বুধবার ৫ নভেম্বর ২০২৫ - ০৭:২৯
কেন হযরত ফাতিমা (সা.আ.) ইমামত ও বেলায়েতের পক্ষে প্রাণ বিসর্জন দিলেন?

হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমিন সাইয়্যেদ মাহদি তাওয়াক্কুল বলেছেন—নবী করিম (সা.)-এর ইন্তেকালের পর অতি সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যেই হযরত ফাতিমা যাহরা (সা.আ.) প্রতিরোধ, নেতৃত্বনিষ্ঠা (ولایت‌مداری), বিচ্যুতি ও অহংকারবাদের (استکبار) বিরুদ্ধে সংগ্রামের এক উজ্জ্বল প্রতীকে পরিণত হন। তিনি এমন এক আদর্শ, যাঁর জীবনের দিকে যত গভীরভাবে তাকানো যায়, তত নতুন দিক উন্মোচিত হয়—যা বেলায়েত (নেতৃত্ব) রক্ষার প্রকৃত অর্থ ও গুরুত্বকে আমাদের সামনে তুলে ধরে।

হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমিন তাওয়াক্কুল হযরত ফাতিমা যাহরা (সা.আ.)-এর শাহাদাত বার্ষিকী উপলক্ষে হাওজা নিউজ এজেন্সি’কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ফাতিমিয়্যা দিবস কেবল শোকের সময় নয়; বরং এটি এমন এক গুরুত্বপূর্ণ উপলক্ষ, যখন মানব ইতিহাসের অন্যতম সচেতন ও লক্ষ্যনিষ্ঠ আন্দোলন—সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে পরিচালিত প্রতিরোধ— পুনরায় স্মরণ ও বিশ্লেষণের সুযোগ পাওয়া যায়।

বেলায়েতের পক্ষে অবস্থান কখনোই অহংকারী ও আধিপত্যবাদী শক্তির বিরোধিতা থেকে আলাদা নয়
তিনি বলেন, নবী করিম (সা.)-এর ওফাতের পর অল্প সময়ের মধ্যেই হযরত ফাতিমা যাহরা (সা.আ.) প্রতিরোধ, নেতৃত্বনিষ্ঠা ও বিচ্যুতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রতীকে পরিণত হন। তাঁর সংগ্রাম ছিল অন্যায় ও অহংকারবাদের বিরোধিতার অবিচ্ছেদ্য অংশ। কারণ, যদি সবাই নেতৃত্ব (ولایت)-এর প্রতি অনুগত থাকত, তবে এর পক্ষে দাঁড়ানোর প্রয়োজনই হতো না।

কোমের হাওজায়ে ইলমিয়ার এই উস্তাদ বলেন, শিয়া ও সুন্নি উভয় মতানুসারে, নবী করিম (সা.) তাঁর জীবদ্দশায় এমন কোনো বিষয় রাখেননি যা মানুষকে জান্নাতের কাছাকাছি বা জাহান্নাম থেকে দূরে রাখে—সবকিছুই তিনি সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করে গেছেন। ইমাম বাকির (আ.) একটি হাদীসে বলেন,
خَطَبَ رَسُولُ اللَّهِ فِی حَجَّةِ الْوَدَاعِ فَقَالَ: یَا أَیُّهَا النَّاسُ وَ اللَّهِ مَا مِنْ شَیْ‏ءٍ یُقَرِّبُکُمْ مِنَ الْجَنَّةِ وَ یُبَاعِدُکُمْ‏ مِنَ النَّارِ إِلَّا وَ قَدْ أَمَرْتُکُمْ بِهِ وَ مَا مِنْ شَیْ‏ءٍ یُقَرِّبُکُمْ مِنَ النَّارِ وَ یُبَاعِدُکُمْ‏ مِنَ الْجَنَّةِ إِلَّا وَ قَدْ نَهَیْتُکُمْ عَنْه‏.
অর্থাৎ—রাসূলুল্লাহ (সা.) বিদায়ী হজে খুতবা প্রদান করে বলেছিলেন, “হে মানুষেরা! আল্লাহর কসম, এমন কোনো বিষয় নেই যা তোমাদের জান্নাতের কাছে নিয়ে যায় এবং জাহান্নাম থেকে দূরে রাখে— তার প্রতি আমি তোমাদের আদেশ করিনি; আর এমন কিছু নেই যা তোমাদের জাহান্নামের দিকে নিয়ে যায় এবং জান্নাত থেকে দূরে রাখে— তা থেকে আমি তোমাদের নিষেধ করিনি।”
[আল-কাফি, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ৭৪, হাদীস ২]

