সোমবার ১৯ মে ২০২৫ - ২১:৫৩
আজকের ইসরায়েল কি কোরআনে উল্লিখিত বনী ইসরাইলেরই ধারাবাহিকতা?

"ইসরায়েল" নামটি, যা একসময় আল্লাহর আনুগত্য ও পবিত্রতার প্রতীক ছিল, আজ তা নিপীড়ন, হত্যা এবং দখলের প্রতীক হয়ে উঠেছে।

হাওযা নিউজ এজেন্সি রিপোর্ট অনুযায়ী, ইহুদি রাষ্ট্র (বর্তমান ইসরায়েল) না তো নবীগণের উত্তরাধিকারী, না ধর্ম ও পবিত্রতার ধারক। বরং এটি উপনিবেশবাদ ও জায়নবাদের চক্রান্তে গঠিত একটি অবৈধ সত্তা।

"ইসরায়েল" নামটি, যা একসময় আল্লাহর আনুগত্য ও পবিত্রতার প্রতীক ছিল, আজ তা নিপীড়ন, হত্যা এবং দখলের প্রতীক হয়ে উঠেছে।

আজকের ইসরায়েল কোরআনে উল্লিখিত বনী ইসরাইলের কোনো উত্তরাধিকার নয়, বরং এটি একটি রাজনৈতিক ও উপনিবেশবাদী ষড়যন্ত্রের ফল, যার মাধ্যমে ফিলিস্তিন ভূমি দখলের জন্য জায়নবাদী আন্দোলন ও উপনিবেশিক শক্তিগুলো একত্রিত হয়েছে।

জায়নবাদী সরকারের ক্রমবর্ধমান দমন-পীড়ন আবারও এই প্রশ্ন উত্থাপন করেছে:
আজকের ইসরায়েল কি সেই বনী ইসরাইল, যাদের কথা কোরআনে এসেছে?
এই প্রশ্নের যথাযথ ও গবেষণাভিত্তিক উত্তর পেতে হলে ঐতিহাসিক, ধর্মীয় এবং ভৌগোলিক প্রমাণ বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। যা প্রমাণ করে—কোরআনে বর্ণিত বনী ইসরাইল এবং আজকের ইসরায়েলের মধ্যে কেবল নামের মিল রয়েছে, বাস্তবে তাদের মধ্যে কোনো সম্পর্ক নেই।

১. কোরআন ও ইতিহাসে বনী ইসরাইল

বনী ইসরাইল ছিলেন হযরত ইয়াকুব (আ.)-এর বংশধর। ইয়াকুব (আ.)-এর উপাধি ছিল “ইসরাইল” (অর্থাৎ আল্লাহর বান্দা)। তাঁর বারো পুত্র ছিলেন, যাদের বংশ পরবর্তীকালে “বারো গোত্র বনী ইসরাইল” নামে পরিচিত হয়।
হযরত ইউসুফ (আ.)-এর ঘটনার পর তাঁরা মিশরে যান, যেখানে ফিরআউনরা তাদের দাসে পরিণত করে।
কোরআন তাদের সিনাই মরুভূমিতে ভ্রমণ, মূসা (আ.)-এর বিরোধিতা এবং পরিশেষে আল্লাহর রোষের উল্লেখ করে:
"فَبَآءُوا بِغَضَبٍ عَلَی غَضَبٍ…" (সূরা বাকারা, আয়াত ৯০)

হযরত মূসা (আ.)-এর পর হযরত ইয়ুশা ইবনে নুন-এর নেতৃত্বে তাঁরা কানআন (কানান) ভূমি দখল করেন এবং হযরত দাউদ (আ.) ও সুলাইমান (আ.)-এর অধীনে রাজ্য গঠন করেন। কিন্তু এসব রাজ্য খ্রিষ্টপূর্ব যুগেই বিলুপ্ত হয়ে যায়।
পরবর্তীতে বনী ইসরাইল বেবিলন, ইরান, গ্রিস ও রোমান সাম্রাজ্যের অধীনে চলে যায়। ৭০ খ্রিষ্টাব্দে রোমানরা বাইতুল মুকাদ্দাস ধ্বংস করে এবং বনী ইসরাইল গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।

২. ফিলিস্তিন: কনআনীদের ভূমি, ইহুদিদের নয়

“ফিলিস্তিন” নামটি এসেছে সেই কনআনি ও ইয়েবুসি জাতিগুলোর নাম থেকে, যারা খ্রিস্টপূর্ব ২৫০০ সালে আরব উপদ্বীপ থেকে লেভান্ট অঞ্চলে (ভূমধ্যসাগরের পূর্ব তীরে) চলে আসে।
জেরুজালেম (বাইতুল মুকাদ্দাস)-এর প্রাচীন নাম ছিল “ইবুস”, এবং এই অঞ্চল বনী ইসরাইল আসার বহু আগেই বিভিন্ন সেমিটিক জাতিগুলোর বসতি ছিল।

