রবিবার ১৮ মে ২০২৫ - ০৮:০৪
নৈতিক শিক্ষা | স্বার্থপরতার শেষ হলো মানবতার সূচনা

যে ব্যক্তি দুনিয়াকে নিজের জন্য তুচ্ছ মনে করে, সে এমন এক মর্যাদায় পৌঁছে যায় যেখানে তার ব্যক্তিত্ব দূর্লভ্য হয়ে ওঠে। আত্মমর্যাদা অহংকারও নয়, আবার অপমানও নয়; বরং এটি মানুষের অভ্যন্তরীণ মূল্যবোধের রক্ষক। যেখানে আত্মমর্যাদা থাকে, সেখানে মানুষ নীচতা, মিথ্যা ও অপমান থেকে দূরে থাকে এবং স্বাধীনতা ও আত্মার মহত্ত্ব অর্জন করে।

হাওজা নিউজ এজেন্সি: শহীদ উস্তাদ মোতাহহারী তার এক বক্তৃতায় “বুদ্ধি ও বিশ্বাসের মানদণ্ডে আত্মমর্যাদা” বিষয়ে আলোচনা করেছিলেন, যা আজ আপনাদের মতো জ্ঞানপিপাসু ব্যক্তিদের উদ্দেশে উপস্থাপন করা হলো:

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
إِنَّ أَعْظَمَ النَّاسِ قَدْرًا الَّذِي لَا يَرَى الدُّنْيَا لِنَفْسِهِ خَطَرًا
এই বাক্যটির অর্থ হলো— সবচেয়ে মহান ব্যক্তি সে, যে নিজের জন্য দুনিয়ার কোনো মূল্য দেখে না। 

এখানে “নিজের জন্য” বলতে বোঝানো হয়েছে যে, এমন ব্যক্তি নিজেকে সমগ্র দুনিয়ার চেয়ে উচ্চতর মনে করে। এই দৃষ্টিভঙ্গি ব্যক্তিত্বের স্থিরতা ও আত্মমর্যাদার গুরুত্ব বোঝার দিকে পরিচালিত করে। 

দুনিয়ার প্রতি অবহেলা ও বস্তুগত সম্পর্ক অতিক্রম
ইমাম জয়নুল আবেদীন (আ.) কেও জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল:
من أعظم الناس خطرا؟
সবচেয়ে মহান ব্যক্তি কে?

তিনি উত্তরে বলেছিলেন,
مَنْ لَمْ يَرَ الدُّنْيَا لِنَفْسِهِ خَطَرًا
অর্থাৎ, যে ব্যক্তি নিজের জন্য (অর্থাৎ নিজের চেয়ে) দুনিয়াকে অধিক গুরুত্ব দেয় না। এখানে "خَطَر" শব্দের অর্থ মর্যাদা বা মূল্য। 

সূফী ও আধ্যাত্মিক ঐতিহ্যে দুনিয়ার প্রতি অবহেলা ও বস্তুগত সম্পর্ক ত্যাগকে প্রশংসনীয় বলে বিবেচনা করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে কখনো কখনো এটি বিকৃতির দিকে নিয়ে যায়। 

উদাহরণস্বরূপ, কিছু পশ্চিমা সমাজে “পেশাদার ভিক্ষাবৃত্তি” দেখা যায়, যেখানে মানুষ শুধুমাত্র অন্যের দয়া বা নিজেকে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য ভিক্ষা করে, যদিও তাদের প্রকৃত কোনো প্রয়োজন নেই। এমন আচরণ, এমনকি যদি এর পেছনে বস্তুগত স্বার্থ ছাড়া অন্য কোনো উদ্দেশ্য থাকে, তবুও তা আত্মমর্যাদাকে ক্ষুণ্ণ করে। 

ইসলামী নীতিশাস্ত্রে অন্যের কাছে ভিক্ষা করা বা প্রয়োজন প্রকাশ করা নিন্দনীয়। ইমাম আলী (আ.) বলেছেন,
طَلَبُ الْحَوَائِجِ إِلَى النَّاسِ مَذَلَّةٌ لِلْحَيَاةِ، وَمَذْهَبَةٌ لِلْحَيَاءِ، وَمُذْهَبَةٌ لِلْوَقَارِ
অর্থাৎ, মানুষের কাছে প্রয়োজন প্রকাশ করা নিজ জীবনের জন্য অপমানকর, লজ্জাজনক ও মর্যাদা হানিকর। 

