সোমবার ১ সেপ্টেম্বর ২০২৫ - ১০:৪১
শয়তান কু-কর্মকে মানুষের চোখে শোভিত করে তুলে ধরে

হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমীন সাইয়্যেদ জাফর রব্বানী বলেছেন, শয়তানের অন্যতম কৌশল হলো মানুষের সামনে সত্য ও মিথ্যাকে একত্রে উপস্থাপন করা, যাতে মানুষ বিভ্রান্ত হয় এবং ভুলকে সঠিক মনে করে।

হাওজা নিউজ এজেন্সি: হাওযায়ে ইলমিয়া কোমের অধ্যাপক হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমীন সাইয়্যেদ জাফর রব্বানী বলেন, শয়তানের অন্যতম কাজ হলো মানুষের আমলকে সাজিয়ে-গুজিয়ে পেশ করা, যাতে মানুষ তা কল্যাণকর বলে মনে করে।

সত্য ও মিথ্যার বিভ্রান্তি
তিনি ব্যাখ্যা করেন, আমিরুল মুমিনীন ইমাম আলী (আ.) নাহজুল বালাগা’তে বলেছেন, কোনো বিষয়কে ‘সন্দেহজনক’ বলা হয়েছে এ কারণে যে এর বাহ্যিক রূপ সত্যের মতো মনে হয়। যদি কোনো সত্য পুরোপুরি প্রকাশিত হয়, সবাই তার দিকে ঝুঁকবে। আবার যদি মিথ্যা তার সম্পূর্ণ রূপে প্রকাশিত হয়, সবাই তা চিনতে পারবে এবং তা থেকে সরে আসবে। কিন্তু যখন সত্য ও মিথ্যা মিলেমিশে মানুষের সামনে আসে, তখন মানুষ বিভ্রান্ত হয় এবং এটাকেই বলা হয় ‘শোবাহাত বা সন্দেহপূর্ণ’।

শয়তানের প্রতারণা ও কু-কর্মের অলঙ্করণ
উস্তাদ রব্বানী বলেন, ‘শোভাহাত’ আসলে এমন এক মিথ্যা, যাকে সত্যের রূপে সাজিয়ে তোলা হয়। শয়তান এই সুযোগটিই কাজে লাগায়। মানুষের কু-কর্মকে রঙচঙে করে উপস্থাপন করা শয়তানের প্রধান কাজগুলোর একটি।

তিনি কোরআনের সূরা কাহফের উদ্ধৃতি দেন—
قُلْ هَلْ نُنَبِّئُكُم بِالأَخْسَرِينَ أَعْمَالًا الَّذِينَ ضَلَّ سَعْيُهُمْ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَهُمْ يَحْسَبُونَ أَنَّهُمْ يُحْسِنُونَ صُنْعًا
“বলুন (হে মুহাম্মদ সা.), আমি কি তোমাদের জানাব সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত কর্মীদের কথা? তারা সেই লোক যারা দুনিয়ার জীবনে সব চেষ্টা-সাধনা নষ্ট করেছে, অথচ তারা মনে করে তারা ভালো কাজ করছে।” [সূরা কাহফ: ১০৩-১০৪]

বদরের যুদ্ধের শিক্ষা
তিনি সতর্ক করে বলেন, মানুষের জন্য সবচেয়ে ভয়ঙ্কর হলো, যখন সে মনে করে তার কাজ সঠিক ও গ্রহণযোগ্য, অথচ বাস্তবে সে শয়তানের সাজানো প্রতারণার শিকার। কোরআন মাজিদে বদরের যুদ্ধের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বলা হয়েছে, শয়তান মুশরিকদের কাজকে তাদের কাছে শোভিত করে তুলেছিল, এমনকি তারা ভাবত, রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে যুদ্ধ করে তারা ভালো কাজ করছে।

