সোমবার ১৩ অক্টোবর ২০২৫ - ০৯:৫৬
ইমাম মাহদী (আ.ফা.)-এর গায়বাতের যুগে উম্মতের নেতৃত্ব

ইমাম মাহদী (আ.ফা.)-এর গায়বাতের পর ইসলামী উম্মতের নেতৃত্ব ও ইমামতের দায়িত্ব কার ওপর ন্যস্ত? উম্মতের ওপর কারও নেতৃত্ব বা ‘ওলায়াত’ (বেলায়েত) আছে কি? যদি থাকে, তবে তার সীমা ও পরিসর কতটুকু?

হাওজা নিউজ এজেন্সি: ইসলামের ইতিহাসের শুরু থেকেই নেতৃত্ব ও ওলায়াতের প্রশ্নটি সমাজের মৌলিক ও কেন্দ্রীয় বিষয় হিসেবে বিবেচিত হয়ে এসেছে। পবিত্র নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লাম) যেমন ইসলামি শরিয়ত, শিক্ষা ও বিধানসমূহ প্রচার ও ব্যাখ্যা করেছেন, তেমনি তিনি উম্মতের নেতা ও ওলি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁর পর ইমামগণ (আলাইহিমুস সালাম) সমাজের ধর্মীয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের ভার গ্রহণ করেছেন।

অর্থাৎ, সকল মুসলমান তাদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে তাঁদের আনুগত্যে বাধ্য ছিলেন। এ বিষয়ে কোনো শিয়া মুসলমানের মধ্যে বিন্দুমাত্র সংশয় বা দ্বিধা নেই।

তবে প্রশ্ন হলো— দ্বাদশ ইমাম (আ.ফা.)-এর গায়বাতের পর উম্মতের নেতৃত্বের দায়িত্ব কার ওপর বর্তায়? নেতৃত্ব কি কারও হাতে ন্যস্ত রয়েছে? যদি ন্যস্ত থাকে, তবে সেই ওলায়াত বা নেতৃত্বের পরিসর ও সীমারেখা কোথায়?

এই মৌলিক প্রশ্নের উত্তরে ইসলামী ফিকহের ইতিহাসে যুগে যুগে আলোচিত একটি ধারণা রয়েছে, যার নাম — “ওলায়াতে ফকিহ” (বেলায়েতে ফকিহ) বা “যোগ্য ফকিহের নেতৃত্ব”।

ওলায়াতে ফকিহের ধারণা ও অর্থ
“ওলায়াত” বা বেলায়েত (ولایت) শব্দটি এসেছে আরবি মূল “ওলি” (ولی) থেকে, যার আদি অর্থ হলো— দুটি বস্তুর বা ব্যক্তির মধ্যে সংলগ্নতা বা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক।¹ এই কারণেই শব্দটি “বন্ধুত্ব”, “সহযোগিতা”, “সহচরিতা” ও “অনুসরণ” অর্থেও ব্যবহৃত হয়।

এর একটি বহুল ব্যবহৃত অর্থ হলো — “কারও কাজ বা দায়িত্বের তত্ত্বাবধান ও পরিচালনা”। এই অর্থে “ওলি” বলতে সেই ব্যক্তিকে বোঝায়, যিনি অন্যদের বিষয়াদি পরিচালনা করেন, তাঁদের ওপর দায়িত্বশীল ও সিদ্ধান্তগ্রহণকারী। “ওলায়াতে ফকিহ” প্রসঙ্গে এই অর্থটিই প্রকৃতভাবে প্রযোজ্য।

অন্যদিকে, “ফকিহ” (فقیه) শব্দটি এসেছে “ফিকহ” (فقه) মূল থেকে, যার অর্থ “গভীরভাবে বোঝা” বা “গভীর জ্ঞান”। এটি সাধারণত দ্বীনি জ্ঞান ও শরিয়তি বোধের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়।²

অতএব, “ফকিহ” হচ্ছেন সেই ব্যক্তি, যিনি ইসলামী বিধানসমূহের ব্যাপারে গভীর ও পূর্ণাঙ্গ জ্ঞান রাখেন এবং কুরআন ও রেওয়ায়েতের ভিত্তিতে আল্লাহর হুকুম নির্ণয় করতে সক্ষম। অর্থাৎ, যিনি শরিয়তের পূর্ণ ধারণা ও গভীর বোধ দ্বারা সামাজিক, রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত জীবনের ক্ষেত্রে ইসলামী বিধান প্রয়োগ করতে পারেন, তিনিই প্রকৃত ফকিহ।

