হাওজা নিউজ এজেন্সি: আজকের এই গবেষণায় আমরা বিশ্লেষণ করব, কীভাবে “ইরান-হুমকি”কে ব্যবহার করে আমেরিকা ও ইসরাইল আরব বিশ্বকে নিজেদের প্রভাববলয়ে নিয়ে আসছে।
১. ইরানভীতির ধারণা: উৎপত্তি ও প্রচার
“ইরানভীতি” বা Iranophobia মূলত একটি রাজনৈতিক মনস্তত্ত্ব ও কৌশল, যা ইরানকে মধ্যপ্রাচ্যের প্রধান হুমকি হিসেবে চিহ্নিত করে।
এর মূল উপাদান:
- আহলে বাইতের নেতৃত্ব অনুসরণ মতবাদের বিস্তার
- ইরানের বিপ্লব রপ্তানির আদর্শ
- পরমাণু অস্ত্র অর্জনের আশঙ্কা
- ইরানপন্থী মিলিশিয়া (হিজবুল্লাহ, হুথি, পিএমইউ ইত্যাদি)
প্রচারের মাধ্যম:
পশ্চিমা ও আরব মিডিয়াতে নিয়মিতভাবে ইরানকে ‘নিউক্লিয়ার হুমকি’ ও ‘সন্ত্রাসী রাষ্ট্র’ হিসেবে তুলে ধরা।
ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্রের নেতারা রাজনৈতিক বক্তৃতায় ইরানকে ‘অস্থিতিশীলতা ও সন্ত্রাসের উৎস’ বলে আখ্যা দেন।
২. সামরিক ও নিরাপত্তা কৌশল
▫️মার্কিন পদক্ষেপ: উপসাগরীয় অঞ্চলে স্থায়ী সামরিক ঘাঁটি: সৌদি আরব, কুয়েত, কাতার, বাহরাইন ইত্যাদিতে।
ইরানবিরোধী যুক্তি দেখিয়ে THAAD, Patriot, F-35, ড্রোন সিস্টেমসহ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র বিক্রি।
ইসরাইলি ভূমিকা: সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ গাল্ফ দেশগুলোর সঙ্গে গোপনে গোয়েন্দা তথ্য বিনিময়।
হুথিদের ড্রোন হামলা প্রতিরোধে ইসরাইলি প্রযুক্তি ও নজরদারি।
লক্ষ্য: আরব দেশগুলোকে নিরাপত্তা নির্ভরতায় বেঁধে রাখা।
৩. কূটনৈতিক প্রভাব ও স্বাভাবিকীকরণ (Normalization)
▫️আব্রাহাম চুক্তি (2020): আমিরাত, বাহরাইন, মরক্কো, সুদান ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেয়।
চুক্তির পেছনে যুক্তি ছিল: ইরান হুমকি মোকাবেলায় ঐক্য দরকার।
▫️সৌদি আরবের অবস্থান:
প্রকাশ্যে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পূর্বশর্ত দিলেও, নেপথ্যে ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের আলোচনা চালায় এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে দু'দেশের সহযোগিতামূলক বোঝাপড়া রয়েছে।
লক্ষ্য: ইসরাইলকে আরব বিশ্বে বৈধতা প্রদান ও ফিলিস্তিন ইস্যুকে দুর্বল করা।
৪. অর্থনৈতিক চুক্তি ও বিনিয়োগ কৌশল
আমেরিকা ও ইসরাইল আরব দেশগুলোকে টেকনোলজি, সাইবার সিকিউরিটি, কৃষি ও পারমাণবিক প্রযুক্তি সরবরাহের প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাদেরকে ইরানের বিরুদ্ধে অবস্থান করতে বাধ্য করে।
সৌদি ভিশন ২০৩০-এর অংশ হিসেবে সৌদি আরব পশ্চিমা বিনিয়োগের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে।
লক্ষ্য: অর্থনৈতিক অংশীদারিত্বের মাধ্যমে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করা।
৫. প্রপাগান্ডা ও জনমত নিয়ন্ত্রণ
ইরানকে “সন্ত্রাসের উৎস”, “শিয়া সাম্রাজ্য”, “নিউক্লিয়ার হুমকি” হিসেবে আরব জনমনে প্রচার করা হয়। আরব মিডিয়ায় (যেমন: আল-আরাবিয়া, গাল্ফ নিউজ) ইরানবিরোধী প্রচার জোরদার করা হয়।
লক্ষ্য: ইরানবিরোধী জনমত তৈরি করে সরকারগুলোর কৌশলগত সিদ্ধান্তে জনসমর্থন নিশ্চিত করা।
৬. প্রক্সি যুদ্ধ ও সংঘাত ব্যবস্থাপনা
উদাহরণ: ইয়েমেনে সৌদি নেতৃত্বাধীন জোট হুথিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে, যাদের “ইরানের প্রক্সি” বলা হয়।
সিরিয়া, লেবানন ও ইরাকে ইরানপন্থী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে আমেরিকা ও ইসরাইলের সমর্থন এবং আরব দেশ গুলোর ইরানের বিরুদ্ধে আমেরিকার জোটের সাথে সহাবস্থান করে।
লক্ষ্য: ইরান-সমর্থিত শক্তিগুলিকে দুর্বল করা এবং অঞ্চলজুড়ে নিজেদের প্রভাব প্রতিষ্ঠা।
পরিসমাপ্তি: “ইরানভীতি” হলো এক বহুমাত্রিক কৌশল, যা সামরিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিক উপায়ে ব্যবহৃত হচ্ছে। এর মাধ্যমে আমেরিকা ও ইসরাইল: আরব দেশগুলোর উপর কৌশলগত প্রভাব বজায় রাখছে, ইসরাইলকে আরব দুনিয়ায় স্বীকৃতি দিচ্ছে, অস্ত্র বিক্রি ও নিরাপত্তা ব্যবসা চালু রাখছে।
এই কৌশল মধ্যপ্রাচ্যের আঞ্চলিক ক্ষমতার ভারসাম্যকে একতরফাভাবে প্রভাবিত করছে এবং ফিলিস্তিন ইস্যুকে ধীরে ধীরে পেছনে ঠেলে দিচ্ছে।
সূত্র (সাধারণ তথ্যের উৎস):
১. Brookings Institution reports
২. Al Jazeera, Middle East Eye, Reuters
৩. US State Department press releases
৪. Gulf Intelligence reports
৫. The Abraham Accords official documents
লিখেছেন- হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমিন জনাব আলী নওয়াজ খান
আপনার কমেন্ট