হুজ্জাতুল ইসলাম তাওয়াক্কুল বলেন, তাহলে প্রশ্ন আসে— এমন এক নবী, যিনি তাঁর উম্মতের প্রতি অসীম করুণাশীল ছিলেন, তিনি কি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়— নেতৃত্ব ও উত্তরাধিকার (খিলাফত ও বেলায়েত)— তা উম্মতের হাতে ছেড়ে দিতে পারেন? নিশ্চয়ই না। কারণ, তিনি নিজেই বলেছেন,
إِنَّ أُمَّتِی سَتَفْتَرِقُ بَعْدِی عَلَی ثَلَاثٍ‏ وَ سَبْعِینَ‏ فِرْقَةً فِرْقَةٌ مِنْهَا نَاجِیَةٌ وَ اثْنَتَانِ وَ سَبْعُونَ فِی النَّارِ.
“আমার উম্মত আমার পর ৭৩টি দলে বিভক্ত হবে; এর মধ্যে মাত্র একটি দল মুক্তি পাবে, আর বাকি ৭২টি দল জাহান্নামী হবে।” [খিসাল সাদূক, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ৫৮৫, হাদীস ১১]

তিনি বলেন, তাহলে কীভাবে নবী (সা.) এমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়— যা উম্মতের ঐক্য রক্ষা করতে পারত— তা নির্ধারণ না করেই বিদায় নিতে পারেন? এখানেই দেখা যায়, নবী করিম (সা.)-এর ইন্তেকালের পর যখন সাকিফায় নেতৃত্বের প্রশ্নটি বিকৃত পথে মোড় নেয়, তখন হযরত ফাতিমা যাহরা (সা.আ.)— নিজ জীবনের শেষ দিনগুলোতে—অতুলনীয় দৃঢ়তা ও সাহসিকতার সঙ্গে এমন কিছু পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, যা ইসলামী ইতিহাসে এক অনন্য অধ্যায় হিসেবে রয়ে গেছে।

তিনি সেই পবিত্র নারী, যাঁর সম্পর্কে শিয়া ও সুন্নি উভয় দলই একমত যে, তাঁর সন্তুষ্টি আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং তাঁর ক্রোধ আল্লাহর ক্রোধের কারণ হয়।

হযরত ফাতিমা যাহরা (সা.আ.)— আল্লাহর গুণাবলির এক অনন্য প্রতিফলন
হাওজাভিত্তিক এই গবেষক বলেন, শিয়া ও সুন্নি— উভয় সম্প্রদায়ের অসংখ্য প্রামাণিক গ্রন্থে উক্ত হাদীস ও রেওয়ায়েতসমূহ নানা শব্দ ও ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় বর্ণিত হয়েছে। ইতিহাসে কখনো কোনো শিয়া বা সুন্নি আলেম এই হাদীসগুলোর প্রামাণিকতা ও সত্যতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেননি কিংবা আপত্তি তোলেননি।

রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর একটি হাদীসে আমরা পড়ি:
أَنَّ اللَّهَ یَغْضَبُ لِغَضَبِ فَاطِمَةَ وَ یَرْضَی لِرِضَاهَا
“নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা ফাতিমা (সা.আ.)-এর ক্রোধে ক্রোধান্বিত হন এবং তাঁর সন্তুষ্টিতে সন্তুষ্ট হন।” [আমালি-ই-সাদূক, পৃষ্ঠা ৩৮৪]

