হাওজা নিউজ এজেন্সি: পবিত্র কুরআনের সূরা আত-তাওবার ১০৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে:
وَقُلِ ٱعْمَلُواْ فَسَيَرَى ٱللَّهُ عَمَلَكُمۡ وَرَسُولُهُۥ وَٱلۡمُؤۡمِنُونَۖ وَسَتُرَدُّونَ إِلَىٰ عَٰلِمِ ٱلۡغَيۡبِ وَٱلشَّهَٰدَةِ فَيُنَبِّئُكُم بِمَا كُنتُمۡ تَعۡمَلُونَ١٠٥
“বলুন, তোমরা কাজ করো; আল্লাহ তোমাদের কাজ দেখতে পাবেন, এবং তাঁর রাসূল ও মুমিনগণও (দেখবেন)। আর তোমরা প্রত্যাবর্তিত হবে অদৃশ্য ও দৃশ্যের জ্ঞাতকারীর কাছে, অতঃপর তিনি তোমাদেরকে জানিয়ে দেবেন তোমরা যা কিছু করতে।”
আয়াতের তাফসির এবং আলেমদের ব্যাখ্যা
সূরা আত-তাওবা, আয়াত ১০৫ অনুসারে, মানুষের সকল আমল আল্লাহ, তাঁর রাসূল ﷺ এবং মুমিনগণ প্রত্যক্ষ করেন। এই আয়াত থেকে বোঝা যায়, আল্লাহর জ্ঞানে পৃথিবীর সমস্ত কাজ স্পষ্ট, রাসূল ﷺ এর সামনে উম্মতের আমল পেশ করা হয় এবং বিশেষ মুমিনগণও তাদের আমল জানেন।
১. আল্লাহ তোমাদের কাজ দেখবেন
এই ব্যাখ্যা অনুসারে, আল্লাহ্র অগণিত জ্ঞানে মানুষের সব কাজ স্পষ্ট থাকে। তিনি জানেন সব কিছু—প্রকাশ্য এবং গোপন। কোন কিছুই তাঁর চোখে অদৃশ্য থাকে না।
২. রাসূল ﷺ তোমাদের কাজ দেখবেন
রাসূল ﷺ এর আমল দেখার প্রসঙ্গে হাদিস রয়েছে: “তোমাদের আমল প্রতি বৃহস্পতিবার আমার সামনে পেশ করা হয়।”
[সুনান আল-বাইহাকি, মুসনাদ আহমদ]
এটি প্রমাণ করে যে, রাসূল ﷺ প্রতি সপ্তাহে উম্মতের আমল দেখেন এবং ভালো কাজের জন্য আল্লাহর প্রশংসা করেন, এবং মন্দ কাজের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেন।
৩. মুমিনগণ দেখবেন
এখানে “মুমিনগণ” বলতে সাধারণ মুমিনরা নয়, বিশেষভাবে রাসূল ﷺ এর উত্তরসূরি এবং আহলে বাইত (আ.) বোঝানো হয়েছে। এই মুমিনগণ তাদের ইলম ও নৈকট্য দ্বারা উম্মতের আমল সম্পর্কে অবহিত হন। যেমন, ইমাম জাফর আস-সাদিক (আ.) বলেছেন,
“আমাদের কাছে তোমাদের আমল প্রতিদিন পেশ হয়, যদি ভালো কিছু দেখি আমরা আল্লাহর প্রশংসা করি, আর যদি মন্দ কিছু দেখি আমরা তোমাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করি।”
[আল-কাফি, খণ্ড ১, হাদিস ২২]
৪. পরে প্রত্যাবর্তন
আয়াতের শেষাংশে বলা হয়েছে যে, মানুষের সকল কাজ একদিন আল্লাহর কাছে ফিরে যাবে এবং তাঁর কাছে সঠিক হিসাব দেওয়া হবে।
বিশেষ মুমিনগণ এবং আমল পেশ হওয়া
