হাওজা নিউজ এজেন্সি: হযরত মাওলানা মেহেদী আরবাবী ইমাম ও খতিব, বাঞ্জার শহরের জুমার নামাজে হযরত জয়নাব (সা.আ.)-এর অতুলনীয় মর্যাদা ও ঐতিহাসিক ভূমিকা ব্যাখ্যা করেন। তিনি বলেন, হযরত জয়নাব (সা.আ.) এমন এক ঘরে লালিত-পালিত হন, যা ছিল ভাষার সৌন্দর্য, যুক্তির দীপ্তি ও জ্ঞানের আলোয় উদ্ভাসিত। তাঁর পিতা, হজরত আলী (আ.), যাঁর ভাষণসমূহ ‘নাহজুল বালাগা’য় অমর হয়ে আছে, এমনকি অমুসলিম চিন্তাবিদ জর্জ জারদাক, হোসেইন আবদু ও সুন্নি পণ্ডিত ইবনে আবিল হাদিদও বারবার তাঁর বক্তব্যকে উদ্ধৃত করেছেন। তাঁর মা, হযরত ফাতিমা (সা.আ.), ‘ফাদকী’ ভাষণের মাধ্যমে ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন। এই পারিবারিক শিক্ষাই হযরত জয়নাব (সা.আ.)-এর ভাষার শক্তি, যুক্তির দীপ্তি ও সাহসিকতার ভিত্তি।
কুফা ও শামে তাঁর ভাষণ শুধু গভীর ভাবসম্পন্নই ছিল না, বরং সমাজে চেতনার সঞ্চার ঘটায়, ইয়াজিদের মিথ্যাচার উন্মোচন করে এবং জনগণের মাঝে প্রতিরোধের স্পৃহা জাগিয়ে তোলে। ইয়াজিদের রাজপ্রাসাদে তিনি নির্ভয়ে সত্যের ভাষায় শক্তির ভাষাকে প্রতিস্থাপন করেন।
ইমাম আরবাবী বলেন, হযরত জয়নাব (সা.আ.)-এর জীবনীতে দুটি গৌরবময় বৈশিষ্ট্য স্পষ্ট—ধৈর্য ও সত্যের ব্যাখ্যা। তিনি বিপদের মুখে ধৈর্য ধারণ করে এবং সত্যকে সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরে মিথ্যার মুখোশ খুলে দেন। বিশ্বের স্বাধীনচেতা জাতিগণ এই দুই গুণ থেকে অনুপ্রেরণা নিতে পারে।
তিনি আরও বলেন, হযরত জয়নাব (সা.আ.) সংকটকে সুযোগে রূপান্তরিত করেন, যা প্রতিরোধকারী জাতিগণের জন্য একটি মহান শিক্ষা—সচেতন নেতৃত্বের মাধ্যমে হুমকিকে উন্নয়ন ও বিকাশের উপাদানে পরিণত করা যায়।
তিনি আশুরার দুই মূল স্তম্ভের কথা উল্লেখ করে বলেন, আশুরা দাঁড়িয়ে আছে ইমাম হোসেইন (আ.)-এর শাহাদত এবং হযরত জয়নাব (সা.আ.) ও ইমাম সাজ্জাদ (আ.)-এর সত্য উদ্ঘাটনের ওপর। যদি সমাজ অজ্ঞতায় নিমজ্জিত হয়, তবে পথনির্দেশ হারিয়ে যায় এবং শত্রু সর্বাধিক লাভবান হয়। হযরত জয়নাব (সা.আ.)-এর ভাষণ জনগণের মধ্যে সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক জাগরণ সৃষ্টি করে, এমনকি ইয়াজিদ পরাজয় স্বীকার করতে বাধ্য হন এবং আহলে বাইতকে সম্মানসহ মদিনায় ফিরিয়ে দেন। এই জাগরণই পরবর্তীতে সিস্তানের বিদ্রোহ, তাওয়াবিনের আন্দোলন ও মুখতারের বিপ্লবের বীজ রোপণ করে। অর্থাৎ, হযরত জয়নাব (সা.আ.) শুধু তাঁর সময়ের জন্য কথা বলেননি, বরং প্রতিরোধের সংস্কৃতির ভিত্তি স্থাপন করেন—যার তিনটি স্তম্ভ: শত্রুকে চিনে নেওয়ার অন্তর্দৃষ্টি, কঠিন পরিস্থিতিতেও সত্যের পথে অটল থাকা এবং ধর্মের বার্তা বিকৃতির বিরুদ্ধে সচেতনভাবে প্রচার করা।
