হাওজা নিউজ এজেন্সি: ইমাম মাহদী (আ.ফা.)-এর আবির্ভাবের কিছু শর্ত ও নিদর্শন রয়েছে, যেগুলোকে আবির্ভাবের পটভূমি (শর্ত) এবং আলামত হিসেবে উল্লেখ করা হয়। এ দুটির মধ্যে পার্থক্য হলো—পটভূমি বা শর্তগুলো আবির্ভাবের উপর বাস্তব প্রভাব রাখে। অর্থাৎ, সেগুলো পূরণ হলে ইমামের আবির্ভাব ঘটবে, আর পূরণ না হলে আবির্ভাব বিলম্বিত হবে। কিন্তু আলামত বা নিদর্শনগুলো আবির্ভাবের ঘটনায় কোনো ভূমিকা রাখে না; বরং সেগুলো কেবল এমন কিছু চিহ্ন যা দ্বারা আবির্ভাব বা তার নিকটবর্তী সময় সম্পর্কে জানা যায়।
এই পার্থক্য থেকে স্পষ্টভাবে বোঝা যায় যে, পটভূমি ও শর্তসমূহ নিদর্শন বা আলামতের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাই আমাদের উচিত নিদর্শন খোঁজার চেয়ে বেশি মনোযোগ দেওয়া শর্ত ও পটভূমি পূরণের দিকে এবং সাধ্যমতো তা বাস্তবায়নে চেষ্টা করা। এজন্যই আমরা প্রথমে আবির্ভাবের পটভূমি ও শর্ত নিয়ে আলোচনা করব।
আবির্ভাবের পটভূমি
বিশ্বের প্রতিটি ঘটনা বা বস্তুই তার শর্ত ও পটভূমি পূরণ হওয়ার পরেই অস্তিত্ব লাভ করে। কোনো শর্ত পূরণ ছাড়া কোনো কিছুরই অস্তিত্ব সম্ভব নয়। প্রতিটি জমি বীজ উৎপাদনের উপযোগী নয়, আর প্রতিটি আবহাওয়া সব গাছ বা উদ্ভিদের বৃদ্ধির জন্য উপযুক্ত নয়। একজন কৃষক তখনই ভালো ফসল আশা করতে পারে যখন সে জমিতে ফসল উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় সব শর্ত পূরণ করে।
এভাবেই প্রতিটি বিপ্লব বা সামাজিক ঘটনাও তার পটভূমি ও শর্তের উপর নির্ভর করে। ইমাম মাহদী (আ.ফা.)-এর বিশ্বব্যাপী বিপ্লব, যা সবচেয়ে বড় বৈশ্বিক আন্দোলন, সেও এই নীতির অনুসারী। এর শর্ত ও পটভূমি পূরণ ছাড়া এটি সংঘটিত হবে না।
এই কথার অর্থ হলো—এটা ভাবা যাবে না যে ইমাম মাহদী (আ.ফা.)-এর আন্দোলন ও শাসন বিশ্ব সৃষ্টির নিয়ম থেকে ব্যতিক্রম, এবং তাঁর সংশোধনমূলক আন্দোলন কোনো অলৌকিক উপায়ে বা প্রাকৃতিক কারণ ছাড়াই সফল হবে। বরং কুরআন ও মাসুম ইমামগণ (আ.)-এর শিক্ষা অনুযায়ী, আল্লাহর বিধান হলো—বিশ্বের সব কাজ প্রাকৃতিক নিয়মে ও সাধারণ কারণ-কার্য অনুসারে সম্পন্ন হয়।
ইমাম জাফর সাদিক (আ.) এ বিষয়ে বলেছেন,
أَبَی اَللَّهُ أَنْ یُجْرِیَ اَلْأَشْیَاءَ إِلاَّ بِأَسْبَابٍ
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ'লা সব কিছুকে কারণ-কার্যের মাধ্যমেই পরিচালনা করেন। [আল-কাফি, খণ্ড- ১, পৃষ্ঠা- ১৮৩]
অবশ্য, এর অর্থ এই নয় যে মাহ্দাভী বিপ্লবে কোনো ঐশী সাহায্য বা স্বর্গীয় সহায়তা থাকবে না। বরং উদ্দেশ্য হলো—ঐশী সাহায্যের পাশাপাশি সাধারণ শর্ত, কারণ ও পটভূমিও পূরণ হতে হবে।