এই হাদীসটি স্পষ্টভাবে হযরত ফাতিমা যাহরা (সা.আ.)-এর ইসমাত তথা নিষ্পাপ ও ত্রুটিমুক্ত সত্তার প্রতি ইঙ্গিত করে। এটি প্রমাণ করে যে, হযরত ফাতিমা (সা.আ.) এমন এক উচ্চ আধ্যাত্মিক অবস্থানে পৌঁছেছিলেন যেখানে তাঁর প্রতিটি আচরণ, উক্তি ও কার্যকলাপ সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর ইচ্ছা ও সন্তুষ্টির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল।

নিশ্চিতভাবেই, এমন এক পরিপূর্ণ ও নিষ্পাপ মানবসত্তা যদি কারও কারণে সামান্যতম কষ্টও অনুভব করেন, তবে যিনি তাঁকে কষ্ট দিয়েছেন, তিনি নিঃসন্দেহে ভুল করেছেন ও তার জন্য দায়ী।

আমরা দেখি যে, সাকিফার ঘটনার পর হযরত ফাতিমা (সা.আ.) ফাদাকের খুতবা প্রদান করেন। খুতবার আগে যখন তিনি মসজিদে প্রবেশ করেন, তখন এমন এক হৃদয়বিদারক আহাজারি করেন যে, মসজিদে উপস্থিত সকল মানুষ অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়ে।

বর্ণনায় এসেছে:
ثُمَّ أَنَّتْ أَنَّةً أَجْهَشَ الْقَوْمُ لَهَا بِالْبُکَاءِ، فَارْتَجَّ الْمَجْلِسُ، ثُمَّ أَمْهَلَتْ هُنَیْئَةً حَتَّی إِذَا سَکَنَ نَشِیجُ الْقَوْمِ وَ هَدَأَتْ فَوْرَتُهُمْ، افْتَتَحَتِ الْکَلَامَ.
“এরপর তিনি এমন এক আর্তনাদ করলেন যে উপস্থিত সবাই হাউমাউ করে কেঁদে উঠল এবং পুরো সভাস্থল কেঁপে উঠল। কিছুক্ষণ তিনি নীরব থাকলেন, যতক্ষণ না মানুষের কান্না ও আবেগ শান্ত হলো, তখন তিনি ভাষণ শুরু করলেন।” [ইহতেজাজে তাবরসী, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ৯৮]

এই গবেষক বলেন, সত্যিই, কে সেই ব্যক্তি বা গোষ্ঠী যারা তাঁকে এমন কষ্টে নিমজ্জিত করেছিল? এবং আল্লাহ কি সেই কারণে ক্রোধান্বিত হননি?

তিনি আরও বলেন, কেন হযরত ফাতিমা (সা.আ.) ফাদাকের খুতবার শুরুতেই আমিরুল মুমিনিন আলী (আ.)-এর মহত্ত্ব, মর্যাদা ও ফজিলত উল্লেখ করলেন? কেন তিনি খলিফার আসনে আসীন আবু বকরের সঙ্গে উত্তরাধিকার (মীরাস) বিষয়ে বিতর্কে অবতীর্ণ হলেন? কেন তিনি কুরআনের একাধিক আয়াত দ্বারা নিজের দাবির প্রমাণ উপস্থাপন করলেন এবং রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কাছ থেকে পাওয়া নিজের উত্তরাধিকার দাবি করলেন?

এসব কি প্রমাণ করে না যে হযরত সিদ্দিকাতুত-তাহিরা (সা.আ.)-এর মধ্যে তখন তীব্র অসন্তোষ ও ক্রোধ বিদ্যমান ছিল?

কিছু আহলে সুন্নাত লেখক দাবি করেন— “হযরত (সা.আ.) নারীত্বজনিত আবেগে সামান্য কষ্ট পেয়েছিলেন, পরে আবার সন্তুষ্ট হন।” কিন্তু এই দাবি কি যুক্তিসঙ্গত হতে পারে?

