হাওজা নিউজ এজেন্সি: পূর্ববর্তী আলোচনাগুলো থেকে প্রতীয়মান হয় যে, ইমাম মাহদী (আ.ফা.)-এর গায়েবী ছিল একটি অপরিহার্য ঐশী ব্যবস্থাপনা। কিন্তু যেহেতু আমাদের মহান ইমামগণের সমস্ত কার্যক্রম জনগণের ঈমানী ভিত্তি সুদৃঢ় করার লক্ষ্যে পরিচালিত হত, আর শেষ হুজ্জাতের দীর্ঘ গায়েবাত যেন মুসলিম উম্মাহর ধর্মীয় জীবনে অপূরণীয় ক্ষতি না বয়ে আনে- সে কারণে এই গায়েবাত পর্ব অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে ও পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়ন করা হয়েছে।
বারো তম ইমাম (আ.ফা.)-এর জন্মের বহু বছর পূর্ব থেকেই তাঁর গায়েবাত ও এর অপরিহার্যতা সম্পর্কে আলোচনা সমাজে প্রচলিত ছিল এবং এ বিষয়টি ইমামে মা‘সুমীন (আ.) ও তাদের অনুসারীদের মজলিসে বারবার উপস্থাপিত হতো। একইভাবে, ইমাম হাদী ও ইমাম হাসান আল-আসকারী (আ.)-এর সাথে শিয়াদের সম্পর্কের পদ্ধতিও একটি নতুন ও সীমিত কাঠামোয় সংঘটিত হতো। আহলে বাইত (আ.)-এর অনুসারীরা ধীরে ধীরে শিখে নিয়েছিলেন যে, অনেক জাগতিক ও আধ্যাত্মিক প্রয়োজনে সরাসরি ইমামের দরবারে হাজির হওয়া আবশ্যক নয়; বরং ইমাম কর্তৃক মনোনীত ওয়াকিল ও বিশ্বস্ত ব্যক্তিদের মাধ্যমে তারা তাদের দায়িত্ব পালন করতে পারেন।
ইমাম হাসান আসকারী (আ.)-এর শাহাদতের পর এবং ইমামে যামানা হুজ্জাত ইবনুল হাসান (আ.ফা.)-এর গায়েবাতের সূচনায়ও ইমাম ও উম্মতের মধ্যে সম্পর্ক সম্পূর্ণরূপে বিচ্ছিন্ন হয়নি। বরং জনগণ ইমামে যামান (আ.)-এর বিশেষ নায়েবদের মাধ্যমে তাদের মাওলা ও নেতৃত্বের সাথে সংযুক্ত ছিলেন। এই সময়েই শিয়াগণ ধর্মীয় আলেমদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ ও সম্পর্ক স্থাপনে অভ্যস্ত হয়ে ওঠেন এবং উপলব্ধি করেন যে, ইমামের গায়েবাতের সময়েও তাদের ধর্মীয় দায়িত্বাবলি জানার পথ অবারিত রয়েছে। এই উপযুক্ত প্রেক্ষাপটেই ইমামে যামান বাকিয়্যাতুল্লাহ (আ.ফা.)-এর দীর্ঘ গায়েবাত সংঘটিত হয় এবং পূর্ববর্তী যুগে ইমাম ও শিয়াদের মধ্যে প্রচলিত সরাসরি সম্পর্কের ধারা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
গায়েবাতে সুগরা (সংক্ষিপ্ত ও সামরিক গায়েবাত) ও গায়েবাতে কুবরা (দীর্ঘ গায়েবাত)—এই দুই পর্যায়ে ইমাম মাহদী (আ.)-এর গায়েবাত কাল বিভক্ত। হাদীসে এসেছে:
للقائم غيبتان إحداهما قصيرة والأخرى طويلة
ক্বায়েম (আ.ফা.)-এর দুইটি গায়েবাত আছে: একটি সংক্ষিপ্ত, অন্যটি দীর্ঘ।