৩. ফিলিস্তিনে ইহুদিদের প্রত্যাবর্তন: কোনো ঐশী প্রতিশ্রুতি নয়, বরং রাজনৈতিক চক্রান্ত

বহু শতাব্দীর নির্বাসনের পর, ১৯ শতক পর্যন্ত ফিলিস্তিনে ইহুদি জনগণের সংখ্যা ছিল অত্যন্ত নগণ্য।
যেমন, ১৮৮০ সালে ফিলিস্তিনের মোট ৫ লক্ষ জনসংখ্যার মধ্যে ইহুদি ছিল মাত্র ২৪ হাজার (প্রায় ৫%)।
কিন্তু ১৮৯৬ সালে থিওডোর হার্জলের নেতৃত্বে জায়নবাদী আন্দোলন শুরু হয় এবং ১৮৯৭ সালে সুইজারল্যান্ডের বেসেল শহরে প্রথম জায়নিস্ট কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে ফিলিস্তিনে ইহুদি উপনিবেশ স্থাপনের পরিকল্পনা গৃহীত হয়।

১৯১৭ সালে বেলফোর ঘোষণা অনুযায়ী ব্রিটিশ সরকার ফিলিস্তিনে “ইহুদি জাতীয় ভূখণ্ড” প্রতিষ্ঠার পক্ষে অবস্থান নেয়।
ব্রিটিশ বাহিনী ফিলিস্তিন দখল করে এবং ইউরোপ থেকে ব্যাপক হারে ইহুদিদের স্থানান্তর শুরু হয়। ফলে তাদের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় মোট জনসংখ্যার ৩২ শতাংশে।

৪. ইসরায়েলের প্রতিষ্ঠা: ইতিহাসের ধারাবাহিকতা নয়, উপনিবেশবাদী সৃষ্টি

১৪ মে, ১৯৪৮ সালে ব্রিটিশ বাহিনী প্রত্যাহারের পর ডেভিড বেন গুরিয়ন ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন, যদিও সে সময় ফিলিস্তিনে মুসলিম ও খ্রিষ্টান সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল এবং তারা এর তীব্র বিরোধিতা করেছিল।
এই রাষ্ট্র গঠিত হয় ধর্মীয় উত্তরাধিকারের মাধ্যমে নয়, বরং আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মত বৈশ্বিক উপনিবেশবাদী শক্তির প্রত্যক্ষ সমর্থনে, যারা তৎক্ষণাৎ এই অবৈধ রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেয়।

৫. “ইসরাইল” নামের বিকৃতি: যখন নবীর নাম দখলদার রাষ্ট্রে পরিণত হলো

ইহুদি ঐতিহ্যে হযরত ইয়াকুব (আ.)-কে “ইসরায়েল” উপাধি দেয়া হয় এই দাবির ভিত্তিতে যে, তিনি নাকি ঈশ্বরের সাথে কুস্তি করে জয়লাভ করেন:
“তোমার নাম আর ইয়াকুব নয়, বরং ইসরায়েল হবে; কারণ তুমি ঈশ্বর ও মানুষের সাথে লড়েছো এবং বিজয়ী হয়েছো” (আদি পুস্তক ৩২:২৮)
কিন্তু কোরআনের দৃষ্টিতে “ইসরাইল” একটি সম্মানজনক উপাধি, যা একজন নবীকে দেয়া হয়েছিল।

৬. উপসংহার: বর্তমান ইসরায়েলের কোরআনের বনী ইসরাইলের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই

কোরআনে উল্লিখিত বনী ইসরাইল ছিলেন একটি ধর্মীয় জাতি, যাদের ভিত্তি ছিল নবুয়ত, একেশ্বরবাদ এবং আসমানি শিক্ষা।
অপরদিকে, আজকের ইসরায়েল একটি রাজনৈতিক, সামরিক এবং উপনিবেশবাদী প্রকল্প—একটি বর্ণবাদী রাষ্ট্র, যার কোনো সম্পর্ক নেই নবীদের উত্তরাধিকার বা ধর্মীয় প্রতিনিধিত্বের সঙ্গে।
জায়নবাদী রাষ্ট্র “ইসরাইল” নামের পবিত্রতা অপহরণ করে কেবল ইতিহাসই বিকৃত করেনি, বরং এক ঐশী মহান ব্যক্তির অবমাননাও করেছে।

আপনার কমেন্ট

You are replying to: .
captcha