যদি এমন বলা হয়, তবে কি এর মানে এই নয় যে আল্লাহ তাআলাও, নাওযুবিল্লাহ, কিছু সময়ের জন্য তাঁর (সা.আ.) ক্রোধের কারণে ক্রোধান্বিত হলেন এবং পরে সন্তুষ্ট হলেন? অথচ কুরআনে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে:
أَنَّ اللَّهَ هُوَ الْحَقُ الْمُبِينُ
“নিশ্চয়ই আল্লাহই পরম সত্য ও স্পষ্ট বাস্তবতা।” [সূরা নূর, আয়াত ২৫]

তাহলে কি আল্লাহ, নাওযুবিল্লাহ, সত্যকে উপেক্ষা করে তাঁর কোনো বান্দার অনুসারী হয়ে পড়েন? অবশ্যই না। বরং সঠিক ব্যাখ্যা হলো—সিদ্দিকাতুত-তাহিরা (সা.আ.)-এর ক্রোধ ও অসন্তোষ ছিল হক ও বাস্তবতার ওপর ভিত্তি করে, এবং সেই কারণেই আল্লাহর ক্রোধ তাঁর ক্রোধের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল। যেহেতু বাস্তবতা কখনো পরিবর্তনশীল নয়, সুতরাং হযরত যাহরা (সা.আ.)-ও কখনো সন্তুষ্ট হননি।

হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমিন তাওয়াক্কুল বলেন, হযরত ফাতিমা (সা.আ.)-এর অসন্তুষ্টির সবচেয়ে স্পষ্ট ও দৃঢ় প্রমাণ পাওয়া যায় তাঁর জীবনের শেষ পর্যায়ে, যখন তিনি অসুস্থ অবস্থায় শয্যাশায়ী ছিলেন। ঐ সময়ে হযরত আবু বকর ও তার সঙ্গী ওমর তাঁকে দেখতে আসেন, কিন্তু হযরত ফাতিমা যাহরা (সা.আ.) তাঁদের সাথে কথাও বলেননি এবং এটি প্রমাণ করে যে তিনি তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হননি।

সহিহ বুখারি ও সহিহ মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে:
فغضبت فاطمة بنت رسول اللَّه فهجرت أبابکر فلم تزل مهاجرته حتی توفّیت
“রাসূলুল্লাহর (সা.) কন্যা ফাতিমা (সা.আ.) আবু বকরের ওপর ক্রুদ্ধ হলেন এবং তাঁর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন; এবং মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তাঁর সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ অবস্থায় রইলেন।”
[সহিহ বুখারি, খণ্ড ৪, পৃষ্ঠা ৭৯; সহিহ মুসলিম, খণ্ড ৩, পৃষ্ঠা ১৩৮০]

এছাড়া একই দুটি গ্রন্থেই নবী করিম (সা.)-এর নিম্নোক্ত বাণীও উল্লেখিত রয়েছে:
فاطمة بَضْعَةٌ مِنّی، فَمَنْ أَغْضَبَهَا أَغْضَبَنِی»
“ফাতিমা আমারই অস্তিত্বের অংশ; যে তাঁকে ক্রুদ্ধ করবে, সে আমাকেই ক্রুদ্ধ করবে।” [সহিহ বুখারি, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ২১০]

আরেক হাদীসে নবী করিম (সা.) ইরশাদ করেন,
وَیُؤْذِینِی مَا آذَاهَا
“যে তাঁকে কষ্ট দেয়, সে আমাকে কষ্ট দেয়।” [সহিহ মুসলিম, খণ্ড ৭, পৃষ্ঠা ১৪১, হাদীস ৬২০১]

কুরআনুল কারিমেও আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেছেন:
إِنَّ الَّذینَ یُؤذُونَ اللَّهَ وَرَسُولَهُ لَعَنَهُمُ اللَّهُ فِی الدُّنْیا وَالآخِرَةِ وَأَعَدَّ لَهُمْ عَذاباً مُهِیناً
“যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে কষ্ট দেয়, আল্লাহ তাদের দুনিয়া ও আখিরাতে অভিশপ্ত করেছেন এবং তাদের জন্য প্রস্তুত রেখেছেন লাঞ্ছনাকর শাস্তি।” [সূরা আহযাব, আয়াত ৫৭]

