বৃহস্পতিবার ১৪ আগস্ট ২০২৫ - ১০:৩৭
আহলে বাইতের (আ.) জন্য শোকার্ত হৃদয়ের নিঃশ্বাসও ইবাদত

আহলে বাইত (আ.)-এর ওপর সংঘটিত জুলুম ও নির্যাতনের প্রেক্ষিতে ইমাম জাফর সাদিক (আ.) একটি অনন্য হাদিসে এমন এক আধ্যাত্মিক দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করেছেন, যা শোকার্ত হৃদয়ের নিঃশ্বাসকেও ইবাদতের মর্যাদা দান করে। এই হাদিস শুধু একটি ধর্মীয় শিক্ষা নয়; বরং যুগে যুগে সত্য ও ন্যায়ের পথে চলা মুমিনদের জন্য জীবন-দিকনির্দেশ।

হাওজা নিউজ এজেন্সি: ইমাম জাফর সাদিক (আ.) ইরশাদ করেন,

نَفَسُ الْمَهْمُومِ لَنَا، وَالْمُغْتَمِّ لِظُلْمِنَا، تَسْبِيحٌ، وَهَمُّهُ لِأَمْرِنَا عِبَادَةٌ، وَكَتْمَانُهُ لِسِرِّنَا جِهَادٌ فِي سَبِيلِ اللَّهِ.

“আমাদের উপর যে জুলুম করা হয়েছে তার কারণে যে শোকার্ত তার দীর্ঘশ্বাস হলো তসবিহ; আমাদের বিষয়ে তার দুশ্চিন্তা (উদ্বিগ্নতা) হলো ইবাদত; আর আমাদের রহস্যগুলো গোপন রাখা আল্লাহর পথে জিহাদের সমান।”

অতঃপর ইমাম (আ.) বলেন: “এই হাদিসটি সোনার অক্ষরে লেখা উচিত।”

ইমাম জাফর সাদিক (আ.)-এর হাদীসটিতে গভীর ও অর্থবহ শিক্ষা বহন করছে। এখানে তিনটি অংশে একটি আধ্যাত্মিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ পেয়েছে। আমি ধাপে ধাপে ব্যাখ্যা করছি—

১️. ”আমাদের উপর যে জুলুম করা হয়েছে তার কারণে যে শোকার্ত, তার দীর্ঘশ্বাস হলো তাসবিহ”

এখানে “আমাদের উপর জুলুম” বলতে আহলে বাইত (আ.)-এর ওপর সংঘটিত অন্যায়, অত্যাচার, হত্যাযজ্ঞ ও অধিকার বঞ্চনাকে বোঝানো হয়েছে—যেমন কারবালার ট্র্যাজেডি, ইমামদের বন্দিত্ব ও শহীদ হওয়া।

ইমাম (আ.) বলছেন, যে ব্যক্তি আন্তরিকভাবে এই অবিচারের জন্য দুঃখ অনুভব করে এবং কষ্টে দীর্ঘশ্বাস ফেলে, সেই দীর্ঘশ্বাসই আল্লাহর কাছে তাসবিহ অর্থাৎ আল্লাহর পবিত্রতা ঘোষণা হিসেবে গৃহীত হয়।

এর মানে, শোকার্ত হৃদয়ের নিঃশ্বাসও ইবাদতের মর্যাদা পায়, যদি তা সত্য ও ঈমানের অনুভূতি থেকে আসে।

কারণ আল্লাহর পথে ও আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের জন্য যে ব্যথা অনুভূত হয়, তা আধ্যাত্মিকভাবে আল্লাহর স্মরণ ও মহিমাকীর্তনের সমতুল্য।

২️. “আমাদের বিষয়ে তার দুশ্চিন্তা (উদ্বিগ্নতা) হলো ইবাদত”

“আমাদের বিষয়ে দুশ্চিন্তা” বলতে আহলে বাইতের সত্য, তাদের শিক্ষা, তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও তাদের প্রতি মানুষের দায়িত্ব নিয়ে চিন্তিত হওয়া বোঝায়।

শুধু আবেগ নয়—বরং তাদের শিক্ষা সংরক্ষণ, সত্য প্রচার এবং ইতিহাসের বিকৃতি নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকা।

ইমাম (আ.) বলছেন, এই ধরনের ফিকির বা মনোযোগ আসলে ইবাদতের অংশ। কারণ আল্লাহর পথে সচেতনতা, ইমান রক্ষা এবং সত্যের প্রতি নিষ্ঠা—এসবই ইবাদতের প্রকৃত চেতনা।

৩️. “আমাদের রহস্যগুলো গোপন রাখা আল্লাহর পথে জিহাদের পুরস্কার বহন করে”

এখানে “রহস্য” বলতে এমন সব বিষয় বোঝানো হয়েছে যা সাধারণ মানুষের জন্য সময়, স্থান বা পরিস্থিতি অনুসারে প্রকাশ করা নিরাপদ নয়—যেমন রাজনৈতিক কৌশল, শত্রুর ষড়যন্ত্র, বা বিশেষ আধ্যাত্মিক জ্ঞান যা ভুল বোঝাবুঝি তৈরি করতে পারে।

ইমামদের যুগে রাজনৈতিক দমন-পীড়নের কারণে তাদের শিষ্যদের অনেক বিষয় গোপন রাখতে হতো, নইলে শত্রুরা তা ব্যবহার করে বড় ক্ষতি করত।

