্রন্থ থেকে সংক্ষেপিত ও সম্পাদিত

Tags

আপনার কমেন্ট

You are replying to: .
captcha