সোমবার ২৪ নভেম্বর ২০২৫ - ১৬:৪০
হযরত ফাতিমা যাহরা (সা.আ.) কেবল নারীকুল নয়, পুরো মানব জাতির আদর্শ

হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমিন মাওলানা আমজাদ হোসেন বলেছেন, হযরত ফাতিমা যাহরা (সা.আ.)-এর জীবন এমন এক আদর্শিক মানদণ্ড, যা নারীকুলের সীমা অতিক্রম করে সম্পূর্ণ মানব জাতির নৈতিক, আধ্যাত্মিক ও সামাজিক পথনির্দেশিকা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। তিনি বলেন, “যাহরার (সা.আ.) ব্যক্তিত্ব হচ্ছে পরিপূর্ণ ইমান, ইবাদত, ন্যায়, আত্মসমর্পণ ও মানবিকতার সংমিশ্রণ।”

আইয়্যামে ফাতিমিয়া উপলক্ষে হাওজা নিউজ এজেন্সি’কে দেয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে বিশিষ্ট ইসলামি বিশ্লেষক ও বাংলাদেশ শিয়া উলামা সোসাইটির জনসংযোগ ও যোগাযোগ সম্পাদক হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমিন মাওলানা আমজাদ হোসেন বলেন,  “হযরত ফাতিমা যাহরা (সা.আ.)-এর ব্যক্তিত্ব এমন এক সর্বজনীন মানবিক ও আধ্যাত্মিক আদর্শ, যা নারীদের সীমা অতিক্রম করে সমগ্র মানবজাতিকে ন্যায়, ইবাদত, সাহস, চরিত্র ও আল্লাহ-নির্ভরতার সর্বোচ্চ মানদণ্ড শিখিয়ে দেয়।” তিনি আরও বলেন, “মাসুম ইমামদের জীবনেও যাহরা (সা.আ.) অনুসরণীয়। ইমাম মাহদী (আ.ফা.) নিজেই বলেছেন—হযরত যাহরা (সা.আ.)-ই তাঁর আদর্শ।”

পাঠকদের জন্য  নিচে এই গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষাৎকারটির সারাংশ তুলে ধরছি:

হাওজা নিউজ এজেন্সি: হযরত ফাতিমা যাহরা (সা.আ.)-এর শ্রেষ্ঠত্বের মূল ভিত্তি কী?

হুজ্জাতুল ইসলাম মাওলানা আমজাদ হোসেন: শিয়া-সুন্নি নির্বিশেষে সকল রেওয়ায়াতে যাহরা (সা.আ.)-কে “সাইয়্যিদাতু নিসায়িল আলামীন”—সকল যুগের শ্রেষ্ঠ নারী—হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। ইমাম বাকির (আ.) বর্ণনা করেন যে তিনি ছিলেন ইসমতধারী, অর্থাৎ আল্লাহর পক্ষ থেকে বিশেষভাবে পাপমুক্ত এবং নূরানী চরিত্রের অধিকারী।

তাঁর ইবাদত, বিনয়, আল্লাহর পথে নিবেদন, সত্য প্রতিষ্ঠায় দৃঢ়তা এবং নবুওয়ত ও ইমামতের ধারাবাহিকতার কেন্দ্রবিন্দু হওয়াই তাঁকে মানবতার সর্বোচ্চ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছে। তিনি এমন এক আদর্শ, যার আলো কোনো সময়ের সীমানায় আটকে নেই।

হাওজা নিউজ: ইমাম মাহদী (আ.ফা.) হযরত ফাতিমা (সা.আ.)-কে নিজের আদর্শ বলে যে হাদিস উল্লেখ করেছেন, সেটির তাৎপর্য কী?

মাওলানা আমজাদ হোসেন:  ইমাম মাহদী (আ.ফা.) বলেন—
فِي ابْنَةِ رَسُولِ اللَّهِ لِي أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ
“রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কন্যা হযরত ফাতিমা (সা.আ.)-ই আমার জন্য সর্বোত্তম আদর্শ।”

এই ঘোষণা অত্যন্ত গভীর একটি বিষয়। মাসুম ইমাম—যিনি সকল নবীদের সর্বশেষ প্রতিনিধি, যিনি বিশ্বে ন্যায়ের সরকার প্রতিষ্ঠা করবেন—তিনি তাঁর আদর্শ হিসেবে যাঁর জীবনকে গ্রহণ করছেন, তা প্রমাণ করে যে যাহরা (সা.আ.)-এর চরিত্রই ন্যায়নিষ্ঠা, নেতৃত্ব, আধ্যাত্মিকতা ও মানবকল্যাণের সর্বোচ্চ মানদণ্ড।

ইমাম মাহদী (আ.ফা.)-এর মিশনের ভিত্তি—ন্যায় প্রতিষ্ঠা, জুলুমের বিরুদ্ধে সংগ্রাম, মানবতার পুনর্জাগরণ—এসবই যাহরা (সা.আ.)-এর জীবনের প্রতিফলন।

হাওজা নিউজ: হযরত ফাতিমা (সা.আ.)-এর পারিবারিক জীবন আজকের মানব সমাজকে কী শিক্ষা দেয়?