ইমাম মাহদী (আ.ফা.)-এর মহান বিপ্লব ও বিশ্বব্যাপী আন্দোলনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পটভূমি চারটি। আমরা প্রতিটি আলাদাভাবে আলোচনা করব:
ক. পরিকল্পনা ও কর্মসূচি
স্পষ্ট যে, প্রতিটি সংশোধনমূলক আন্দোলন ও বিপ্লবের জন্য দুটি কর্মসূচি প্রয়োজন:
১. বিদ্যমান অসঙ্গতিগুলোর বিরুদ্ধে সংগ্রামের জন্য একটি সামগ্রিক পরিকল্পনা, যা জনশক্তিকে সংগঠিত করবে।
২. একটি পূর্ণাঙ্গ ও সামগ্রিক আইন, যা সমাজের সব প্রয়োজন পূরণ করবে, একটি ন্যায়ভিত্তিক শাসনব্যবস্থায় ব্যক্তি ও সমষ্টির সব অধিকার নিশ্চিত করবে এবং আদর্শ অবস্থায় পৌঁছানোর জন্য সমাজের অগ্রগতির পথ নির্দেশ করবে।
কুরআন কারীম ও মাসুম ইমামগণ (আ.)-এর শিক্ষা, যা মূলত বিশুদ্ধ ইসলাম, তা হলো সর্বোত্তম আইন ও কর্মসূচি, যা ইমাম যামানা (আ.ফা.)-এর কাছে রয়েছে। তিনি এই চিরন্তন ঐশী ম্যানিফেস্টো অনুসারে কাজ করবেন। এটি এমন একটি গ্রন্থ, যার আয়াতসমূহ আল্লাহ তা'আলা নাযিল করেছেন, যিনি মানুষের জীবনের সব দিক ও তার জাগতিক ও আধ্যাত্মিক প্রয়োজন সম্পর্কে পূর্ণ অবগত। তাই, তাঁর বৈশ্বিক বিপ্লব কর্মসূচি ও শাসনতান্ত্রিক আইনের দিক থেকে একটি অতুলনীয় ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে, যা অন্য কোনো সংশোধনমূলক আন্দোলনের সাথে তুলনীয় নয়। এর প্রমাণ হলো—আজকের বিশ্ব মানুষের তৈরি আইনের অভিজ্ঞতা লাভের পর তাদের দুর্বলতা ও অক্ষমতা স্বীকার করেছে এবং ধীরে ধীরে ঐশী আইন গ্রহণের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে।
খ. নেতৃত্ব
সব আন্দোলনের জন্য নেতা থাকা অত্যাবশ্যক এবং আন্দোলন যত বড় ও উচ্চ লক্ষ্যসম্পন্ন হবে, তার নেতৃত্বও তত বেশি সক্ষম ও সেই লক্ষ্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে।
অত্যাচার ও জুলুমের বিরুদ্ধে বৈশ্বিক সংগ্রাম এবং পৃথিবীতে ন্যায়বিচার ও সমতা প্রতিষ্ঠার পথে একজন সচেতন, সক্ষম ও দয়ালু নেতার প্রয়োজন, যার সঠিক ও দৃঢ় ব্যবস্থাপনা দক্ষতা আছে। এটিই হলো বিপ্লবের মূল স্তম্ভ। ইমাম মাহদী (আ.), যিনি নবী ও ওলীদের সারাংশ, তিনি এই মহান বিপ্লবের নেতা হিসেবে জীবিত ও উপস্থিত। তিনিই একমাত্র নেতা, যিনি গায়েবের জগতের সাথে সংযুক্ত থাকার কারণে সৃষ্টিজগত ও তার সম্পর্কসমূহ সম্পর্কে পূর্ণ অবগত। তিনি তাঁর সময়ের সবচেয়ে জ্ঞানী মানুষ।
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,
أَلَا إِنَّهُ وَارِثُ کُلِّ عِلْمٍ وَ الْمُحِیطُ بِکُلِّ فَهْمٍ
সাবধান! তিনি (মাহদী) সব জ্ঞানের উত্তরাধিকারী এবং সব বোধের উপর পূর্ণ অধিকারী।” [গাদীর খুতবা]
গ. সহযোগী