অতএব, এখন তিনটি সম্ভাবনা অবশিষ্ট থাকে:
১️. নাওযুবিল্লাহ, এই সমস্ত হাদীস ও আয়াতকে মিথ্যা বা অপ্রামাণিক বলা;
২️. অথবা সিদ্দিকাতুত-তাহিরা (সা.আ.)-কে ভুল ও বিভ্রান্তির অভিযোগে অভিযুক্ত করা;
৩️. অথবা সত্য ও বাস্তবতাকে মেনে নেওয়া — আর সেটি হলো, খিলাফত দখলকারীরাই আল্লাহর ক্রোধ ও অসন্তোষের কারণ হয়েছিল।

হযরত ফাতিমা যাহরা (সা.আ.) — বেলায়েতের রক্ষক ও প্রতিরক্ষক

হাওজাভিত্তিক এই আলেম বলেন, সিদ্দিকাহ তাহেরা হযরত ফাতিমা যাহরা (সা.আ.) তাঁর পবিত্র জীবদ্দশায়ও বেলায়েত বা ইমাম আলী (আ.)-এর নেতৃত্বের প্রতিরক্ষা থেকে কখনোই বিরত হননি। ফাদাকের ঐতিহাসিক খুতবার পাশাপাশি, আল্লামা মাজলিসি (রহ.)-এর বর্ণনায় এমন একটি রেওয়ায়েত পাওয়া যায়, যেখানে এসেছে—“হযরত ফাতিমা যাহরা (সা.আ.) মুহাজির ও আনসারদের ঘরে ঘরে যেতেন এবং তাঁদের আহ্বান জানাতেন সেই বাস্তবতার দিকে, যা হলো মুমিনদের নেতা আমিরুল মু’মিনীন আলী (আ.)-এর খিলাফত।”

এই রেওয়ায়েতের এক অংশে আরও উল্লেখ রয়েছে যে, হযরত (সা.আ.) মুআয ইবনে জাবালকেও এ আহ্বান জানিয়েছিলেন। মুআয বলেন, “হযরত ফাতিমা (সা.আ.) আমাকে বললেন, ‘لَا، مَا أَجَابَنِی أَحَدٌ’ — না, কেউই আমার আহ্বানে সাড়া দেয়নি।’”
তখন মুআয জিজ্ঞেস করলেন, “তাহলে আমার সাহায্যের উপকার কী?”
এই সময় সিদ্দিকাহ তাহেরা (সা.আ.), যিনি হৃদয়বিদারক কষ্টে ও ক্রোধে পরিপূর্ণ ছিলেন, বললেন,

 “وَ اللَّهِ لَا أُكَلِّمُكَ كَلِمَةً حَتَّى أَجْتَمِعَ أَنَا وَ أَنْتَ عِندَ رَسُولِ اللَّهِ (ص)، ثُمَّ انْصَرَفَتْ”

“আল্লাহর শপথ! আমি তোমার সঙ্গে আর একটি শব্দও বলব না, যতক্ষণ না আমরা দু’জন আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর সামনে উপস্থিত হই এবং তিনি আমাদের মধ্যে বিচার করেন।” [বিহারুল আনওয়ার, খণ্ড ২৯, পৃষ্ঠা ১৯২]

তিনি আরও বলেন, হযরত ফাতিমা যাহরা (সা.আ.)-এর উহুদের প্রান্তরে হযরত হামযা সাইয়্যিদুশ-শুহাদা (আ.)-এর মাজারে কান্না এবং সেই স্থানটির ‘বাইতুল আহজান’ নামে পরিচিত হওয়া— এটিও বেলায়েত রক্ষায় তাঁর অবিচল অবস্থানের আরেকটি সুস্পষ্ট প্রমাণ।

তাঁর ঘরের দরজায় আগুন লাগানো, গর্ভস্থ সন্তান মুহসিনের শাহাদাত, এবং অন্যান্য বহু মর্মান্তিক ঘটনাও প্রমাণ করে যে, হযরত ফাতিমা যাহরা (সা.আ.) সর্বান্তকরণে বেলায়েতের পথে অবিচল ছিলেন।

এখন প্রশ্ন উঠতে পারে— কেন হযরত ফাতিমা যাহরা (সা.আ.) এতো গভীরভাবে ওলায়াতের প্রতিরক্ষায় নিজেকে নিবেদিত করেছিলেন?