“মুমিনগণ” বলতে সাধারণ মুমিন নয়, বরং সেই বিশেষ মুমিনগণ, যারা রাসূল ﷺ এর উত্তরসূরি বা আহলে বাইত (আ.)। এই বিশেষ মুমিনদের কাছে উম্মতের আমল ফেরেশতারা পেশ করে। সুন্নি তাফসিরকারীরা সাধারণভাবে বলেন যে, মুমিনগণ তাদের প্রকাশ্য কাজ দেখতে পায়, কিন্তু শিয়া তাফসিরকারীরা জানান যে, ফেরেশতারা রাসূল ﷺ এবং ইমামগণের কাছে আমল পেশ করে।
হাদিস: “প্রতি বৃহস্পতিবার মানুষের আমল রাসূল ﷺ এবং ইমামগণের সামনে পেশ করা হয়।”
[আল-ইখতিসাস, শেইখ মুফিদ, পৃষ্ঠা ৩৪]
কুরআন ও হাদিসের সঙ্গে সংযোগ
সূরা আত-তাওবা, আয়াত ১০৫ এ বলা হয়েছে: “আল্লাহ, তাঁর রাসূল এবং মুমিনগণ তোমাদের আমল দেখবেন…” এই আয়াতের মাধ্যমে কুরআন এবং হাদিসের মধ্যে গভীর সংযোগ বিদ্যমান। বিশেষভাবে, এখানে “মুমিনগণ” দ্বারা বোঝানো হচ্ছে আহলে বাইত এবং ইমামগণ, যাদের কাছে উম্মতের আমল ফেরেশতারা পেশ করে।
নির্ভরযোগ্য হাদিস রেফারেন্স
১. রাসূল ﷺ এর কাছে আমল পেশ হওয়া: “তোমাদের আমল আমার সামনে পেশ করা হয়। যদি আমি ভালো কিছু দেখি, আল্লাহর প্রশংসা করি, আর যদি অন্য কিছু দেখি, তোমাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করি।”
[আল-বাজার, আল-মুজম আল-আউসাত, সহীহুল জামে’ ২১৭০]
২. রাসূল ﷺ এর ইন্তেকালের পরও আমল পেশ হওয়া: “আমার জীবিত থাকা তোমাদের জন্য কল্যাণকর… এবং আমার ইন্তেকালের পরও তোমাদের আমল আমার সামনে পেশ করা হবে।”
[মুসনাদ আল-বাসার, হায়সামি মাজমা’ আয-জাওয়ায়েদ ৯/২৪]
৩. বিশেষ মুমিনগণের কাছে আমল পেশ হওয়া (শিয়া সূত্র): “প্রতিদিন সকালে বান্দাদের আমল রাসূল ﷺ এর সামনে পেশ হয়— ভালো হোক বা মন্দ। তাই সাবধান হও।”
[আল-কাফি, খণ্ড ১, হাদিস ২২]
৪. সাধারণ মুমিনগণের কাছে আমল পেশ হওয়া: “তোমাদের আমল প্রতিদিন ও প্রতি রাতে আমাদের সামনে পেশ হয়।”
[আল-কাফি, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ২১৯]
উপসংহার: এ থেকে স্পষ্টভাবে বোঝা যায় যে, মানুষের আমল কেবল কিয়ামতের দিনই নয়, বরং দুনিয়াতেও আল্লাহ, রাসূল ﷺ এবং বিশেষ মুমিনগণ (যেমন ইমামগণ বা আল্লাহর ওলীরা) দ্বারা পেশ হয়। এই বাস্তবতা আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, আমাদের প্রতিটি কাজই পর্যালোচনার অধীন এবং আমাদের আমল ও আচরণ শুধুমাত্র আমাদের নিজের জন্য নয়, বরং আল্লাহ, রাসূল ﷺ এবং মুমিনগণের সামনে থাকবে।
এটি আমাদের জীবনকে আরও দায়িত্বশীল এবং সৎ কাজের দিকে উদ্বুদ্ধ করে।
লেখা: হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমিন জনাব মুহাম্মাদ শরিফুল ইসলাম
আপনার কমেন্ট