আবির্ভাবের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হলো—আন্দোলনকে সমর্থন ও সরকারি কাজ পরিচালনার জন্য যোগ্য ও উপযুক্ত সহযোগীদের উপস্থিতি। স্বাভাবিক যে, যখন একজন ঐশী নেতৃত্বে বৈশ্বিক বিপ্লব ঘটে, তখন তার জন্য সেই স্তরের সহযোগী প্রয়োজন। এটা এমন নয় যে, যে কেউ সহযোগী হতে চাইলেই সে এই মাঠে প্রবেশ করতে পারবে।
ঘ. সাধারণ প্রস্তুতি
ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে মাসুম ইমামগণ (আ.)-এর সময় এই সত্য দেখা গেছে যে, মানুষ ইমামের উপস্থিতির সঠিক ব্যবহারের জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি রাখে না। তারা বিভিন্ন সময়ে মাসুমের উপস্থিতির মর্যাদা দেয়নি এবং তাঁর হেদায়াতের উৎস থেকে যথাযথভাবে উপকৃত হয়নি। আল্লাহ তা'আলা শেষ হুজ্জাতকে গায়েব করে রেখেছেন, যাতে যখনই তাঁর জন্য সাধারণ মানুষের প্রস্তুতি তৈরি হবে, তখন তিনি প্রকাশিত হবেন এবং সবাইকে ঐশী জ্ঞানের উৎস থেকে সিক্ত করবেন।
তাই, প্রস্তুতি থাকা আবির্ভাবের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শর্ত এবং এর মাধ্যমেই তাঁর সংশোধনমূলক আন্দোলন কাঙ্ক্ষিত ফলাফলে পৌঁছাবে। আবির্ভাব তখনই ঘটবে যখন সবাই গভীরভাবে সামাজিক ন্যায়বিচার, নৈতিক ও মানসিক নিরাপত্তা এবং আধ্যাত্মিক বিকাশ ও সমৃদ্ধি কামনা করবে।
স্বাভাবিক যে, ইমামের উপস্থিতি লাভের আকাঙ্ক্ষা তখনই চরমে পৌঁছায় যখন মানবতা বিভিন্ন মানবসৃষ্ট সরকার ও ব্যবস্থার অভিজ্ঞতা লাভের পর এই সত্য উপলব্ধি করে যে, পৃথিবী থেকে ফ্যাসাদ ও ধ্বংসের হাত থেকে একমাত্র মুক্তিদাতা হলেন আল্লাহর খলিফা ও পৃথিবীর প্রতিনিধি হযরত মাহদী (আ.ফা.) এবং একমাত্র সেই কর্মসূচিই মানুষের জন্য পবিত্র ও সুন্দর জীবন বয়ে আনবে, যা হল আল্লাহর আইন। তখনই তারা হৃদয় দিয়ে ইমামের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে এবং এই উপলব্ধির পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর আবির্ভাবের শর্ত পূরণের জন্য চেষ্টা করে ও বাধাগুলো দূর করে। আর তখনই আসে ফারাজ ও মুক্তি।
রাসূলুল্লাহ (সা.) একটি হাদীসে বলেছেন,
... حَتَّی لاَ یَجِدُ اَلرَّجُلُ مَلْجَأً یَلْجَأُ إِلَیْهِ مِنَ اَلظُّلْمِ، فَیَبْعَثُ اَللَّهُ رَجُلاً مِنْ عِتْرَتِی...
... এমন সময় আসবে যখন কোনো মুমিন ব্যক্তি জুলুম থেকে রক্ষা পেতে কোনো আশ্রয়স্থল পাবে না। তখন আল্লাহ তা'আলা আমার বংশধর থেকে একজন ব্যক্তিকে প্রেরণ করবেন...” [ইসবাতুল হুদা, খণ্ড- ৫, পৃষ্ঠা- ২৪৪]
এই আলোচনা অব্যাহত থাকবে...
গ্রন্থনা: ‘নেগীনে অফারীনেশ’ (প্রয়োজনীয় সংযোজন ও পরিমার্জন সহকারে)
আপনার কমেন্ট