বুধবার ৩০ জুলাই ২০২৫ - ১৮:৩৩
ইরানভীতি ও আমেরিকা-ইসরাইলের আরব বিশ্বে প্রভাব বিস্তারের কৌশল

আন্তর্জাতিক ভূরাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গন হলো মধ্যপ্রাচ্য। এই অঞ্চল দীর্ঘদিন ধরে যুক্তরাষ্ট্র, ইসরাইল এবং ইরানের কৌশলগত দ্বন্দ্বে উত্তপ্ত। এখানে “ইরানভীতি” একটি কেন্দ্রীয় ভূমিকায় আবির্ভূত হয়েছে। ইসরাইল ও আমেরিকা এই ভীতি ব্যবহার করে আরব রাষ্ট্রগুলোতে প্রভাব বিস্তার, সামরিক চুক্তি, অস্ত্র বিক্রি ও কূটনৈতিক পুনর্গঠন করছে।

হাওজা নিউজ এজেন্সি: আজকের এই গবেষণায় আমরা বিশ্লেষণ করব, কীভাবে “ইরান-হুমকি”কে ব্যবহার করে আমেরিকা ও ইসরাইল আরব বিশ্বকে নিজেদের প্রভাববলয়ে নিয়ে আসছে।

১. ইরানভীতির ধারণা: উৎপত্তি ও প্রচার
“ইরানভীতি” বা Iranophobia মূলত একটি রাজনৈতিক মনস্তত্ত্ব ও কৌশল, যা ইরানকে মধ্যপ্রাচ্যের প্রধান হুমকি হিসেবে চিহ্নিত করে।
এর মূল উপাদান:

- আহলে বাইতের নেতৃত্ব অনুসরণ মতবাদের বিস্তার

- ইরানের বিপ্লব রপ্তানির আদর্শ

- পরমাণু অস্ত্র অর্জনের আশঙ্কা

- ইরানপন্থী মিলিশিয়া (হিজবুল্লাহ, হুথি, পিএমইউ ইত্যাদি)

প্রচারের মাধ্যম:
পশ্চিমা ও আরব মিডিয়াতে নিয়মিতভাবে ইরানকে ‘নিউক্লিয়ার হুমকি’ ও ‘সন্ত্রাসী রাষ্ট্র’ হিসেবে তুলে ধরা।

ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্রের নেতারা রাজনৈতিক বক্তৃতায় ইরানকে ‘অস্থিতিশীলতা ও সন্ত্রাসের উৎস’ বলে আখ্যা দেন।

২. সামরিক ও নিরাপত্তা কৌশল

▫️মার্কিন পদক্ষেপ: উপসাগরীয় অঞ্চলে স্থায়ী সামরিক ঘাঁটি: সৌদি আরব, কুয়েত, কাতার, বাহরাইন ইত্যাদিতে।

ইরানবিরোধী যুক্তি দেখিয়ে THAAD, Patriot, F-35, ড্রোন সিস্টেমসহ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র বিক্রি।

ইসরাইলি ভূমিকা: সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ গাল্ফ দেশগুলোর সঙ্গে গোপনে গোয়েন্দা তথ্য বিনিময়।

হুথিদের ড্রোন হামলা প্রতিরোধে ইসরাইলি প্রযুক্তি ও নজরদারি।

লক্ষ্য: আরব দেশগুলোকে নিরাপত্তা নির্ভরতায় বেঁধে রাখা।

৩. কূটনৈতিক প্রভাব ও স্বাভাবিকীকরণ (Normalization)

▫️আব্রাহাম চুক্তি (2020): আমিরাত, বাহরাইন, মরক্কো, সুদান ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেয়।

চুক্তির পেছনে যুক্তি ছিল: ইরান হুমকি মোকাবেলায় ঐক্য দরকার।

▫️সৌদি আরবের অবস্থান:
প্রকাশ্যে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পূর্বশর্ত দিলেও, নেপথ্যে ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের আলোচনা চালায় এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে দু'দেশের সহযোগিতামূলক বোঝাপড়া রয়েছে।

লক্ষ্য:  ইসরাইলকে আরব বিশ্বে বৈধতা প্রদান ও ফিলিস্তিন ইস্যুকে দুর্বল করা।

৪. অর্থনৈতিক চুক্তি ও বিনিয়োগ কৌশল
আমেরিকা ও ইসরাইল আরব দেশগুলোকে টেকনোলজি, সাইবার সিকিউরিটি, কৃষি ও পারমাণবিক প্রযুক্তি সরবরাহের প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাদেরকে ইরানের বিরুদ্ধে অবস্থান করতে বাধ্য করে।

সৌদি ভিশন ২০৩০-এর অংশ হিসেবে সৌদি আরব পশ্চিমা বিনিয়োগের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে।

লক্ষ্য: অর্থনৈতিক অংশীদারিত্বের মাধ্যমে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করা।

৫. প্রপাগান্ডা ও জনমত নিয়ন্ত্রণ
ইরানকে “সন্ত্রাসের উৎস”, “শিয়া সাম্রাজ্য”, “নিউক্লিয়ার হুমকি” হিসেবে আরব জনমনে প্রচার করা হয়। আরব মিডিয়ায় (যেমন: আল-আরাবিয়া, গাল্ফ নিউজ) ইরানবিরোধী প্রচার জোরদার করা হয়।

লক্ষ্য: ইরানবিরোধী জনমত তৈরি করে সরকারগুলোর কৌশলগত সিদ্ধান্তে জনসমর্থন নিশ্চিত করা।

৬. প্রক্সি যুদ্ধ ও সংঘাত ব্যবস্থাপনা
উদাহরণ: ইয়েমেনে সৌদি নেতৃত্বাধীন জোট হুথিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে, যাদের “ইরানের প্রক্সি” বলা হয়।

সিরিয়া, লেবানন ও ইরাকে ইরানপন্থী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে আমেরিকা ও ইসরাইলের সমর্থন এবং আরব দেশ গুলোর ইরানের বিরুদ্ধে আমেরিকার জোটের সাথে সহাবস্থান করে।

লক্ষ্য: ইরান-সমর্থিত শক্তিগুলিকে দুর্বল করা এবং অঞ্চলজুড়ে নিজেদের প্রভাব প্রতিষ্ঠা।

পরিসমাপ্তি: “ইরানভীতি” হলো এক বহুমাত্রিক কৌশল, যা সামরিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিক উপায়ে ব্যবহৃত হচ্ছে। এর মাধ্যমে আমেরিকা ও ইসরাইল: আরব দেশগুলোর উপর কৌশলগত প্রভাব বজায় রাখছে, ইসরাইলকে আরব দুনিয়ায় স্বীকৃতি দিচ্ছে, অস্ত্র বিক্রি ও নিরাপত্তা ব্যবসা চালু রাখছে।

এই কৌশল মধ্যপ্রাচ্যের আঞ্চলিক ক্ষমতার ভারসাম্যকে একতরফাভাবে প্রভাবিত করছে এবং ফিলিস্তিন ইস্যুকে ধীরে ধীরে পেছনে ঠেলে দিচ্ছে।

সূত্র (সাধারণ তথ্যের উৎস):

১. Brookings Institution reports

২. Al Jazeera, Middle East Eye, Reuters

৩. US State Department press releases

৪. Gulf Intelligence reports

৫. The Abraham Accords official documents

লিখেছেন- হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমিন জনাব আলী নওয়াজ খান

আপনার কমেন্ট

You are replying to: .
captcha