শনিবার ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫ - ০৮:৪১
কোরআন ও আহলুল বাইত (আ.): মানবতার জন্য দ্বৈত হেদায়তের উৎস

মানবজাতির দিকনির্দেশনা ও কল্যাণের জন্য আল্লাহ তায়ালা যুগে যুগে নবী ও রাসূল পাঠিয়েছেন। তাদের সবার মিশনের কেন্দ্রবিন্দু ছিল এক আল্লাহর ইবাদত, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা এবং মানুষকে পরিপূর্ণ জীবনের দিকে আহ্বান করা। রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর আগমন ছিল এ ধারার পরিণতি ও সমাপ্তি। তিনি যে উত্তরাধিকার রেখে গেছেন, তা হলো আল্লাহর কিতাব (কোরআন) এবং তাঁর ইতরাত তথা আহলুল বাইত (আ.)। এ দু’টি একত্রে মানবতার জন্য পূর্ণাঙ্গ ও নির্ভুল হেদায়তের উৎস।

হাওজা নিউজ এজেন্সি: হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমিন ড. মুহাম্মাদ ফারুক হুসাইন তাঁর এক প্রবন্ধে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ'লার প্রেরিত হিদায়াত গ্রন্থ পবিত্র কুরআন বোঝার ক্ষেত্রে পবিত্র আহলে বাইতের (আ.) গুরুত্ব তুলে ধরেছেন, যা পাঠকদের জন্য তুলে ধরছি: 

কোরআন: চিরন্তন হেদায়তের গ্রন্থ
কোরআন মাজীদ মানবতার জন্য এমন এক আলোকবর্তিকা, যা সময় ও স্থানের সীমা অতিক্রম করে প্রতিটি যুগে পথপ্রদর্শন করে।

আল্লাহ বলেন:
«هُدًى لِّلنَّاسِ وَبَيِّنَاتٍ مِّنَ الْهُدَىٰ وَالْفُرْقَانِ»
“এটি মানুষের জন্য হেদায়ত, হেদায়তের স্পষ্ট প্রমাণ এবং সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারক।”
[সূরা বাকারা: ১৮৫]

এই আয়াত প্রমাণ করে, কোরআন শুধু ইবাদত নয় বরং সমাজ, অর্থনীতি, রাজনীতি, পারিবারিক জীবন এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক পর্যন্ত প্রতিটি ক্ষেত্রে দিকনির্দেশ দেয়।

অন্যত্র আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ'লা বলেন:
«إِنَّ هَٰذَا الْقُرْآنَ يَهْدِي لِلَّتِي هِيَ أَقْوَمُ»
“নিশ্চয়ই এই কোরআন এমন পথের দিকে পথপ্রদর্শন করে, যা সর্বাধিক সরল ও সঠিক।” [সূরা ইসরা: ৯]

অতএব, কোরআন এমন এক দিকনির্দেশক, যা শুধু তত্ত্ব নয়, বরং জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রের জন্য সর্বোত্তম বাস্তব সমাধান।

আহলুল বাইত (আ.): কোরআনের জীবন্ত ব্যাখ্যাকারী
যদিও কোরআন মানবতার জন্য পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ, কিন্তু তার গভীর অর্থ ও প্রকৃত প্রয়োগ বোঝা সবার জন্য সহজ নয়। এজন্যই রাসূলুল্লাহ (সা.) কোরআনের পাশাপাশি আহলুল বাইতকে (আ.) উম্মতের জন্য অপরিহার্য হেদায়তের উৎস হিসেবে রেখে গেছেন।

তিনি বলেছেন,
«إني تارك فيكم الثقلين كتاب الله وعترتي أهل بيتي، ما إن تمسكتم بهما لن تضلوا بعدي أبداً»
“আমি তোমাদের মাঝে দু’টি মূল্যবান আমানত রেখে যাচ্ছি: আল্লাহর কিতাব (কোরআন) ও আমার আহলুল বাইত (আ.)। তোমরা যদি এ দু’টির সাথে দৃঢ়ভাবে অটুট থাকো, তবে কখনো পথভ্রষ্ট হবে না।”
[সহীহ মুসলিম, কিতাব ফাযায়েল, হাদীস ২৪০৮; তিরমিযী, হাদীস ৩৭৮