এই শিক্ষাগুলো মানুষকে মর্যাদা ও আত্মসম্মানবোধের দিকে আহ্বান করে। ইমাম সাদিক (আ.) বলেছেন,
وَكُنْ عَزِيزَ النَّفْسِ ذَا مَنْزِلَةٍ مُنْصِفَةٍ فِي الْمَآثِرِ
অর্থাৎ, মানুষকে মধ্যপন্থী হতে হবে, কিন্তু আত্মমর্যাদা বজায় রাখতে হবে। 

মানুষের উচিত নয় নিজেকে দুর্বল বা নিম্নস্তরের মানুষের সমতুল্য করা; বরং নিজের শক্তির উপর নির্ভর করে জীবন পরিচালনা করা, যাতে অন্যের দৃষ্টিতে সম্মানিত ও মহান হিসেবে বিবেচিত হয়। 

নাহজুল বালাগায় ইমাম আলী (আ.) বলেছেন,
أَكْرِمْ نَفْسَكَ عَنْ كُلِّ دَنِيَّةٍ وَإِنْ سَاقَتْكَ إِلَى الرَّغَائِبِ، فَإِنَّكَ لَنْ تَعْتَاضَ عَمَّا تَبْذُلُ مِنْ نَفْسِكَ عِوَضًا
এর অর্থ হলো— “নিজেকে সকল নীচ কাজ থেকে সম্মানিত রাখো, এমনকি যদি তা তোমাকে লোভনীয় সুযোগের দিকে নিয়ে যায়। কারণ, তুমি যদি নিজের আত্মা ও মর্যাদা থেকে কিছু হারাও, তার কোনো প্রতিদান পাবে না।”

এখানে লক্ষণীয় যে, মানুষ যদি তার সম্পদ বা সামগ্রী হারায়, তা ফিরে পাওয়া সম্ভব। কিন্তু যদি তার আত্মমর্যাদা, সম্মান বা মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হয়, তা পুনরুদ্ধার করা অসম্ভব। 

প্রত্যেকের মানবিক ব্যক্তিত্বই উন্নতি ও মর্যাদার ভিত্তি
ইমাম আলী (আ.) আরও বলেন,
لَا تَكُنْ عَبْدًا لِغَيْرِكَ وَقَدْ جَعَلَكَ اللَّهُ حُرًّا
অর্থাৎ, অন্যের দাস হয়ো না, কারণ আল্লাহ তোমাকে স্বাধীন হিসেবে সৃষ্টি করেছেন। 

এ ধরনের শিক্ষা মানুষের আত্মমর্যাদাকে শক্তিশালী করে। এখানে “অহংকার” ও “আত্মমর্যাদা” এর মধ্যে পার্থক্য করতে হবে। যদিও অনেক ক্ষেত্রে অহংকার নেতিবাচক অর্থে ব্যবহৃত হয়, কিন্তু এখানে আত্মমর্যাদাকেই বোঝানো হয়েছে, আত্মগর্ব বা অহংকার নয়। 

ইমাম আলী (আ.) বলেছেন, 
قَدْرُ الرَّجُلِ عَلَى قَدْرِ هِمَّتِهِ، وَصِدْقُهُ عَلَى قَدْرِ مُرُوَّتِهِ، وَعِفَّتُهُ عَلَى قَدْرِ غَيْرَتِهِ
অর্থাৎ— একজন মানুষের মূল্য তার লক্ষ্যের উচ্চতার উপর নির্ভর করে, তার সত্যবাদিতা তার বীরত্বের উপর নির্ভর করে এবং তার পবিত্রতা তার আত্মসম্মানবোধের উপর নির্ভর করে।

যার লক্ষ্য মহান, তার মর্যাদাও মহান। আর যে ক্ষুদ্রমনা ও লক্ষ্যহীন, সে নিজেই নিজেকে হেয় করে। 

মিথ্যা বলা ব্যক্তিত্বের দুর্বলতার লক্ষণ। মানুষ যখন নিজেকে অক্ষম, ভীত বা হীন মনে করে, তখন মিথ্যার আশ্রয় নেয়। কিন্তু মানুষ যত বেশি শক্তি ও সামর্থ্য অনুভব করে, তত বেশি সত্যবাদী হয়, কারণ তার গোপনীয়তা বা প্রতারণার প্রয়োজন হয় না। 