[বিহারুল আনওয়ার, ৫২/১৫২]
১. গায়েবাতে সুগরা (২৬০-৩২৯ হিজরি)
ইমাম হাসান আল আসকারী (আ.)-এর শাহাদাতের পর ইমাম মাহদী (আ.ফা.)-এর গায়েবাতের প্রথম পর্যায় শুরু হয়, যা প্রায় ৭০ বছর স্থায়ী ছিল। এই সময়ে শিয়াগণ চার বিশেষ নায়েব (নাওয়াবুল আরবা’আ)-এর মাধ্যমে ইমামের সাথে যোগাযোগ রাখতেন।
নাওয়াবুল আরবা’আ (চার নায়েব):
১. উসমান ইবনে সাঈদ আল-আমরী (রহ.): ইমামে যামান (আ.ফা.)-এর গায়েবাতের প্রারম্ভিক সময় থেকেই তিনি বিশেষ নায়েবের মর্যাদা লাভ করেন। ২৬৭ হিজরিতে তাঁর ইন্তেকাল ঘটে। উল্লেখ্য যে, তিনি ইমাম হাদী ও ইমাম হাসান আল-আসকারী (আ.)-এর খাস ওয়াকিল হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।
২. মুহাম্মাদ ইবনে উসমান আল-আমরী (রহ.): তিনি প্রথম নায়েবের সুযোগ্য পুত্র ছিলেন, যিনি পিতার মৃত্যুর পর নায়েবের পদ লাভ করেছিলেন এবং ৩০৫ হিজরিতে মৃত্যুবরণ করেন।
৩. হুসাইন ইবনে রুহ নওবাখ্তী (রহ.): তিনি তৃতীয় প্রতিনিধি হিসেবে ২১ বছর নায়েব হিসেবে দায়িত্ব পালনের পর ৩২৬ হিজরিতে মৃত্যুবরণ করেন।
৪. আলী ইবনে মুহাম্মাদ সামুরী (রহ.): তিনি ৩২৯ হিজরিতে ইন্তেকাল করেন এবং তাঁর মৃত্যুর মাধ্যমে গায়বাতে সুগরা পর্বের সমাপ্তি ঘটে।
বিশেষ প্রতিনিধিগণ সকলেই ইমাম হাসান আল-আসকারী (আ.) এবং ইমাম মাহদী (আ.ফা.) কর্তৃক নির্বাচিত হয়ে জনগণের কাছে পরিচিত হতেন। তবে গায়বাতে সুগরা’র সময়কালে প্রতিজন প্রতিনিধি নিজের মৃত্যুর পূর্বে পরবর্তী প্রতিনিধিকে—যিনি ইমাম মাহদী (আ.ফা.)-এর নির্দেশে নির্বাচিত হতেন—জনগণের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করতেন।
চার বিশেষ প্রতিনিধি (নাওয়াবে আরবা’আ)-এর সাথে যোগাযোগ এবং গায়বাতে সুগরা’র সময়ে কিছু শিয়া অনুসারীরাজ ইমামের সাক্ষাতলাভ এবং দ্বাদশ ইমাম ও আল্লাহর শেষ হুজ্জাতের অস্তিত্ব প্রমাণে গভীর ভূমিকা রেখেছিল।
এই ঘটনা এমন এক সময়ে ঘটেছিল যখন শত্রুরা ইমাম আসকারী (আ.)-এর কোনো সন্তান জন্মগ্রহণ করেছেন কি না—এ নিয়ে শিয়াদের মধ্যে সন্দেহ সৃষ্টির চেষ্টা করছিল। আরও গুরুত্বপূর্ণ হলো, এই সময়ই গায়বাতুল কুবরা (দীর্ঘ গায়েবাত)’র সূচনার জন্য উপযুক্ত প্রেক্ষাপট তৈরি করেছিল।
ইমাম (আ.) শেষ নায়েবের মাধ্যমে ঘোষণা দেন:
فقد وقعت الغيبة التامة فلا ظهور إلا بعد إذن الله تعالى
“পূর্ণ গায়েবাতের সময় শুরু হয়েছে। এখন আল্লাহর অনুমতি ছাড়া কোনো জনসম্মুখে উপস্থিতি নেই।”
