শনিবার ১২ জুলাই ২০২৫ - ২০:১৯
হযরত জয়নাব (সা.আ.) আশুরাকে অমর করে তুলেছেন

“আশুরা” কেবল শোক-স্মৃতি নয়, বরং তা এক চেতনার নাম—যা প্রতিরোধ, সচেতনতা ও সত্যপথে অটল থাকার শক্তি জোগায়। এই মহৎ ঐতিহ্যকে বহমান ও জীবন্ত করে রেখেছেন হযরত জয়নব (সা.), যিনি শুধু একজন বর্ণনাকারী ছিলেন না, ছিলেন ইমাম হুসাইন (আ.)-এর আন্দোলনের রক্ষকও।

হাওজা নিউজ এজেন্সি: এক সাক্ষাৎকারে ইরানি চলচ্চিত্র ও টিভি অভিনেত্রী আজিতা তুরকাশবন্দ কারবালা, আশুরা ও হযরত জয়নাব (সা. আ.)’র সম্পর্কে নিজের গভীর অনুভূতি ও মত প্রকাশ করেছেন:

আশুরা: ইতিহাসের কেবল অন্তর্গত নয়, চেতনার নাম
আজিতা তুরকাশবন্দ বলেন, “আশুরা কেবল ইতিহাসের একটি অধ্যায় নয়—এ এক বুদ্ধিবৃত্তিক, ঈমানি ও অস্তিত্বমূলক সংগ্রাম। আমরা যারা নিজেদের ‘ইমাম হুসাইনের অনুসারী’ বলে পরিচয় দিই, আমাদের এই দাবি যেন স্রেফ স্লোগান না হয়ে যায়, বরং তার পেছনে থাকে গভীর উপলব্ধি।”

তিনি মনে করেন, আশুরা একটি মূল্যবোধের নাম—যা সত্য, ন্যায়, আত্মত্যাগ ও প্রতিরোধকে ধারণ করে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, ইরানের মতো সাংস্কৃতিকভাবে সমৃদ্ধ দেশে আশুরা বিষয়ক শিল্পচর্চা তেমনভাবে গড়ে ওঠেনি। সিরিয়াল, সিনেমা, নাটক বা ভিজ্যুয়াল আর্ট—সবখানেই প্রয়োজনীয় গভীরতা ও আন্তরিকতা অনুপস্থিত।

শিল্পের শক্তি ও আমাদের ব্যর্থতা
“অভিনয়, সংগীত, দৃশ্যশিল্প—সবই মানুষের মনে গভীরভাবে প্রভাব ফেলে। কিন্তু আমরা এই শক্তিকে যথার্থভাবে ব্যবহার করিনি,” বলেন তুরকাশবন্দ। তাঁর মতে, হযরত জয়নব (সা.)-এর চরিত্র এক বিশাল নাট্যমঞ্চের নায়িকা—যাঁর ভাষণ, আত্মমর্যাদা ও সত্য উচ্চারণ গোটা ইতিহাসকে প্রভাবিত করেছে। এই চরিত্রকে শিল্পের ভাষায় জীবন্ত করে তোলা আমাদের দায়িত্ব।

আধুনিক প্রেক্ষাপটে আশুরার ব্যাখ্যা
আজিতা বলেন, “আশুরা শুধু ৬১ হিজরির ঘটনা নয়—এ এক চিরন্তন দ্বন্দ্ব: সত্য বনাম মিথ্যা, আলো বনাম অন্ধকার। আজকের সমাজে এই দ্বন্দ্ব চলে মিডিয়া, আগ্রাসন, আধিপত্য আর মিথ্যা প্রচারণার মাধ্যমে। শিল্পী মাত্রেই উচিত সেই চিরন্তন সত্যকে আধুনিক ভাষায় তুলে ধরা।”

শিশু-কিশোরদের জন্য আশুরার শিক্ষা কেন জরুরি
আজিতার মতে, “আমরা শিশু ও কিশোরদের জন্য ধর্মীয়, নৈতিক ও সংস্কৃতিমূলক শিক্ষার ক্ষেত্রে ভীষণ পিছিয়ে আছি। অথচ এই বয়সেই তাদের হৃদয়ে সত্য, সাহস, আত্মত্যাগের শিক্ষা বসাতে হয়। শিশুদের মানসিক গঠনে নাটক, গল্প, কবিতা, অ্যানিমেশন—সব মাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।”

তিনি বলেন, “আমার ছোটবেলার স্মৃতিতে এখনো গভীরভাবে রয়ে গেছে—রাতে দাদীর কোল ঘেঁষে ঘুমাতে যাওয়ার আগে তাঁর শেখানো দোয়া, তাঁর বলা কিসসা। এই ছোট ছোট অভিজ্ঞতা ভবিষ্যতের চরিত্র ও বিশ্বাস গঠনে গভীর ভূমিকা রাখে।”

শিল্পীর দায়িত্ব: বিশ্বাস, বোধ ও সৃজনশীলতার সেতুবন্ধন
“শিল্পী কেবল বিনোদনদাতা নয়—সে সমাজের শিক্ষক, চিন্তাশিল্পী। সে যদি আশুরার মতো গভীর একটি সত্যকে উপস্থাপন করে, তবে সেখানে তার দায়িত্ব দ্বিগুণ। তবে এই দায়িত্ব মানেই নয় যে শিল্পে সৃজনশীলতা থাকবে না—বরং সত্যিকারের সৃজনশীলতাই তো দায়িত্ববোধ থেকে জন্ম নেয়।”

আধুনিক প্রজন্মকে ছোঁয়ার ভাষা বদলাতে হবে
তুরকাশবন্দ মনে করেন, তরুণ প্রজন্মকে আকৃষ্ট করতে হলে সরাসরি বক্তৃতার ভাষা নয়, বরং গল্প, আবেগ ও অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে সেই বার্তা দিতে হবে। “যদি কোনো কিশোর এক নাটকে এমন চরিত্র দেখে, যার সিদ্ধান্ত হযরত আলী আকবর (আ.)-এর মতো সাহসী ও আদর্শিক, তবে সেই প্রভাব থাকবে অনেক গভীর।”

আশুরা কেবল একটি ট্র্যাজেডি নয়—এ এক জীবন্ত চেতনা, যা ইতিহাসকে অতিক্রম করে বর্তমান ও কিয়ামত অবধি ভবিষ্যতের সঙ্গে যুক্ত। শিল্প, বিশেষত নাট্য ও দৃশ্যশিল্পের মাধ্যমে, এই চেতনাকে নতুন প্রজন্মের হৃদয়ে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব। এক্ষেত্রে যে দায়িত্ব আজিতা তুরকাশবন্দ-এর মতো সচেতন শিল্পীরা নিয়েছেন, তা অনুসরণযোগ্য পথ হয়ে উঠতে পারে।

আপনার কমেন্ট

You are replying to: .
captcha