উত্তর স্পষ্ট— তিনি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর আনীত দ্বীনের মধ্যে এক বিপজ্জনক বিচ্যুতি ও অবিচার প্রত্যক্ষ করেছিলেন, যার প্রভাব ও পরিণতি চলতে থাকবে ইমাম মাহদী (আ.ফা.)-এর পুনরাগমন পর্যন্ত।

এই হাওজাভিত্তিক গবেষক বলেন, যেমন এক সাহাবি যখন উহুদের প্রান্তরে তাঁর ক্রন্দনের কারণ জানতে চান, তখন হযরত ফাতিমা যাহরা (সা.আ.) উত্তর দেন—

 “أَمَا وَ اللَّهِ لَوْ تَرَكُوا الْحَقَّ عَلَى أَهْلِهِ، وَ اتَّبَعُوا عِتْرَةَ نَبِيِّهِ، لَمَا اخْتَلَفَ فِي اللَّهِ اثْنَانِ، وَ لَوَرِثَهَا سَلَفٌ عَنْ سَلَفٍ، وَ خَلَفٌ بَعْدَ خَلَفٍ، حَتَّى يَقُومَ قَائِمُنَا، التَّاسِعُ مِنْ وُلْدِ الْحُسَيْنِ.”

“আল্লাহর কসম! যদি তারা হককে তার প্রকৃত অধিকারীদের কাছে অর্পণ করত এবং নবীর আহলে বাইতের আনুগত্য করত, তবে আল্লাহ সম্পর্কে দুই ব্যক্তির মধ্যেও কোনো মতভেদ থাকত না। তখন এই নেতৃত্ব প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে, ধারাবাহিকভাবে উত্তরাধিকার সূত্রে হস্তান্তরিত হতো, যতক্ষণ না আমাদের কায়েম, অর্থাৎ ইমাম মাহদী (আ.ফা.), যিনি ইমাম হুসাইন (আ.)-এর নবম বংশধর, কিয়াম করতেন।”
[বিহারুল আনওয়ার, খণ্ড ৩৬, পৃষ্ঠা ৩৫৩]
 

দুনিয়াপ্রেমই খিলাফত দখলের মূল কারণ

হুজ্জতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমিন তাওাক্কল বলেন, “এই বিষয়ে আলোচনা অত্যন্ত বিস্তৃত; তবে সারসংক্ষেপে বলা যায়— দুনিয়াপ্রেমই ছিল খিলাফত দখলের প্রধান কারণ, যা কখনো অহংকার (استکبار) ও জুলুম (ظلم) থেকে আলাদা নয়।”

আল্লাহ তায়ালা সূরা আহক্বাফে রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে উদ্দেশ করে বলেন— ‘اسْتَكْبَرْتُمْ‏ إِنَّ اللَّهَ لَا يَهْدِی الْقَوْمَ الظَّالِمِينَ’“

তোমরা অহংকার করেছিলে এবং ঈমান আনোনি; নিশ্চয়ই আল্লাহ জালেম সম্প্রদায়কে হেদায়াত করেন না।” [সূরা আহক্বাফ, আয়াত ১০]

এই আয়াতে “অহংকার” ও “জুলুম”-এর মধ্যে সরাসরি সম্পর্ক স্থাপন করা হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, “অহংকারই মানুষকে এমন অবস্থায় নিয়ে যায় যে, সে নিজেকে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর মনোনীত প্রকৃত উত্তরাধিকারীর চেয়ে উচ্চতর মনে করে। এমন ব্যক্তি কখনো আল্লাহকে বিবেচনায় রাখে না; তার দৃষ্টি থাকে কেবল দুনিয়াবি— খ্যাতি, ক্ষমতা ও প্রভাব অর্জনের দিকে। আর এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি অবশ্যম্ভাবীভাবে মানুষকে জুলুম, দখলদারিত্ব ও অন্যায়ের পথে পরিচালিত করে।”

আল্লাহ তায়ালা আরও বলেন—

‘وَ إِذَا تَوَلَّى سَعَى فِی الْأَرْضِ لِیُفْسِدَ فِیهَا وَ يُهْلِكَ الْحَرْثَ وَ النَّسْلَ’

