শনিবার ১১ অক্টোবর ২০২৫ - ১৬:৫৩
আনন্দময় ও ফলপ্রসূ জীবনের পথনির্দেশ

সমাজে গভীর ও স্থায়ী সুখ অর্জনের অন্যতম উপায় হলো আলেম ও বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বদের জীবন থেকে অনুপ্রেরণা গ্রহণ করা। তাদের ধৈর্য, অধ্যবসায় ও ঈমান শুধু তাদের ব্যক্তিজীবন নয়, বরং গোটা মানবসমাজকেই আলোকিত করেছে।

হাওজা নিউজ এজেন্সি: মাজানদারান প্রদেশের হাওজায়ে ইলমিয়ার অধ্যাপক ও গবেষক হুজ্জাতুল ইসলাম হুসেইন তাগিপুর “ইসলামের দৃষ্টিতে আনন্দ ও জীবনীশক্তি সৃষ্টির উপায়” শীর্ষক ধারাবাহিক আলোচনায় বক্তৃতা প্রদান করেন। এই আলোচনা “সুখের সূত্র” (The Formula of Happiness) শিরোনামে বিভিন্ন পর্বে প্রকাশিত হচ্ছে।

অনুপ্রেরণামূলক ব্যক্তিত্ব: সুখী ও সফল জীবনের চাবিকাঠি
জনাব তাগিপুর বলেন, জীবনের যেকোনো ক্ষেত্রে—ব্যক্তিগত, পারিবারিক বা সামাজিক—স্থায়ী সুখ ও প্রশান্তি অর্জনের অন্যতম উপায় হলো মহান ব্যক্তিত্বদের জীবন অধ্যয়ন ও অনুকরণ। এই মানুষগুলো প্রমাণ করেছেন, সফলতা কখনো বিলাসিতা বা স্বাচ্ছন্দ্যের ফল নয়; বরং নিরলস পরিশ্রম, ধৈর্য ও ঈমানের প্রতিদান।

তিনি বলেন, “জীবনে ব্যর্থতা মানে শেষ নয়। সন্তান সমস্যায় পড়তে পারে, আর্থিক সংকট আসতে পারে, কিংবা অন্যদের তুলনায় পিছিয়ে পড়ার অনুভূতি জাগতে পারে—তবু জীবন থেমে যায় না। জীবনের গতি তখনই অব্যাহত থাকে, যখন মানুষ নিজেকে পুনরায় দাঁড় করাতে শেখে।”

হজ কাসেম সোলাইমানি
হুজ্জাতুল ইসলাম তাগিপুর উল্লেখ করেন, “হজ কাসেম সোলাইমানি-এর জীবনের সাফল্য কোনো আকস্মিক ঘটনা নয়; এটি ছিল বছরের পর বছর সংগ্রাম, ধৈর্য ও আত্মত্যাগের ফল।”

তিনি বলেন, “শারীরিক অসুস্থতা, ক্লান্তি ও যন্ত্রণা সত্ত্বেও তিনি দায়িত্ব থেকে সরে যাননি। কখনো কখনো দাঁড়িয়ে বা বসে থাকতে না পেরে শুয়ে থেকেও সভা পরিচালনা করেছেন। এমনকি সে অবস্থাতেও তিনি শত্রুদের মোকাবেলার পরিকল্পনা তৈরি করেছেন। এটি আমাদের শেখায়—সত্যিকারের সাফল্য মানে পড়ে গিয়ে আবার ওঠার ক্ষমতা।”

ব্যর্থতা শেষ নয়, নতুন শুরুর সূচনা
তিনি বলেন, “জীবনের পথে হোঁচট খাওয়া ব্যর্থতা নয়; বরং পুনরায় উঠে দাঁড়ানোর প্রস্তুতিই সাফল্যের প্রথম ধাপ।”

তিনি যোগ করেন, “এই শিক্ষা কেবল ধর্মীয় ব্যক্তিদের জন্য নয়; ছাত্র, গবেষক, উদ্যোক্তা, রাজনীতিবিদ—সবাইয়ের জীবনে সমানভাবে প্রযোজ্য।”

তার মতে, “মহান ব্যক্তিত্বদের জীবন আমাদের শেখায়, সাফল্য কখনো এক রাতের মধ্যে আসে না। এর পেছনে থাকে বছরের পর বছর শ্রম, আত্মনিয়োগ ও ত্যাগ।”

আলেমদের জীবন: অনুপ্রেরণার অমূল্য ভাণ্ডার
ইসলামী পণ্ডিতরা সবসময় বলেছেন—‘আলেমদের জীবনী পড়ো’। তিনি উদাহরণ দেন ইরানের বিজ্ঞানী ও শিক্ষাবিদ প্রফেসর সাইয়্যেদ মাহমুদ হেসাবি-এর, যিনি পরিচিত “ইরানের পদার্থবিজ্ঞানের জনক” হিসেবে।

