হাওজা নিউজ এজেন্সি: যদি বলি যে এ রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র অন্যতম, তবে ভুল হবে না। চুক্তি তাদের কাছে কখনোই কোনো নৈতিক প্রতিশ্রুতি ছিল না। বরং ছিল কৌশলগত দলিল, যেটি সুবিধা ফুরালে কেবল বাতিলই নয়, মুছে ফেলা হয় ইতিহাস থেকেই।
আদিবাসীদের সঙ্গে প্রতারণার সিলসিলা: ১৭৭৮ সাল থেকে ১৮৭১ সাল পর্যন্ত মার্কিন সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে ৫০০টিরও বেশি চুক্তি করে বিভিন্ন আদিবাসী গোষ্ঠীর সঙ্গে, যার প্রায় প্রতিটিই তারা ভঙ্গ করে। এ চুক্তিগুলো ছিল একদিকে শান্তি, অন্যদিকে ভূমি হস্তান্তরের শর্তে। আদিবাসীরা বিশ্বাস করেছিল, আমেরিকান সরকার তাদের সম্মানের সঙ্গে বসবাস করতে দেবে। কিন্তু বাস্তবে যা হয়েছে, তা ছিল নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার শ্রেণিবদ্ধ কর্মসূচি।
ট্রিটি অব ফোর্ড ল্যারামি (১৮৫১ এবং ১৮৬৮): সিউ গোষ্ঠীকে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য ব্ল্যাক হিলস দেওয়া হয়। সেখানে পরে স্বর্ণ পাওয়ার পর মার্কিন সরকার চুক্তি লঙ্ঘন করে অঞ্চলটি পুরোপুরি দখল করে নেয়। বহু আদিবাসীকে হত্যা করা হয়। এটা তথাকথিত মহান আব্রাহাম লিঙ্কন প্রশাসন আমলেও ঘটেছে (১৮৬১-১৮৬৫)।
ইন্ডিয়ান রিমুভ্যাল অ্যাক্ট (১৮৩০): চেরোকি, ক্রিক, চোকটো, চিকাসো ও সিমিনোল জাতিগোষ্ঠীর সঙ্গে পূর্বাঞ্চলে থাকার চুক্তি ছিল। কিন্তু আইনের মাধ্যমে তাদের পশ্চিমে জোরপূর্বক হেঁটে পাঠানো হয়। ইতিহাসে যা পরিচিত ‘ট্রায়াল অব টিয়ার্স’ নামে। অনাহারে, অসুস্থতায়, রোগ, অতি পরিশ্রমে, বিরূপ আবহাওয়ায় লক্ষাধিক আদিবাসী পথেই মারা যায়। আদিবাসীদের সঙ্গে করা এ রকম বহু চুক্তি ভঙ্গ করেছে আমেরিকা।
এসব চুক্তিভঙ্গ শুধু একটি জনগোষ্ঠীর জমি কেড়ে নেয়নি, কেড়ে নিয়েছে তাদের আত্মপরিচয়, ভাষা, সংস্কৃতি ও প্রজন্মের স্মৃতি। আমেরিকার সৌন্দর্যমাখা পথে-ঘাটে লুকিয়ে আছে আদিবাসীদের রক্ত, স্মৃতি আর কান্নার ইতিহাস।
কিউবা-যুক্তরাষ্ট্র চুক্তি: ১৯০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও কিউবার মধ্যে এক চুক্তি হয়, যেখানে কিউবা সাময়িকভাবে যুক্তরাষ্ট্রকে গুয়ানতানামো বে শুধু নৌবাহিনীর স্টেশন হিসাবে ব্যবহারের অনুমতি দেয়। চুক্তির শর্ত ছিল উভয়পক্ষের সম্মতিতে তা বাতিলযোগ্য।
কিন্তু কিউবা বহুবার চুক্তি বাতিলের দাবি জানালেও যুক্তরাষ্ট্র তা ‘নিশ্চুপ ঔদ্ধত্যে’ উপেক্ষা করেছে। আজ গুয়ানতানামো শুধু নৌঘাঁটি নয়, বরং অমানবিক নির্যাতনের বন্দিশিবির, যেখানে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার চুক্তির ধারাও লঙ্ঘিত হয়।
পরমাণু চুক্তি ও ইরানের সঙ্গে প্রতারণা: যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন, রাশিয়া, ফ্রান্স ও জার্মানি মিলে ২০১৫ সালে ইরানের সঙ্গে একটি ঐতিহাসিক চুক্তি করে। জয়েন্ট কমপ্রিহেনসিভ প্লান অব অ্যাকশন (জেসিপিওএ) চুক্তির শর্তে ইরান পারমাণবিক কার্যক্রম সীমিত করে, পরিদর্শনের সুযোগ দেয় এবং বিনিময়ে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা শিথিল হয়। কিন্তু ২০১৮ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্প একতরফাভাবে চুক্তি থেকে সরে যান, বিনা প্রমাণে বলেন, ‘এই চুক্তি একটি বিপর্যয়।’
ইরান তখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বলেছিল: ‘আমেরিকা যদি এটি নিজেই এটি ভঙ্গ করে, তবে অন্যরা কেন তাদের বিশ্বাস করবে?’