ওলায়াতে ফকিহের ঐতিহাসিক পটভূমি
অনেকেই ভুল করে মনে করেন যে, “ওলায়াতে ফকিহ” একটি নতুন রাজনৈতিক ধারণা, যা ইমাম খোমেনি (রহ.)-এর চিন্তাধারা থেকে উদ্ভূত। কিন্তু বাস্তবে এটি একটি গভীর ফিকহি ও ঐতিহাসিক ভিত্তিসম্পন্ন ইসলামী তত্ত্ব, যার শিকড় আহলে বাইত (আ.)-এর বাণী ও রেওয়ায়েতে নিহিত রয়েছে।

ইমামগণ (আ.) ধর্মীয় ও সামাজিক প্রয়োজনে ফকিহদের নির্দিষ্ট ওলায়াত ও প্রতিনিধিত্বের অধিকার প্রদান করেছেন। তাঁদের পর যুগে যুগে শিয়া ফকিহরা এই তত্ত্বকে আলোচনা, বিশ্লেষণ ও সম্প্রসারণ করেছেন। নিচে বিভিন্ন যুগের বিশিষ্ট ফকিহদের কিছু বক্তব্য তুলে ধরা হলো—

১️. শেখ মুফিদ (মৃত্যু ৪১৩ হিজরি)
শিয়া ফিকহের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আলেম শেখ মুফিদ (রহ.) বলেন— “যখন ন্যায়পরায়ণ শাসক (অর্থাৎ ইমাম মাসুম আ.) উপস্থিত না থাকেন, তখন ন্যায়পরায়ণ ও বিজ্ঞ ফকিহদের ওপর দায়িত্ব বর্তায় যে, তাঁরা সেই সকল দায়িত্ব পালন করবেন, যা সাধারণত ন্যায়পরায়ণ শাসকের দায়িত্ব।”³

অর্থাৎ, ইমাম মাসুম (আ.)-এর অনুপস্থিতিতে সমাজের নেতৃত্ব, বিচার ও প্রশাসনিক দায়িত্ব পালনের দায়িত্ব ন্যায়পরায়ণ ও যোগ্য ফকিহদের ওপর অর্পিত হয়।

২️. মুহাক্কিক সানি (মুহাক্কিক কারকী, মৃত্যু ৯৪০ হিজরি)
তিনি বলেন— “মানুষের মধ্যে বিচার করা, হদ্দ কার্যকর করা এবং বিরোধ নিষ্পত্তি করা কারও জন্য বৈধ নয়, যদি না সে ‘সুলতানে হাক্ক’ (অর্থাৎ ইমাম মাসুম আ.)-এর অনুমোদিত প্রতিনিধি হয় এবং যখন ইমামগণ নিজেরা তা সম্পাদন করতে সক্ষম না হন (অনুপস্থিত থাকেন), তখন নিঃসন্দেহে এই দায়িত্ব শিয়া ফকিহদের ওপর অর্পিত হয়।”⁴

তিনি আরও বলেন— “ইমামিয়া ফকিহরা সর্বসম্মতিক্রমে একমত যে, ন্যায়পরায়ণ ও যোগ্য ফকিহ — যিনি ফতোয়া প্রদানে সক্ষম — গায়বাতের যুগে সমস্ত সেই বিষয়সমূহে ইমামগণের প্রতিনিধি (নায়েবে ইমাম), যেগুলো নিয়াবতের উপযুক্ত।”⁵

৩️. মুল্লা আহমদ নারাকি (ফাজেল নারাকি, মৃত্যু ১২৪৪ হিজরি)
প্রখ্যাত আলেম মুল্লা আহমদ নারাকি (রহ.), যিনি “ফাজেল নারাকি” নামে পরিচিত, বলেন— “যে সমস্ত বিষয়ে নবী (সা.) ও ইমামগণ (আ.)— যারা ইসলাম সংরক্ষণের দায়িত্বপ্রাপ্ত— ওলায়াত ও কর্তৃত্ব রাখেন, সেই সমস্ত বিষয়ে ফকিহেরও একই রকম ওলায়াত ও কর্তৃত্ব রয়েছে; তবে সেইসব ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম, যেখানে বিপরীত কোনো প্রমাণ বিদ্যমান।”⁶