এ হাদীস থেকে স্পষ্ট হয়— কোরআনের প্রকৃত ব্যাখ্যা আহলুল বাইতের (আ.) হাতে, কারণ তাঁরা কোরআনের শিক্ষার জীবন্ত প্রতিফলন।

ইমাম আলী (আ.) বলেন,
«ذلك القرآن فاستنطقوه، ولن ينطق لكم، أخبركم عنه، إن فيه علم ما مضى وعلم ما يأتي إلى يوم القيامة»
“কোরআনকে কথা বলাতে চেষ্টা করো, তবে এটি নিজের থেকে কথা বলবে না। আমি তোমাদেরকে তার ব্যাখ্যা দিচ্ছি। এতে অতীত ও কিয়ামত পর্যন্ত ভবিষ্যতের সব জ্ঞানের ভাণ্ডার রয়েছে।” [নাহজুল বালাগাহ, খুতবা ১৫৮]

অতএব, কোরআনের প্রকৃত উপলব্ধির জন্য আহলুল বাইতের (আ.) শরণাপন্ন হওয়া অপরিহার্য।

কোরআন ও আহলুল বাইত (আ.): সমন্বিত হেদায়েত
কোরআন ও আহলুল বাইত (আ.) দুটি সমান্তরাল নদীর মতো, যা একসাথে প্রবাহিত হয় এবং মানবতাকে মুক্তির সমুদ্রে পৌঁছে দেয়।

কোরআন হলো তত্ত্ব ও আইন। আহলুল বাইত (আ.) হলো তার বাস্তব রূপ ও দৃষ্টান্ত।

উদাহরণস্বরূপ, কোরআন ন্যায়বিচারের নির্দেশ দিয়েছে:
«إِنَّ اللَّهَ يَأْمُرُ بِالْعَدْلِ وَالإِحْسَانِ»
“নিশ্চয়ই আল্লাহ ন্যায়বিচার ও সদাচারের নির্দেশ দেন।” [সূরা নাহল: ৯০]

কিন্তু এর বাস্তব রূপ আমরা দেখি ইমাম আলী (আ.)-এর শাসনামলে, যেখানে তিনি এমনকি খলিফা থাকা অবস্থায়ও আদালতে সাধারণ মানুষের মতো বিচারকের সামনে দাঁড়িয়েছেন।

আজকের প্রেক্ষাপটে গুরুত্ব
বর্তমান বিশ্বে যখন ভ্রান্ত মতবাদ, বস্তুবাদী সংস্কৃতি ও অন্যায়ের আধিক্য বেড়ে যাচ্ছে, তখন মানবতার মুক্তির জন্য আবারও কোরআন ও আহলুল বাইতের (আ.) দ্বৈত হেদায়তের দিকে ফিরে যাওয়া ছাড়া কোনো পথ নেই। কোরআন দেবে নীতি ও দিকনির্দেশনা, আর আহলুল বাইতের (আ.) জীবন ও আদর্শ শেখাবে তার সঠিক প্রয়োগ।


পরিশেষ, মানবতার মুক্তি ও চূড়ান্ত কল্যাণের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে দুটি আমানত আমাদের হাতে এসেছে— কোরআন ও আহলুল বাইত (আ.)। এ দু’টির সমন্বয়ই প্রকৃত হেদায়ত, যা মানুষকে অন্ধকার থেকে আলোয় নিয়ে আসে, বিভ্রান্তি থেকে রক্ষা করে এবং ন্যায়ভিত্তিক আদর্শ সমাজ প্রতিষ্ঠা করে। রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর ভাষায়, যতদিন উম্মত এই দ্বৈত আমানতের সাথে আঁকড়ে থাকবে, ততদিন তারা কখনো পথভ্রষ্ট হবে না।

আপনার কমেন্ট

You are replying to: .
captcha