শুক্রবার ৭ নভেম্বর ২০২৫ - ১২:২৫
মুহসিন ইবনে আলীর শাহাদাত-বাস্তবতা না কেবল কাহিনি?

ফাতিমিয়াহ উপলক্ষে আমরা চেষ্টা করছি হযরত ফাতিমা যাহরা (সা.)-এর সংগ্রামী, রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবনধারা এবং তাঁর অনন্য ও চিরস্থায়ী ভূমিকা ঐতিহাসিক নির্ভরযোগ্য উৎসের আলোকে বিশ্লেষণ করতে, যাতে ইসলামের প্রারম্ভিক যুগের ঘটনাবলির একটি পূর্ণাঙ্গ চিত্র পাওয়া যায়।

হাওজা নিউজএজেন্সি রিপোর্ট অনুযায়ী, তৃতীয় আক্রমণ বা মূল হামলায়, যা শেষ পর্যন্ত হযরত ফাতিমা যাহরা (সা.)-এর শাহাদাতের কারণ হয়, উমর ইবনে খাত্তাব তাঁর অনুগামীদের নিয়ে ফাতিমা (সা.)-এর গৃহদ্বারে উপস্থিত হয়।

আল্লামা মজলেসি লিখেছেন: উমর একদল লোকসহ আমিরুল মুমিনিন (আ.)-এর বাড়িতে আসে এবং তাঁকে বাইরে আসতে বলে। আমিরুল মুমিনিন (আ.) বের হতে অস্বীকার করলে, উমর আগুন ও জ্বালানি কাঠ আনতে বলে।
(বিহারুল আনওয়ার, খণ্ড ২৮, পৃষ্ঠা ২০৪)

এই আক্রমণে প্রতিরোধ বা প্রতিবাদের কোনো চিহ্ন ছিল না

শাহরাস্তানি লিখেছেন: সেই দিনে ঘরে আমিরুল মুমিনিন (আ.), ফাতিমা (সা.) এবং হাসান ও হুসাইন (আ.) ছাড়া আর কেউ ছিলেন না।
(আল-মিলাল ওয়ান নিহাল, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ৭১)

তখন উমর চিৎকার করে বলল: আল্লাহর কসম, আমি এই ঘরে আগুন লাগাবো।

এই সময় হযরত ফাতিমা (সা.) দরজার পেছনে এসে দাঁড়ালেন এবং উমরকে সম্বোধন করে বললেন: আমি এমন কোনো জাতিকে চিনি না যারা তোমাদের মতো বিশ্বাসভঙ্গকারী ও হৃদয়হীন। তোমরা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর জানাজা আমাদের উপর রেখে নিজেরাই খিলাফত দখলে ব্যস্ত হলে। আমাদের সঙ্গে পরামর্শ করলে না, আমাদের অধিকারও মানলে না। মনে হচ্ছে, তোমরা গাদিরে খুমে নবীর (সা.) ঘোষণার কথা সম্পূর্ণ ভুলে গিয়েছ। আল্লাহর কসম, সে দিন নবী (সা.) এমনভাবে আলীর (আ.) নেতৃত্বকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন যাতে আর কোনো লোভ বা আশা কারও অবশিষ্ট থাকে না। কিন্তু তোমরা তা উপেক্ষা করলে এবং নবীর (সা.) সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করলে। আল্লাহই আমাদের মধ্যে ন্যায়বিচার করবেন।
(বিহারুল আনওয়ার, খণ্ড ২৮, পৃষ্ঠা ২০৪)

উমর তখন নিজের হুমকি বাস্তবায়ন করে ফাতিমা (সা.)-এর দরজায় আগুন ধরিয়ে ঘরে প্রবেশ করে।
যখন ফাতিমা (সা.) প্রতিবাদে দাঁড়ালেন, সে তলোয়ারের খাপ দিয়ে তাঁর পাঁজরে আঘাত করে।

চতুর্থ হিজরী শতাব্দীর ঐতিহাসিক মাসউদীর গ্রন্থ ইস্‌বাতুল ওসিয়্যাহ (পৃষ্ঠা ১৪৬)-এ বর্ণিত হয়েছে: তারা ঘরে হানা দেয়, দরজায় আগুন লাগায়, আমিরুল মুমিনিন (আ.)-কে জোর করে বের করে আনে এবং নারীদের নেত্রী ফাতিমা (সা.)-কে দরজার আড়ালে এমনভাবে চেপে ধরে যে, তাঁর গর্ভস্থ সন্তান মুহসিন (আ.) গর্ভপাতের মাধ্যমে শাহাদাত বরণ করে।

মুহসিন ইবনে আলী (আ.)-এর গর্ভপাত সংক্রান্ত বর্ণনা

গ্রন্থ আল-ইখতিসাস-এ ইমাম জাফর সাদিক (আ.)-এর সূত্রে এসেছে যে, হযরত ফাতিমা (সা.)-এর ফাদাক সংক্রান্ত প্রতিবাদের ঘটনাতেই মুহসিন (আ.)-এর গর্ভপাত ঘটে।
তবে কিছু ঐতিহাসিক সূত্র অনুযায়ী এটি সেই ঘরে হামলার সঙ্গেই সম্পর্কিত।

মুহাম্মদ ইবনে আবদুল করিম শাহরাস্তানি (মৃ. ৫৪৮ হি.) তাঁর আল-মিলাল ওয়ান নিহাল-এ ইব্রাহিম ইবনে সিয়ার, যিনি নয্‌যাম নামে পরিচিত (মৃ. ২২১ হি.)—এর উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন: উমর ইবনে খাত্তাবের আঘাতেই ফাতিমা (সা.)-এর গর্ভস্থ সন্তান মুহসিন (আ.) গর্ভপাত করেন।