তিনি বলেন, হযরত জয়নাব (সা.আ.)-এর যুগে প্রচারের মাধ্যম ছিল ভাষণ ও চিঠি, আজও সেই দায়িত্ব অটুট। আজকের গণমাধ্যমকে তাঁর পথ অনুসরণ করতে হবে: প্রথমত, সময়োপযোগীভাবে সত্য উদ্ঘাটন করতে হবে, দ্বিতীয়ত, শত্রুর বিকৃতির দ্রুত জবাব দিতে হবে, এবং তৃতীয়ত, তথ্য প্রচারের উদ্দেশ্য হতে হবে জনগণের জাগরণ, মনোযোগ আকর্ষণ নয়।
তিনি জোর দিয়ে বলেন, সাংস্কৃতিক প্রতিরোধই আজকের যুগে হযরত জয়নাব (সা.আ.)-এর দায়িত্বের ধারাবাহিকতা। ইয়াজিদের শাসনকালে ধর্ম বিকৃত হয়েছিল, তখন ইমাম হোসেইন (আ.)-এর রক্ত এবং হযরত জয়নাব (সা.আ.)-এর ভাষণই ছিল সেই বিকৃতির বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধ। আজও মুসলিম জাতিগণ পশ্চিমা সাংস্কৃতিক ও মিডিয়া আগ্রাসনের বিরুদ্ধে এই পথেই চলতে হবে।
তিনি বলেন, ইয়াজিদের অবমাননার রাজনীতির মুখে হজরত জয়নাব (সা.আ.) সম্মান ও আত্মমর্যাদার সঙ্গে দাঁড়ান এবং প্রমাণ করেন, দেহের বন্দিত্ব মানেই আত্মার বন্দিত্ব নয়। মুসলিম জাতিগণও সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা রক্ষায় পশ্চিমা ভোগবাদী সংস্কৃতি থেকে দূরে থাকতে হবে। সাংস্কৃতিক মর্যাদা মানে—আমরা নিজেরাই সৌন্দর্য, নৈতিকতা, অগ্রগতি ও মানবতার মানদণ্ড নির্ধারণ করব, অন্যদের অনুকরণ নয়।
তিনি বলেন, হযরত জয়নাব (সা.আ.)-এর বার্তা এক বাক্যে: প্রাণ দিয়ে হলেও সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়াও এবং অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াও।
তিনি বলেন, আজকের দিনে সেই অত্যাচারী শক্তির প্রতীক হলো শিশু হত্যাকারী ইসরায়েলি শাসন। বিশ্বের স্বাধীন জাতিগণ হযরত জয়নাব (সা.আ.)-এর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে এই শাসনের বিরুদ্ধে ঘৃণা প্রকাশ করছে।
শেষে তিনি বলেন, আজকের তরুণ প্রজন্মের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হলো ‘জিহাদে তাবিয়িন’—অর্থাৎ সত্যের ব্যাখ্যা ও প্রচার। যেমন হযরত জয়নাব (সা.আ.) সমাজে চেতনার আলো ছড়িয়েছেন, তেমনি তরুণদেরও বিশেষ করে গণমাধ্যমে এই দায়িত্ব পালন করতে হবে। তবে এর জন্য প্রয়োজন জ্ঞান, সচেতনতা ও ধর্মীয় অন্তর্দৃষ্টি। হযরত জয়নাব (সা.আ.) নারীদের জন্যও একটি অনন্য আদর্শ।
অনুবাদ: হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমিন ড. মুহাম্মাদ ফারুক হুসাইন
আপনার কমেন্ট