তাই ইমাম (আ.) এটিকে “আল্লাহর পথে জিহাদের পুরস্কার”-এর সাথে তুলনা করেছেন, কারণ গোপন রাখা মানে সত্যকে শত্রুর হাত থেকে রক্ষা করা—যা একপ্রকার আত্মরক্ষামূলক ও কৌশলগত সংগ্রাম।

সারাংশ শিক্ষা:
এই হাদিস আমাদের তিনটি মূল বার্তা দেয়—

১. সত্যিকারের সহানুভূতি ও দুঃখ— আল্লাহর পথে ইবাদতের মর্যাদা পায়।

২. আহলে বাইতের প্রতি চিন্তা ও সচেতনতা—শুধু আধ্যাত্মিক নয়, এটি সরাসরি ইবাদত।

৩. সঠিক সময়ে সঠিক কথা বলা ও প্রয়োজনে নীরব থাকা—এটি একপ্রকার জিহাদ।

হাদিসটির ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট:
আমি ধাপে ধাপে তুলে ধরছি, যাতে ইমাম জাফর সাদিক (আ.) কেন এ কথা বলেছেন তা বোঝা যায়।

১️. ইমাম জাফর সাদিক (আ.)-এর যুগের রাজনৈতিক অবস্থা: ইমাম জাফর সাদিক (আ.) ৮৩ হিজরি (৬০২ খ্রি.) সালে জন্ম নেন এবং ১৪৮ হিজরি (৭৬৫ খ্রি.) সালে শহীদ হন।

তাঁর সময়ে উমাইয়া খিলাফত ধীরে ধীরে দুর্বল হচ্ছিল এবং আব্বাসীয় খিলাফত শক্তিশালী হয়ে উঠছিল।

উমাইয়া শাসন যেমন আহলে বাইতের শত্রু ছিল, তেমনি আব্বাসীয়রা শুরুতে আহলে বাইতের নামে ক্ষমতায় এলেও পরে একইভাবে নিপীড়ন চালায়।

এই দুই শাসনামলেই আহলে বাইতের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ, তাদের শিক্ষা প্রচার, এমনকি তাদের নামও খোলাখুলি উচ্চারণ অনেক সময় মৃত্যুদণ্ড বা কারাবাস ডেকে আনত।

২️. শিয়া সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতন: ইমাম জাফর সাদিক (আ.)-এর যুগে তাঁর অনুসারীরা (শিয়া) ক্রমাগত নজরদারি, গ্রেপ্তার ও হত্যা-আতঙ্কে জীবন যাপন করত।

শাসকরা আশঙ্কা করত, আহলে বাইতের নেতৃত্ব শক্তিশালী হলে তাদের ক্ষমতা নড়বড়ে হয়ে যাবে।

তাই ইমামের শিষ্যদের জন্য অনেক শিক্ষা ও নির্দেশ গোপন রাখা অপরিহার্য ছিল, যাতে শত্রুরা তা ব্যবহার করতে না পারে।

৩️. কেন ”শোকার্তের নিঃশ্বাস” তাসবিহ বলা হয়েছে: আহলে বাইতের ওপর জুলুমের জন্য শোকার্ত হওয়া ছিল কেবল ব্যক্তিগত আবেগ নয়—এটি ছিল রাজনৈতিক সচেতনতা ও ঈমানের প্রকাশ।

শাসকরা আহলে বাইতের ইতিহাস বিকৃত করতে চাইত, তাই তাদের সত্যিকারের অবস্থা নিয়ে চিন্তা করা, শোক পালন করা, এমনকি দীর্ঘশ্বাসও এক ধরনের প্রতিরোধ ছিল।

এই আবেগকে ইমাম আধ্যাত্মিক মর্যাদা দিয়েছেন—যেন তা আল্লাহর পবিত্রতা ঘোষণা করার সমান।

৪️. কেন “আমাদের রহস্য গোপন রাখা” জিহাদ বলা হয়েছে: গোপন রাখা বলতে শুধু আধ্যাত্মিক বিষয় নয়, বরং রাজনৈতিক কৌশলও বোঝানো হয়েছে।

ইমাম জাফর সাদিক (আ.)-এর অনেক পরিকল্পনা, শিষ্যদের নেটওয়ার্ক এবং গোপন নির্দেশ প্রকাশ হলে শত্রুরা সঙ্গে সঙ্গে ধ্বংস করে দিত।

তাই যেসব অনুসারী সময় বুঝে কথা বলত, প্রয়োজনে নীরব থাকত—তাদের ভূমিকা সরাসরি আল্লাহর পথে সংগ্রামের সমান ছিল।

৫️. কেন বললেন “এই হাদিসটি সোনার অক্ষরে লেখা উচিত”: কারণ এই হাদিসে তিনটি মৌলিক নির্দেশনা আছে:

১. আবেগের মূল্যায়ন— শোক ও সহানুভূতি ইবাদতের মর্যাদা পায়।

৩. সচেতনতার মূল্যায়ন — আহলে বাইতের শিক্ষা ও অধিকার নিয়ে দুশ্চিন্তা ইবাদত।

৩. নীরবতার কৌশল— প্রয়োজনে সত্য গোপন করাও জিহাদ।

এই তিনটি শিক্ষা শুধু তখন নয়, বরং সব যুগে আহলে বাইতের অনুসারীদের জন্য জীবন-নির্দেশনা হিসেবে প্রযোজ্য।

লেখক: হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমিন জনাব মুহাম্মাদ শরিফুল ইসলাম

আপনার কমেন্ট

You are replying to: .
captcha