হাওজা নিউজ এজেন্সি: এই সাক্ষাৎকারে ধর্ম ও নতুন আধ্যাত্মিক প্রবণতার বিশেষজ্ঞ মোহাম্মদ জাওয়াদ নাসিরির সঙ্গে এসব আন্দোলনের ঝুঁকি, যেমন: স্বেচ্ছাচারিতা, ঐতিহ্যগত ঈশ্বর ধারণার অস্বীকৃতি এবং সেগুলোর অফিসিয়াল ধর্মের বিকল্প হয়ে উঠার সম্ভাব্য পরিণতি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
নতুন ধর্মের আবির্ভাব কেন?
নতুন ধর্ম বা আধ্যাত্মিকতার উত্থান বুঝতে হলে আমাদের সামাজিক ও চিন্তাশীল প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করতে হবে। এই আন্দোলনগুলোকে দার্শনিক পরিভাষায় “নতুন ধর্ম”, সমাজবিজ্ঞানে “ছদ্ম আধ্যাত্মিক আন্দোলন” এবং নেতৃত্বতত্ত্বে “আধুনিক সুফিবাদ” বলা হয়। এগুলোর উৎপত্তি মূলত পাশ্চাত্য সমাজে গভীর ধর্মীয় ও রাজনৈতিক সংকট থেকে।
বিশেষ করে ক্যাথলিক চার্চ এবং ভ্যাটিকানে এক সময় ধর্ম ন্যায়ের পক্ষে না দাঁড়িয়ে অত্যাচারী রাজতন্ত্রের পাশে অবস্থান নেয়। এটি মানবিক ফিতরাতের বিরুদ্ধে যায়—মানব মনের ভেতরে ন্যায়ের পক্ষে ও অবিচারের বিরুদ্ধে যে অন্তর্নিহিত ধ্বনি রয়েছে, তা এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে।
আধুনিক যুগে আধ্যাত্মিকতা খোঁজার চেষ্টা
একই সময়ে, চার্চ ধনী ও লোভী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয় এবং বিজ্ঞানের বিরোধিতা শুরু করে—নিউটনের ঘটনাই তার উদাহরণ। এরপর প্রযুক্তিগত উন্নয়ন শুরু হয়, যা একদিকে মানুষের আরাম নিশ্চিত করলেও অন্যদিকে ধর্ম ও আধ্যাত্মিকতার ওপর প্রশ্ন তোলে।
বাইবেলের কর্তৃত্ব এবং এমনকি যীশুর ঐতিহাসিক অস্তিত্ব নিয়েও সংশয় সৃষ্টি হয়। ফলে এক ধরনের সামগ্রিক সংশয়বাদ ছড়িয়ে পড়ে, যা কেবল বুদ্ধিজীবীদের নয়, সাধারণ মানুষের মধ্যেও শিকড় গাঁড়ে।
বিজ্ঞান ও অর্থনৈতিক অগ্রগতি মানুষকে ‘পার্থিব স্বর্গের’ আশ্বাস দিলেও মানসিক শান্তি দিতে পারেনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও হিরোশিমার পরমাণু বোমা এই বাস্তবতার জানান দেয়: বিজ্ঞান স্বর্গ নয়, নরক সৃষ্টি করেছে। এর ফলে মানুষ আবার আধ্যাত্মিকতার দিকে ফিরে তাকাতে থাকে।
তবে যেহেতু ঐতিহ্যগত খ্রিস্টধর্ম গ্রহণযোগ্য ছিল না, মানুষ বিকল্প খুঁজতে থাকে। মূলধারার পুঁজিবাদী ব্যবস্থাও কিছু ‘অনুকূল’ নতুন ধর্মীয় ধারাকে সমর্থন করে, যেগুলো তাদের আদর্শের সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়।
এই প্রবণতা ইরানে কবে থেকে প্রবেশ করে এবং বর্তমানে এর বিস্তার কতটুকু?