ইমাম সাদিক (আ.) থেকে বর্ণিত হয়েছে,
لَا تَكُنْ فَظًّا غَلِيظًا يُكْرِهُ النَّاسُ قُرْبَكَ، وَلَا ذَلِيلًا يُحْتَقَرُكَ مَنْ يَرَاكَ
অর্থাৎ— এতটা কঠোর ও রূঢ় হয়ো না যে মানুষ তোমার কাছাকাছি আসতে ভয় পায়, আবার এতটা নিচুও হয়ো না যে তোমাকে দেখে মানুষ তোমাকে তুচ্ছ মনে করে।

ইসলাম নম্রতা শিক্ষা দিয়েছে, কিন্তু নম্রতা ও অপমানকে এক করে দেখেনি। নম্রতা মানে কোমল আচরণ, সদাচার ও অন্যদের ভালোবাসা অর্জন, নীচতা নয়। অপমান ব্যক্তিত্বকে ধ্বংস করে, কিন্তু নম্রতা সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা আনে। 

ইসলামী গ্রন্থগুলোতে স্পষ্টভাবে মানবিক ও মর্যাদাভিত্তিক আচরণের প্রতি আহ্বান দেখা যায়। কিন্তু প্রশ্ন উঠতে পারে—  এই শিক্ষাগুলো কি সূফী ও আধ্যাত্মিক নীতিশাস্ত্রের সাথে সাংঘর্ষিক, যা “আত্মার পরাজয়” ও “স্ব-অস্বীকার”-এর উপর জোর দেয়?

উত্তর হলো— এখানে কোনো সাংঘর্ষিকতা নেই। কারণ মানুষের দুই ধরনের “আত্মা” রয়েছে: 

১. পশুত্বের আত্মা, যা কামনা-বাসনা ও বস্তুগত স্বার্থে সীমাবদ্ধ। 

২. মানবিক আত্মা, যেখানে মর্যাদা, সম্মান ও জ্ঞান নিহিত। 

পশুত্বের আত্মা আধ্যাত্মিক মহত্ত্ব বুঝতে পারে না, কিন্তু মানবিক আত্মা উন্নতি ও মর্যাদার ভিত্তি। 

আত্মমর্যাদা ও মানবিক সম্মান রক্ষা আত্মিক উন্নতির লক্ষণ
পবিত্র আয়াত:
وَلِلَّهِ الْعِزَّةُ وَلِرَسُولِهِ وَلِلْمُؤْمِنِينَ
(সুরা মুনাফিকুন, আয়াত ৮) এই মানবিক মর্যাদাকেই নির্দেশ করে। হাদীসে এসেছে— আল্লাহ মানুষকে মর্যাদা দিয়ে সৃষ্টি করেছেন; মানুষের উচিত এই মর্যাদাকে অনুভব করা। 

তাই নম্রতা ও আত্মমর্যাদার মধ্যে কোনো বিরোধ নেই। মানুষের সাথে আচরণের ক্ষেত্রে নম্র, সদয় ও সহানুভূতিশীল হতে হবে। কিন্তু যখন আত্মমর্যাদা ক্ষুণ্ণ হওয়ার প্রশ্ন আসে, তখন তা রক্ষা করতে হবে। 

সূফী নীতিশাস্ত্রে অন্যদের প্রতি ভালোবাসা ও আত্মকেন্দ্রিকতা ভাঙার ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জিত হয়েছে। কিন্তু সমস্যা হলো, এই দর্শন কখনো কখনো নম্রতা ও অপমানের মধ্যে পার্থক্য করতে ব্যর্থ হয়েছে। 

সুতরাং, মানুষের উচিত নীচ কাজের সামনে নিজেকে মহান মনে করা— অহংকার থেকে নয়, বরং আত্মমর্যাদা থেকে।
এই দৃষ্টিভঙ্গি পাপ, বিশ্বাসঘাতকতা, মিথ্যা ও লোভ থেকে বিরত রাখে। 

أَكْرِمْ نَفْسَكَ عَنْ كُلِّ دَنِيَّةٍ
বলতে বোঝানো হয়েছে— তোমার মর্যাদা ও ব্যক্তিত্বকে এতটা সম্মানিত মনে করো যে, কোনো লাভের জন্য তাকে কলুষিত করতে রাজি হবে না।

ইসলামী নীতিশাস্ত্রে আত্মমর্যাদা ও মানবিক সম্মান রক্ষা আত্মিক উৎকর্ষ ও নীচতা থেকে আত্মসংযমের লক্ষণ।

আপনার কমেন্ট

You are replying to: .
captcha