তিনি বলেন, সূরা আনফাল (আয়াত ৪৮)-এ আল্লাহ বলেন—
وَإِذْ زَيَّنَ لَهُمُ الشَّيْطَانُ أَعْمَالَهُمْ وَقَالَ لَا غَالِبَ لَكُمُ الْيَوْمَ مِنَ النَّاسِ وَإِنِّي جَارٌ لَكُمْ
“শয়তান তাদের আমলকে তাদের কাছে শোভিত করে তুলেছিল এবং বলেছিল, আজ মানুষের কেউ তোমাদের পরাজিত করতে পারবে না, আমি তোমাদের সহায়।”

কিন্তু আয়াতের পরবর্তী অংশে দেখা যায়, যখন সত্য ও মিথ্যার বাহিনী মুখোমুখি হলো, তখন শয়তান পিছিয়ে গেল এবং বলল—
إِنِّي بَرِيءٌ مِّنكُمْ إِنِّي أَرَى مَا لَا تَرَوْنَ إِنِّي أَخَافُ اللَّهَ وَاللَّهُ شَدِيدُ الْعِقَابِ
“আমি তোমাদের থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। আমি এমন কিছু দেখছি যা তোমরা দেখছ না। আমি আল্লাহকে ভয় করি, আর আল্লাহ কঠোর শাস্তিদাতা।”

উস্তাদ রব্বানী গভীরভাবে মন্তব্য করেন, আল্লাহ না করুন, এমন দিন যেন না আসে যে শয়তানের চোখের অন্তর্দৃষ্টি আমাদের চেয়ে বেশি হয়ে যায়। অথচ তখন শয়তানই বলেছিল—“আমি আল্লাহকে ভয় করি।”

ফেরাউনের উদাহরণ
তিনি আরও বলেন, ফেরাউনের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছিল। কোরআনে এসেছে, ফেরাউন তার মন্ত্রী হামানকে বলেছিল—
وَقَالَ فِرْعَوْنُ يَا هَامَانُ ابْنِ لِي صَرْحًا لَّعَلِّي أَبْلُغُ الأَسْبَابَ (٣٦) أَسْبَابَ السَّمَاوَاتِ فَأَطَّلِعَ إِلَى إِلَهِ مُوسَى وَإِنِّي لأَظُنُّهُ كَاذِبًا وَكَذَلِكَ زُيِّنَ لِفِرْعَوْنَ سُوءُ عَمَلِهِ وَصُدَّ عَنِ السَّبِيلِ وَمَا كَيْدُ فِرْعَوْنَ إِلَّا فِي تَبَابٍ (٣٧)
“আর ফেরাউন বলল: হে হামান! আমার জন্য একটি উঁচু প্রাসাদ তৈরি করো, হয়তো আমি আসমানের পথগুলোতে পৌঁছতে পারি এবং মূসার উপাস্যকে দেখতে পারি। আমি তো তাকে মিথ্যাবাদী মনে করি। এভাবেই ফেরাউনের কাছে তার কু-কর্ম শোভিত করা হয়েছিল এবং সে সত্যপথ থেকে বিরত রাখা হয়েছিল। ফারাউনের চক্রান্ত ছাড়া আর কিছুই ছিল না ধ্বংসের পথে।” [সূরা গাফির: ৩৬-৩৭]

পরিশেষে, হুজ্জাতুল ইসলাম রব্বানী জোর দিয়ে বলেন, শয়তান মানুষকে সবসময় ফাঁদে ফেলতে চায়—তার কু-কর্মকে সুন্দর সাজিয়ে তুলে ধরে, যাতে মানুষ বিভ্রান্ত হয় এবং মিথ্যাকে সত্য ভেবে গ্রহণ করে। তাই প্রত্যেক মুমিনের কর্তব্য হলো আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করা, কোরআনের আলোয় সঠিক পথ চিনে নেওয়া এবং শয়তানের প্রতারণা থেকে সজাগ থাকা।

আপনার কমেন্ট

You are replying to: .
captcha