ইরান কিছু সময় পর্যন্ত এই ঢেউ থেকে মুক্ত ছিল। কিন্তু গণমাধ্যম ও তুলনামূলক স্বাধীনতা বাড়ার ফলে (বিশেষত খাতামি সরকারের পর), এসব নতুন আধ্যাত্মিক ধারা দেশে প্রবেশ করে। বর্তমানে এ ধরনের ধারার সংখ্যা কয়েক হাজার থেকে প্রায় দুই লক্ষ পর্যন্ত হতে পারে। স্থানীয় গবেষণায় প্রায় ৩০০টি বিভ্রান্তিমূলক আধ্যাত্মিক ধারার অস্তিত্ব পাওয়া গেছে।
এই আন্দোলনের ঝুঁকি কী?
এই নতুন ধারার ধর্মীয়তা প্রথাগত ধর্ম থেকে ভিন্ন এক সামাজিক ও আত্মকেন্দ্রিক ধারা সৃষ্টি করেছে।
প্রধান ঝুঁকিসমূহ:
- স্বেচ্ছাচারিতা ও নৈতিক বিধিনিষেধের অনুপস্থিতি,
- ভোগবাদী ও বস্তুবাদী জীবনশৈলীর প্রচার,
- এমনকি জ্বিন বা শয়তানপূজাকে আধ্যাত্মিকতার অংশ হিসেবে দেখা,
- মাদক সেবনকে আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা হিসেবে উপস্থাপন,
- অতিপ্রাকৃত মনস্তত্ত্বকে আধ্যাত্মিকতা হিসেবে গ্রহণ,
- ধর্মীয় কাঠামো ছাড়াই 'আধ্যাত্মিকতা'র দাবিদার হওয়া,
- ঈশ্বরের অস্বীকৃতি অথবা সংশয়বাদ(অ্যাগনস্টিকিজম)।
এই আন্দোলনে আধ্যাত্মিকতার সামাজিক রূপ থেকে ব্যক্তিকেন্দ্রিক (নফসী) রূপে রূপান্তর ঘটে। অনেকেই এটিকে বিদ্যমান ধর্মের একটি নব সংস্করণ মনে করলেও, এর ধর্মের বিকল্প হয়ে উঠার সম্ভাবনা বাস্তব ও বিপজ্জনক।
এই নতুন সুফিবাদ কি মানুষকে ঈশ্বরের কাছে পৌঁছে দিতে পারে?
এই নতুন ধারার ঈশ্বর ঐতিহ্যগত ঈশ্বর থেকে সম্পূর্ণ আলাদা।
উদাহরণস্বরূপ, নিউ থট দর্শনে ঈশ্বরকে বাইরের সত্তা নয় বরং মানুষের মনের ভেতরের শক্তি হিসেবে দেখা হয়। বারবারা মার্শাল বলেন, অতীতে মানুষ অনবিকশিত মনোবলকে বাইরের এক ঈশ্বরের রূপ দিয়েছিল; কিন্তু আধুনিক সময়ে সেই শক্তিকে নিজের ভিতরেই খুঁজে পায়।
এই ধারার একজন প্রচারক যেমন হোসেইন আব্বাসমানেশ, একজন ‘ব্যক্তিগত ঈশ্বর’ তৈরি করার কথা বলেন—যে ঈশ্বর কেবল ব্যক্তিগত উপকারে আসে।
এটি একটি কৃত্রিম ও প্রয়োগমুখী ঈশ্বর; যে না ওহির মাধ্যমে এসেছে, না আধ্যাত্মিক উপলব্ধির মাধ্যমে।
পাওলো কোয়েলহোর মতো লেখকরা পূর্বনির্ধারিত জীবনের অর্থকে অস্বীকার করে, ‘ব্যক্তিগত কিংবদন্তি’ সৃষ্টি করার কথা বলেন। ঈশ্বরকেও খুঁজে বের করার নয়, বরং গড়ে তোলার বিষয় হিসেবে দেখেন।
আপনার কমেন্ট