হাওজা নিউজ এজেন্সি’কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে হুজ্জাতুল ইসলাম হুজতুল্লাহ সারূরী আশুরার দশটি গুরুত্বপূর্ণ দিক উপস্থাপন করে ইসলামী বিপ্লবের সাথে তার আদর্শগত মিল ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি বলেন—ইসলামী বিপ্লবের চিন্তাধারার মূল শিকড়ই হলো আশুরার দর্শন।
তিনি বলেন, “আশুরার বিপ্লবী ভাবনার পুনর্গঠনই আজকের পৃথিবীতে ‘ইরান-হুসাইন’ বার্তার সারকথা। এটি কেবল একটি বাণী নয়, বরং মুক্তিকামীদের জন্য পথনির্দেশ, শিক্ষা ও আদর্শ।”
তিনি আশুরাভিত্তিক দশটি মূল দর্শন উপস্থাপন করেন:
১. ইমাম হুসাইন (আ.) প্রকৃত বিজয়ী
ইমাম হুসাইন (আ.)-এর রক্তধারা ১৪০০ বছর ধরে বিশ্বে পরিবর্তন ও জাগরণের প্রতীক। তাঁর শাহাদাত মানবতা, অধিকার ও স্বাধীনতার আলো বহন করে।
২. শত্রুর মুখোশ উন্মোচন ও মুসলিম জাগরণের সূচনা
কারবালা কেবল যুদ্ধ ছিল না, বরং একটি বুদ্ধিবৃত্তিক বিপ্লব, যা সত্য-মিথ্যার সীমারেখা স্পষ্ট করে দেয় এবং গোটা মুসলিম জাহানকে জাগিয়ে তোলে।
৩. আশুরা: যুক্তি, প্রতিরোধ ও আবেগের একত্র প্রকাশ
কারবালা একত্রে তিনটি উপাদান বহন করে—যুক্তি, প্রতিরোধচেতনা, ও আবেগ ও হৃদয়ের উচ্ছ্বাস। এই তিনের সমন্বয়েই গড়ে ওঠে আশুরার সম্পূর্ণ রূপ।
৪. হুসাইনি শিক্ষায় গড়ে ওঠা প্রতিরোধী প্রজন্ম
ইমাম হুসাইন (আ.)-এর আন্দোলন এমন প্রজন্ম গড়ে তোলে যারা আত্মমর্যাদাসম্পন্ন, স্বাধীন ও অদম্য। ৮ বছরের চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধ বা ১২ দিনের প্রতিরোধে সেই চরিত্র প্রকাশ পেয়েছে। এরা কখনো কারও কাছে মাথা নত করে না।
“রক্ত দেওয়া সম্ভব, জীবনও দেওয়া সম্ভব, কিন্তু মাটির একটি দানাও নয়।”
“কারণ এ জাতির পরিচয় গঠিত হয়েছে—‘হে হায়াত মিন্না আল-জিলা’—এর ওপর ভিত্তি করে।”
৫. আশুরার কাঠামো: বিভ্রান্তি ও স্খলন প্রতিরোধে সক্ষম
আশুরা এমন এক কাঠামো দাঁড় করায় যা ধর্ম ও নেতৃত্ববিরোধী ষড়যন্ত্র, পবিত্রতা-বিনাশ, ও ন্যায়ের অবমূল্যায়নের মুখে দাঁড়ায় এবং তা প্রতিহত করে।
৬. আশুরার আরেক দিক: প্রচারণা যুদ্ধের মোকাবিলা
কারবালা ছিল একটি আদর্শিক জয়—যেখানে ইয়াজিদি প্রোপাগান্ডার বস্ত্র ছিঁড়ে ফেলা হয় এবং তাদের শাসনের ভণ্ড ও গোঁজামিল ভিত্তিকে প্রকাশ্যে আনা হয়।
৭. আশুরা শিক্ষা দেয়: শত্রুর প্রতিশ্রুতিতে অবিশ্বাসই বুদ্ধিমানের কাজ
যেমন, শিমর যখন হযরত আব্বাস (আ.)-কে নিরাপত্তা দিতে চায়, তিনি বলেন, “তুমি আমাদের নিরাপত্তা দিতে চাও, অথচ রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সন্তান নিরাপদ নন? অভিশাপ তোমার ও তোমার নিরাপত্তার নামে!”
“আমরা কীভাবে হুসাইন (আ.)-কে ছেড়ে দিই? আমরা কখনোই অন্যায়কারীদের দলে শরিক হব না।”
আজও রাসুলের উত্তরসূরিকে হুমকি দিলে ইসলামি শরিয়ত সেই শক্তিকে ‘মুহারিব’ বা ধর্মের শত্রু হিসেবে গণ্য করে।
৮. আল্লাহর পরিকল্পনা সব ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দেয়
আল্লাহ বলেছেন, “যারা আল্লাহর পথে বাধা দেয়, তাদের সমস্ত কাজকে ধ্বংস করে দেওয়া হয়।”
এটাই আশুরার অন্যতম শিক্ষা—সত্যের পথে যারা থাকে, তারা চক্রান্তের শিকার হলেও শেষপর্যন্ত বিজয়ী হয়।
৯. ধৈর্য ও স্থিরতাই বিজয়ের মূল চাবিকাঠি
তিনি বলেন, “মহান নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ী বলেছেন: ইমাম হুসাইন হচ্ছেন بصیرت ও استقامت-এর মূর্ত প্রতীক।”
“যে জাতি নিজ অবস্থানে অটল থাকে, সে নিজস্ব পরিচয়, সংস্কৃতি ও মর্যাদা ধরে রাখতে পারে।”
তাই আজ আমাদের কর্তব্য হলো—আশুরার পথে তাওজিহ (ব্যাখ্যা), আমাদেগি (প্রস্তুতি), ও ইস্তেকামাত (দৃঢ়তা) রক্ষা করা।
وَأَن لَّوِ ٱسْتَقَـٰمُوا۟ عَلَى ٱلطَّرِيقَةِ لَأَسْقَيْنَـٰهُم مَّآءً غَدَقًۭا
— “যদি তারা সত্যের পথে অটল থাকত, আমি তাদের প্রবাহিত পানীয় দান করতাম।” (সূরা জিন: ১৬)
১০. আশুরা শিক্ষা দেয়—হতাশা হারাম, আশাবাদই পথ
আশুরা হলো দীপ্ত বাতিঘর। ইমাম হুসাইন (আ.)-এর পথ কখনো থেমে যায় না। এটি হলো এমন এক দীপ্ত রেখা—যা ওলায়াতের পথে এগিয়ে যায় এবং প্রতিটি জাতিকে মুক্তি, মর্যাদা ও উন্নতির পথে পরিচালিত করে।
উপসংহার: এই দশটি নীতির মাধ্যমে বোঝা যায়—যেখানে হুসাইনি চেতনা থাকবে, সেখানে ন্যায়ের পতাকা উড়বেই। ‘ইরান-হুসাইন’ নামটি কোনো কাব্যিক উপমা নয়, বরং এক ঐতিহাসিক বাস্তবতা—যেখানে রক্ত পরাজিত করে তলোয়ারকে, আর হৃদয়ের আগুন গলিয়ে দেয় জালিমদের সিংহাসন।
আপনার কমেন্ট