[কিতাবুল গায়বা, শেখ তুসী, পৃষ্ঠা- ৩৯৫]
২. গায়েবাতে কুবরা (দীর্ঘ গায়েবাত- ৩২৯ হিজরি থেকে আজ পর্যন্ত):
চতুর্থ বিশেষ প্রতিনিধির জীবনের শেষ দিনগুলোতে ইমাম মাহদী (আ.ফা.)-এর পক্ষ থেকে তাঁকে প্রদত্ত এক পত্রে উল্লেখ করা হয়েছিল:
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمنِ الرَّحِیمِ یَا عَلِیَّ بْنَ مُحَمَّدٍ السَّمُرِیَّ أَعْظَمَ اللَّهُ أَجْرَ إِخْوَانِکَ فِیکَ فَإِنَّکَ مَیِّتٌ مَا بَیْنَکَ وَ بَیْنَ سِتَّةِ أَیَّامٍ فَاجْمَعْ أَمْرَکَ وَ لَا تُوصِ إِلَی أَحَدٍ فَیَقُومَ مَقَامَکَ بَعْدَ وَفَاتِکَ فَقَدْ وَقَعَتِ الْغَیْبَةُ التَّامَّةُ فَلَا ظُهُورَ إِلَّا بَعْدَ إِذْنِ اللَّهِ تَعَالَی ذِکْرُهُ وَ ذَلِکَ بَعْدَ طُولِ الْأَمَدِ وَ قَسْوَةِ الْقُلُوبِ وَ امْتِلَاءِ الْأَرْضِ جَوْراً...
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম। হে আলী ইবনে মুহাম্মাদ সামুরী! আল্লাহ তোমার দ্বীনি ভাইদেরকে তোমার বিচ্ছেদে উত্তম প্রতিদান দান করুন। নিশ্চয়ই ছয় দিনের মধ্যে তোমার মৃত্যু হবে। তাই তোমার সকল কাজের ব্যবস্থা সম্পন্ন কর এবং তোমার পর কাউকে নিজের স্থলাভিষিক্ত হিসেবে নিযুক্ত করতে কোনো ওয়াসিয়্যত করো না। কারণ গায়েবাতে কুবরা শুরু হতে যাচ্ছে। এখন থেকে আল্লাহ তা'লার নির্দেশ ছাড়া আমার কোনো প্রকাশ ঘটবে না। আর তা ঘটবে দীর্ঘ সময় পর, যখন মানুষের হৃদয় কঠিন হয়ে যাবে এবং পৃথিবী জুলুমে পরিপূর্ণ হবে...
[আল-গায়বা, শেখ তুসী, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ৩৯৫)]
অতএব, ৩২৯ হিজরিতে দ্বাদশ ইমামের শেষ বিশেষ প্রতিনিধির মৃত্যুর মাধ্যমে “গায়বাতে কুবরা” বা দীর্ঘ গায়েবাতের সূচনা হয়। এই অবস্থা আজও অব্যাহত রয়েছে। যেদিন আল্লাহর ইচ্ছায় গায়েবাতের মেঘমালা সরে যাবে এবং বিশ্ব বেলায়েতের প্রোজ্জ্বল সূর্যের সরাসরি আলোয় উদ্ভাসিত হবে। ইনশাআল্লাহ।
উল্লেখ্য যে, এই পর্যায়ে ইমামের (আ.ফা.) কোনো প্রতিনিধি মনোনীত কোনো নেই। তবে রাসূল (সা.) ও আহলে বাইত (আ.)-এর হাদীস অনুসারে, উলামায়ে রাব্বানী এই যুগে ইমামের সাধারণ প্রতিনিধির দায়িত্ব পালন করেন।
أما الحوادث الواقعة فارجعوا فيها إلى رواة حديثنا فإنهم حجتي عليكم وأنا حجة الله
ঘটনাবলীতে আমাদের হাদীসের বর্ণনাকারীদের (উলামা) দিকে ফিরে যাও, কেননা তারা তোমাদের উপর আমার হুজ্জাত এবং আমি আল্লাহর হুজ্জাত।
[ওয়াসায়েলুশ শিয়া, ২৭/১৪]
আপনার কমেন্ট