তদ্রূপ, ইবনে আবিল হাদীদ মুতাযিলি (মৃ. ৬৫৬ হি.), যিনি নাহজুল বালাগা-এর ব্যাখ্যাকার, তিনিও তাঁর শিক্ষক আবু জাফর নকীবের সঙ্গে আলোচনায় উল্লেখ করেন যে, আলীর (আ.)-এর কাছ থেকে জোর করে বায়াত নেওয়ার সময়ই মুহসিন (আ.) গর্ভপাতের শিকার হন।

মুহসিন ইবনে আলী (আ.) সম্পর্কে হাদিসসমূহ

ইমাম জাফর সাদিক (আ.) বলেন: কিয়ামতের দিনে রাসূলুল্লাহ (সা.) আহ্বান করা হবে। তিনি লাল চাদর পরিহিত অবস্থায় আরশের ডান পাশে দাঁড়াবেন।
এরপর ইব্রাহিম (আ.) সাদা পোশাকে বাম পাশে দাঁড়াবেন।
তারপর ফাতিমা (সা.) তাঁর সন্তান ও শিয়া অনুসারীদের সঙ্গে আহ্বান করা হবে, তারা বিনা হিসাবেই জান্নাতে প্রবেশ করবেন।
তখন আরশের গভীর থেকে এক আহ্বান আসবে:
‘হে মুহাম্মদ! সর্বশ্রেষ্ঠ পিতা তোমার পিতা ইব্রাহিম,
সর্বশ্রেষ্ঠ ভাই তোমার ভাই আলী ইবনে আবি তালিব,
সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তান তোমার সন্তান হাসান ও হুসাইন,
এবং সর্বশ্রেষ্ঠ গর্ভজাত সন্তান তোমার সন্তান মুহসিন।
(বিহারুল আনওয়ার, খণ্ড ৭, পৃষ্ঠা ৩২৮)

ফাযল কাশানী বর্ণনা করেন: উমর ইবনে খাত্তাব তাঁর অনুচর কুনফুযকে নির্দেশ দেন যেন সে তার হাতে থাকা চাবুক দিয়ে ফাতিমা (সা.)-কে আঘাত করে।
কুনফুয এত চাবুক মারল যে ফাতিমা (সা.)-এর পিঠ ও পাঁজর আহত হয়,
এবং সেই আঘাতেই তাঁর গর্ভস্থ সন্তান মুহসিন (আ.)-এর গর্ভপাত ঘটে।
নবী (সা.)-ই তাঁর নাম রেখেছিলেন ‘মুহসিন’।
(নাওয়াদিরুল আখবার, পৃষ্ঠা ১৮৩)

আমিরুল মুমিনিন (আ.) শাহাদাতের পর ফিয্জাহকে নির্দেশ দেন: তাঁকে (মুহসিনকে) ঘরের শেষে কবর দাও,
তিনি তাঁর দাদা মুহাম্মদ মুস্তাফা (সা.)-এর সঙ্গে মিলিত হয়েছেন।
(আল-হিদায়াতুল কুবরা, পৃষ্ঠা ৪১৭)

ইমাম মাহদী (আ.)-এর যুগে মুহসিন (আ.)-এর ভূমিকা

ইমাম জাফর সাদিক (আ.) বলেন: যখন হযরত মাহদী (আ.) প্রকাশিত হবেন, তখন খদিজা বিনতে খুয়াইলিদ ও ফাতিমা বিনতে আসাদ—যারা মুহসিন (আঃ)-এর দুই দাদি—তাঁকে (মুহসিনকে) রক্তমাখা অবস্থায় নিয়ে আসবেন।
তাঁর মা ফাতিমা (সা.) তখন ক্রন্দন করে বলবেন: ‘এটাই সেই প্রতিশ্রুত দিনের আগমন।
জিবরাইল ডাক দেবেন: তিনি মাজলুম, তাঁকে সাহায্য করো।
এবং মুহসিন (আ.) বলবেন: ‘আমি মাজলুম, আমায় সাহায্য কর।

মুফাজ্জাল ইমাম সাদিক (আ.)-কে জিজ্ঞেস করলেন: হে প্রভু! আল্লাহর এ বাণী— ‘যখন জীবন্ত কবর দেওয়া কন্যাকে জিজ্ঞেস করা হবে, কোন অপরাধে তাকে হত্যা করা হলো?’—এর অর্থ কী?
ইমাম (আঃ) উত্তর দিলেন:
“সাধারণ মানুষ বলে এটি সকল নিহত ভ্রূণ সম্পর্কে।
কিন্তু হায়! তারা জানে না—এই আয়াত কেবল আমাদের ব্যাপারে নাজিল হয়েছে।
এতে যে গর্ভস্থ শিশুর কথা বলা হয়েছে, সে হলো মুহসিন (আ.)।
কেননা সে আমাদেরই অংশ,
যেমন আল্লাহ বলেন: ‘বলুন, আমি তোমাদের কাছে আমার বার্তার জন্য কোনো প্রতিদান চাই না, শুধু আমার আত্মীয়দের প্রতি ভালোবাসা চাই।’
সুতরাং এ আয়াতে উল্লিখিত ‘মাওদাহ’ (ভালোবাসা) আমাদেরই জন্য, অন্য কারও নয়।
অতএব, যে কেউ অন্য অর্থে ব্যাখ্যা করবে, তাকে মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত কর।”
(বিহারুল আনওয়ার, খণ্ড ৫৩, পৃষ্ঠা ২৩)

রিপোর্ট: হাসান রেজা

আপনার কমেন্ট

You are replying to: .
captcha