ইরাক ও লিবিয়া: প্রতিশ্রুতি দিয়ে ধ্বংস: ইরাক (২০০৩) : জাতিসংঘ চুক্তি অনুসারে আগ্রাসন বৈধ নয়, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র ‘ডব্লিউএমডি’ (গণবিধ্বংসী অস্ত্র) থাকার মিথ্যা অভিযোগ তুলে ইরাকে হামলা চালায়। চুক্তি না মেনে রাষ্ট্রটি ধ্বংস করে, আর পরে স্বীকার করে ‘সেখানে কোনো গণবিধ্বংসী অস্ত্র নেই।’
লিবিয়া (২০১১): যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয়দের দেওয়া নিরাপত্তা প্রতিশ্রুতির ভিত্তিতে মুয়াম্মার গাদ্দাফি ২০০৩ সালে পারমাণবিক অস্ত্র পরিত্যাগ করেন। কিন্তু ২০১১ সালে ন্যাটো হামলা করে তাকে হত্যা করে। বিশ্ববাসী বুঝে গেল, ‘যে রাষ্ট্র পারমাণবিক অস্ত্র রাখে না, সেই রাষ্ট্রই বেশি বিপদে পড়ে, যদি তার প্রতিপক্ষ হয় আমেরিকা।’
বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক চুক্তি: সুবিধা শেষ, চুক্তি শেষ: ডব্লিউটিও এবং এনএএফটিএ : যুক্তরাষ্ট্র বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) সদস্য হয়েও একাধিকবার একতরফাভাবে শুল্ক আরোপ করেছে, যা চুক্তিবিরোধী। এনএএফটিএ (নর্থ আমেরিকান ফ্রি ট্রেড এগ্রিমেন্ট) ত্যাগ করে ইউএসএমসিএ চালু করে পুরোনো অংশীদারদের সঙ্গে আলোচনা ছাড়াই।
প্যারিস (জলবায়ু) চুক্তি: বারাক ওবামা প্রশাসনে যুক্তরাষ্ট্র জলবায়ু চুক্তিতে সই করলেও ট্রাম্প তা থেকে বেরিয়ে যান। এতে বিশ্বব্যাপী পরিবেশ আন্দোলনে বিরাট ধাক্কা লাগে।
আমেরিকার চুক্তির দর্শন : কেবলই কাগজে লিখা: যুক্তরাষ্ট্র যে কৌশলে চুক্তি করে তা হলো- ১. যখন দুর্বল, তখন চুক্তি করে। ২. যখন সমান, তখন চুক্তির ভাষা নিয়ন্ত্রণ করে। ৩. যখন শক্তিশালী, তখন চুক্তিকে কাগজ মনে করে।
এটাই তাদের ব্যবহারিক বাস্তববাদ ‘রিয়েলপলিটিক’। তারা চুক্তিকে ‘বাধ্যবাধকতামূলক’ মনে করে না, বরং মনে করে ‘মেয়াদ-সংবলিত বিকল্প।’
চুক্তি ভঙ্গ শুধু রাজনৈতিক পদক্ষেপ নয়, বরং রাষ্ট্রীয় চরিত্রের প্রতিফলন। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস বলে, তারা কখনোই চুক্তিকে শেষ কথা মনে করেনি। তাদের কাছে প্রতিশ্রুতি হলো ‘আলোচনার হাতিয়ার। এটি পালন করার কোনো বাধ্যবাধকতাপূর্ণ বিষয় নয়।’
আজ যারা আমেরিকার সঙ্গে চুক্তি করছে, তারা যেন মাথায় রাখে, চুক্তির নিচে একটি লুকানো লাইন থাকে: ‘চুক্তি ভঙ্গ করার অধিকার আমাদের আছে।’
মধ্যপ্রাচ্য কী ভাবছে! তারা কি আমেরিকার চুক্তির ইতিহাস পড়েছে কখনো? পৃথিবীর শান্তিকামী মানুষেরা মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে আমেরিকার প্রতারণাকে স্বাগত জানাতে অপেক্ষা করছে!
সাইফুল খান : ইতিহাস, রাজনীতি ও আন্তর্জাতিকবিষয়ক বিশ্লেষক
আপনার কমেন্ট