৪️. আয়াতুল্লাহ গুলপয়গানি (রহ.)
সমসাময়িক যুগের প্রখ্যাত আলেম আয়াতুল্লাহ সাইয়্যেদ মোহাম্মদ রেজা গুলপয়গানি (রহ.) বলেন— “ফকিহদের কর্তৃত্বের পরিসর সাধারণ ও ব্যাপক। যোগ্য ফকিহের ওলায়াতের সীমা সমাজ পরিচালনা, প্রশাসন ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের ক্ষেত্রে ইমামগণের (আ.) ওলায়াতের মতোই, কেবল সে ক্ষেত্রগুলো ছাড়া যেখানে স্পষ্ট প্রমাণ দ্বারা ব্যতিক্রম প্রমাণিত হয়।”⁷

ঐতিহাসিক ঐক্যমত্য
উপরের উদ্ধৃতিগুলো কেবল কয়েকটি উদাহরণ মাত্র। শত শত ফকিহের রচনা, ফতোয়া ও বক্তব্যে “ওলায়াতে ফকিহ”-এর পক্ষে স্পষ্ট দলিল ও যুক্তি পাওয়া যায়।

অতএব, এটি নিশ্চিতভাবে প্রমাণিত যে “ওলায়াতে ফকিহ” কোনো নতুন রাজনৈতিক ধারণা নয়; বরং শিয়া ফিকহ ও ধর্মতত্ত্বের অবিচ্ছেদ্য অংশ, যা যুগে যুগে শিয়া আলেমদের মধ্যে গ্রহণযোগ্য ও প্রতিষ্ঠিত মত হিসেবে বিদ্যমান ছিল।

সমসাময়িক প্রয়োগ: ইমাম খোমেনি (রহ.)
ইমাম খোমেনি (রহ.) যুগসচেতনতা ও দূরদর্শিতার এক অনন্য উদাহরণ স্থাপন করেছেন। তিনি এই ইসলামী তত্ত্ব— ওলায়াতে ফকিহ’কে স্পষ্টভাবে সমাজে প্রচার ও বাস্তবায়ন করেছেন।

ইমাম খোমেনি (রহ.) কেবল এই ধারণাকে তাত্ত্বিক স্তরে সীমাবদ্ধ রাখেননি; বরং বাস্তব সমাজে, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কাঠামোতে প্রয়োগ করে দেখিয়েছেন যে, ইসলামী শাসনের পূর্ণাঙ্গ রূপ গায়বাতের যুগেও সম্ভব।

তিনি “ওলায়াতে ফকিহ”-এর ভিত্তিতে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান প্রতিষ্ঠা করে এটি প্রমাণ করেছেন যে, আল্লাহর বিধানভিত্তিক শাসনব্যবস্থা আজও কার্যকর ও ফলপ্রসূ হতে পারে।

এভাবেই “ওলায়াতে ফকিহ”-কে তিনি বিশ্ববাসীর সামনে গায়বাতের যুগে ইসলামী রাষ্ট্রের সর্বোত্তম ও পূর্ণাঙ্গ রূপ হিসেবে উপস্থাপন করেন।

এ থেকে স্পষ্ট যে, “ওলায়াতে বা বেলায়েতে ফকিহ” এমন একটি ইসলামী নীতি, যা কুরআন, সুন্নাহ, আহলে বাইতের (আ.) বাণী ও ফিকহি ঐতিহ্যের সঙ্গে সম্পূর্ণ সামঞ্জস্যপূর্ণ। এই ধারণা শুধু ধর্মীয় বা তাত্ত্বিক আলোচনা নয়; বরং ইসলামী সমাজের শৃঙ্খলা, ন্যায়বিচার, নেতৃত্ব ও ঐক্যের ভিত্তি।

এই আলোচনা চলমান...

-উৎস: ‘নেগিনে অফারিনেশ’ থেকে (সামান্য সম্পাদনাসহ) গৃহীত।

পাদটীকাসমূহ:

১. মুফরাদাতুর রাগিব, মূল শব্দ: «ولی»

২. লিসানুল আরব, খণ্ড ১৩, মূল শব্দ: «فقه»

৩. আল-মুকনেআহ, পৃষ্ঠা ৬৭৫

৪. নুকাতুন নিহায়া, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ১৭

৫. রসায়েল, আল-মুহাক্কিক আল-কর্কী, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ১৪২

৬. আওয়াইদুল আইয়্যাম, পৃষ্ঠা ১৮৭ ও ১৮৮

৭. আল-হিদায়া ইলা মান লাহুল উইলায়া, পৃষ্ঠা ৪৬–৪৭

আপনার কমেন্ট

You are replying to: .
captcha