 “যখন ওই মানুষ (মুনাফিক ও দুনিয়াপ্রেমী) তোমার কাছ থেকে সরে যায়, তখন সে পৃথিবীতে অনিষ্ট সাধনের জন্য চেষ্টা করে, যেন ফল-ফসল ও মানবজাতিকে ধ্বংস করে।”
(সূরা বাকারা, আয়াত ২০৫)

সাকিফার বিচ্যুতি আজও অব্যাহত
কোমের হাওজায়ে ইলমিয়ার আলেম ও গবেষক হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমিন সাইয়্যেদ মাহদী তাওয়াক্কুল বলেন, জাহেলিয়াত যুগের আরবরা ছিল এমন এক অজ্ঞ ও অসভ্য সমাজ, যারা পড়া-লেখা জানত না এবং যাদের সংস্কৃতি ও নৈতিকতা ছিল গভীর অবক্ষয়ের শিকার। কিন্তু মহানবী হযরত মুহাম্মদ মুস্তাফা (সা.)-এর অতুলনীয় তালিম, তারবিয়াত ও আত্মিক প্রভাবের অধীনে তারা এমনভাবে পরিবর্তিত হয়েছিল যে, দলবদ্ধভাবে ইসলাম গ্রহণ করতে শুরু করে এবং স্বল্প সময়ের মধ্যেই একটি জাহেল সমাজ রূপান্তরিত হয় ইসলামের জ্ঞানে ও নৈতিকতায় আলোকিত এক জাতিতে।

আমিরুল মুমিনিন আলী ইবনে আবি তালিব (আ.)-ও সেই ঐশী তালিম ও প্রভাবের ধারক ছিলেন। তাঁর মধ্যেও ছিল মানুষের হৃদয় রূপান্তরের সেই ব্যতিক্রমী ক্ষমতা, যা নবীজী (সা.)-এর উত্তরাধিকারসূত্রে তাঁর মধ্যে প্রতিফলিত হয়েছিল। পরবর্তী নির্দোষ ইমামগণও একই আধ্যাত্মিক শক্তি ও নেতৃত্বগুণে পরিপূর্ণ ছিলেন।

কিন্তু যখন রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর ওফাতের পর খেলাফতের ধারাটি তার প্রকৃত বেলায়েতের পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে যায়, তখন নেতৃত্ব চলে যায় এমন ব্যক্তিদের হাতে, যারা না ছিলেন রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর باب علم (জ্ঞানদ্বার), না ছিলেন আমিরুল মুমিনীন (আ.)-এর মতো ইসলামের যুদ্ধসমূহে অগ্রণী সৈনিক, এবং না তাঁদের ইসলামের রক্ষায় ছিল কোনো অসাধারণ ও অনন্য অবদান।

এই বিচ্যুতির পেছনে ছিল সেই আত্মগরিমা ও অহংকার—যা আসলে استکبار (ইস্তেকবার) বা আধিপত্যবাদের মূল শিকড়। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, সাকিফার এই প্রথম বিচ্যুতিই ছিল ইসলামী সমাজের পতনের ভিত্তি। যেমন একজন প্রাজ্ঞ কবি বলেছেন, “যদি স্থপতি প্রথম ইটটিই বাঁকা রাখে, তবে দেয়াল সপ্ত আসমান পর্যন্ত বাঁকাই উঠে যায়।”

অর্থাৎ, সাকিফার সেই ভুল ভিত্তি থেকেই পরবর্তী যুগে বহু বিচ্যুতি, বিভ্রান্তি ও অন্যায়ের জন্ম হয়েছে— যার ধারাবাহিকতা আজও বিশ্বব্যাপী অব্যাহত। এর চূড়ান্ত পরিণতি আমরা আজ প্রত্যক্ষ করছি—রক্তপিপাসু, দখলদার ও মানবতাশত্রু ইসরাইল এবং তার সমর্থক শক্তিগুলোর ভয়াবহ অপরাধ, হত্যাযজ্ঞ ও ধ্বংসযজ্ঞে।