তিনি বলেন, “অসংখ্য বাধা, অসুস্থতা ও বিদেশি প্রলোভন সত্ত্বেও হেসাবি তাঁর দেশ ও ঈমান থেকে কখনো বিচ্যুত হননি। তাঁর জীবন প্রমাণ করে, প্রকৃত সাফল্য আসে দেশপ্রেম, অধ্যবসায় ও নৈতিকতার সমন্বয়ে।”

তিনি মনে করিয়ে দেন, ‘ব্রেন ড্রেইন’ বা মেধাপ্রবাহ কেবল বাহ্যিক কারণে ঘটে না; বরং কখনো ধৈর্যহীনতা, দূরদর্শিতার অভাব বা স্বদেশপ্রেমের ঘাটতিও এর পেছনে কাজ করে।

বিজ্ঞান ও নৈতিকতার ভারসাম্য
তিনি আরও বলেন, “শুধু জ্ঞান অর্জন সুখ দেয় না; নৈতিকতার দিশা ছাড়া জ্ঞান কখনোই শান্তি আনে না।” তিনি উদাহরণ দেন আলবার্ট আইনস্টাইন-এর জীবনের। আইনস্টাইন তাঁর আবিষ্কারের পর গভীরভাবে মর্মাহত হন, কারণ তাঁর তত্ত্বকে পরবর্তীতে যুদ্ধ ও ধ্বংসযজ্ঞের অস্ত্র তৈরিতে ব্যবহার করা হয়। তিনি বলেন, “আইনস্টাইনের সঙ্গে বিভিন্ন ধর্মীয় ব্যক্তিত্বের চিঠিপত্রে দেখা যায়, তিনি মানবিকতার অপব্যবহার নিয়ে গভীর অনুতাপ প্রকাশ করেছিলেন। এটি আমাদের শেখায়—বিজ্ঞানকে নৈতিকতার সঙ্গে যুক্ত না করলে তা মানবতার জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে।”

দৃঢ়তা ও ঈমানের চার স্তম্ভ: শহীদ সাইয়্যেদ হাসান নাসরুল্লাহ
হুজ্জাতুল ইসলাম তাগিপুর বলেন, “সাইয়্যেদ হাসান নাসরুল্লাহ তাঁর জীবনের তিন দশকেরও বেশি সময় সংগ্রাম ও আত্মত্যাগে কাটিয়েছেন। কঠোর নিরাপত্তা ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও তিনি দৃঢ়ভাবে নিজের আদর্শে অটল ছিলেন। প্রতিদিন তাঁকে একাধিকবার বাসস্থান পরিবর্তন করতে হতো, কিন্তু কখনো ভয় বা হতাশায় ভেঙে পড়েননি।”

তিনি বলেন, “নাসরুল্লাহর জীবনে চারটি গুণ স্পষ্টভাবে বিদ্যমান—সাহস, প্রজ্ঞা, ধৈর্য ও আল্লাহর প্রতি ভরসা। এই চার গুণই তাঁর অন্তরস্থ শান্তি, স্থিরতা ও আনন্দের উৎস।”

জীবনের বাস্তব শিক্ষা: পড়ে গিয়ে আবার উঠা
তার মতে, বড় ব্যক্তিত্বদের জীবন অধ্যয়ন করা শুধু অনুপ্রেরণার উৎস নয়, মানসিক প্রশিক্ষণও বটে।
এগুলো আমাদের শেখায়, বাস্তবতা কখনো সহজ নয়—ব্যর্থতা ও কষ্ট জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। কিন্তু যারা ধৈর্য ও ঈমানের সঙ্গে সেই কষ্টকে মোকাবিলা করতে শেখে, তারাই প্রকৃত সফল মানুষ।

তিনি বলেন, “এই অধ্যয়ন আমাদের শেখায়, পতন মানে পরাজয় নয়। বরং পতনের পর উঠে দাঁড়ানোর সাহসই মানুষের আসল শক্তি।”

তিনি বলেন, “যারা সফল, তারা একদিনে সফল হয়নি। তারা প্রতিটি ব্যর্থতার মধ্য দিয়ে শিক্ষা নিয়েছে, প্রতিটি কষ্টকে রূপ দিয়েছে শক্তিতে। তাই জীবনে যদি ব্যর্থতা আসে, মনে রাখতে হবে—এটাই শেষ নয়; বরং নতুন সূচনার সময়।”

তিনি উপসংহারে বলেন, “সুখের সূত্র আসলে খুব সরল—প্রেরণাদায়ক ব্যক্তিত্বদের জীবন থেকে শিক্ষা নাও, ধৈর্য ও প্রজ্ঞার চর্চা করো, এবং ঈমানের আলোয় জীবন চালাও।
তাহলেই জীবনের প্রতিটি অধ্যায় হয়ে উঠবে শান্তি, দৃঢ়তা ও আনন্দে ভরপুর।”

আপনার কমেন্ট

You are replying to: .
captcha