তিনি বলেন, সালাম ও দরুদ বর্ষিত হোক সেই প্রজ্ঞাবান শহিদা, হযরত ফাতিমা যাহরা (সা.আ.)-এর ওপর, যিনি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর ওফাতের পর এমন দৃঢ়তা, সাহস ও আত্মত্যাগের সঙ্গে বেলায়েত ও ইমামতের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন যে, আজও তাঁর প্রতিরোধ, প্রতিবাদ ও বেলায়েতরক্ষার স্মৃতি ইতিহাসে অম্লান।

তিনি প্রশ্ন রাখেন— কেন রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর একমাত্র প্রিয় কন্যা নিজের অসিয়ত (উইল)-এর ভিত্তিতে এমনভাবে দাফন হতে চেয়েছিলেন যাতে তাঁর কবর আজও গোপন থাকে? কেন তিনি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর ওফাতের অল্পকাল পরেই দুনিয়া ত্যাগ করলেন, অথচ আগে তাঁর কোনো শারীরিক অসুস্থতা ছিল না?

এই প্রশ্নগুলো নিছক ঐতিহাসিক ঘটনা নয়; বরং এগুলো ইসলামী ইতিহাসের এক গভীর বার্তা— এক জাগরণী আহ্বান, যা চিন্তাশীল ও হৃদয়বান মানুষের বিবেককে নাড়া দেয়।

আল্লাহ তাআলা বলেন, “নিশ্চয়ই এতে উপদেশ রয়েছে তার জন্য, যার হৃদয় আছে, অথবা যিনি মনোযোগ দিয়ে শোনেন এবং অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করেন।” [সূরা ক্বাফ, আয়াত ৩৭]

হযরত ফাতিমা যাহরা (সা.আ.)-এর আদর্শে বেলায়েত রক্ষা
হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমিন সাইয়্যেদ মাহদী তাওয়াক্কুল আরও বলেন, আমাদের উচিত হযরত ফাতিমা যাহরা (সা.আ.)-এর জীবন থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা—তাঁর দৃঢ়তা, ত্যাগ, সত্যনিষ্ঠা এবং বেলায়েতের পথে অবিচল অবস্থানকে নিজেদের জীবনের আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করা।

আল্লাহ তাআলা বলেন, “তারা এর আগে আল্লাহর সঙ্গে অঙ্গীকার করেছিল যে, তারা কখনো পৃষ্ঠ প্রদর্শন করবে না (অর্থাৎ, শত্রুর মুখোমুখি হয়ে পলায়ন করবে না); এবং আল্লাহর অঙ্গীকার সম্পর্কে অবশ্যই জিজ্ঞাসা করা হবে।”
[সূরা আহযাব, আয়াত ১৫]

অতএব, আমাদেরও উচিত এই ঈমানী অঙ্গীকার রক্ষা করা— কখনো যেন আমরা ظالم (জালেম), استکباری (অহংকারী আধিপত্যবাদী) ও مستبد (স্বৈরাচারী) শক্তির সামনে নতি স্বীকার না করি। বরং হযরত ফাতিমা যাহরা (সা.আ.)-এর মতো সর্বশেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত বেলায়েত ও সত্যের পক্ষে অবিচল থাকা।

যেভাবে তিনি খিলাফতের গাসিব ও বিভ্রান্তিকারীদের সঙ্গে কোনো আপস করেননি, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তাঁদের সঙ্গে কথা পর্যন্ত বলেননি—তেমনি আমরাও যেন এই প্রতিরোধ, প্রতিবাদ ও বেলায়েতরক্ষার ময়দান এক মুহূর্তের জন্যও খালি না রাখি।

وَالسَّلَامُ عَلَى فَاطِمَةَ يَوْمَ وُلِدَتْ وَيَوْمَ اسْتُشْهِدَتْ وَيَوْمَ تُبْعَثُ حَيًّا
সালাম হোক হযরত ফাতিমা যাহরা (সা.আ.)-এর ওপর—
যেদিন তিনি জন্মগ্রহণ করেন, যেদিন তিনি শাহাদত লাভ করেন এবং যেদিন তিনি পুনরুত্থিত হবেন জীবিত অবস্থায়।

আপনার কমেন্ট

You are replying to: .
captcha