মাওলানা আমজাদ হোসেন: তাঁর ঘরকে “বায়তুল নূর বা নূরের ঘর"—বলা হয়েছে। এতে স্বয়ং রাসুলুল্লাহ (সা.) প্রশান্তি লাভ করেছেন, ইমাম আলী (আ.), ইমাম হাসান-হুসাইন (আ.), হযরত জায়নাব (সা.আ.)-এর মতো বিশ্বমানবতার আদর্শ চরিত্রগুলো গড়ে উঠেছে।

আজকের সমাজ তাঁর জীবন থেকে শিখতে পারে—
• পরিবার তাওহিদভিত্তিক হতে হবে
• সন্তানদের নৈতিক ও আধ্যাত্মিক শিক্ষায় সর্বোচ্চ মনোযোগ দিতে হবে
• দুনিয়াবিমুখ সরলতা
• স্বামী-স্ত্রীর পরস্পরের প্রতি দায়িত্বশীলতা
• চরম দুঃখ–কষ্টেও আল্লাহর প্রতি সম্পূর্ণ ভরসা

তিনি প্রমাণ করেছেন—একটি আদর্শ পরিবারই সমাজের নৈতিক ভিত্তি নির্মাণ করে।

হাওজা নিউজ: সামাজিক ও রাজনৈতিক দায়িত্ব পালনে হযরত যাহরা (সা.আ.) কীভাবে আদর্শ উদাহরণ?

মাওলানা আমজাদ হোসেন: তাঁর “খুতবা-এ-ফাদাক” ইসলামি ইতিহাসের এক অনন্য রাজনৈতিক ও নৈতিক দলিল। সেখানে তিনি ইসলামী মূল্যবোধ, ন্যায়, শাসন, মানবাধিকার—সব বিষয়ে অত্যন্ত যুক্তিপূর্ণ বক্তব্য দিয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে কণ্ঠ তুলে ধরেন।

এটি তিনটি মূল শিক্ষা দেয়—

১. অন্যায়ের সামনে নীরব থাকা ইসলামের শিক্ষা নয়

২. সত্যকে যুক্তি, প্রজ্ঞা ও সাহসের সাথে প্রতিষ্ঠা করতে হবে

৩. নারীও সমাজ-রাজনীতির দায়বদ্ধ অংশ—অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ তাঁর অধিকার ও দায়িত্ব

হযরত যাহরা (সা.আ.) দেখিয়েছেন—ন্যায়ের আন্দোলনের প্রথম পদক্ষেপ হলো সচেতনতা এবং সাহসিকতা।

হাওজা নিউজ: ইবাদত ও আধ্যাত্মিকতায় যাহরা (সা.আ.)-এর জীবন আমাদের আধুনিক মানুষকে কী শিক্ষা দেয়?

মাওলানা আমজাদ হোসেন: ইমাম সাদিক (আ.) বলেন, “হযরত যাহরা (সা.আ.) এত দীর্ঘ সিজদা ও কিয়ামে ইবাদত করতেন যে তাঁর পায়ের পাতা ফুলে যেত।”

সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ হলো— তিনি নিজের জন্য নয়, প্রথমে উম্মাহর জন্য দোয়া করতেন।

আজকের মানুষের জন্য তাঁর শিক্ষা—
• আল্লাহনির্ভর আধ্যাত্মিকতা
• নিজের আগে সমাজের কল্যাণ চিন্তা
• আত্মশুদ্ধি
• জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আল্লাহর সন্তুষ্টি লক্ষ্য করা
• তাঁর ইবাদত আমাদের শিখায়—সত্যিকার ধর্মীয়তা হলো আত্মপরিশুদ্ধি ও মানবসেবা।

সাক্ষাৎকারের শেষে মাওলানা আমজাদ হোসেন বলেন, “আজকের দুনিয়া যখন নৈতিক অবক্ষয়, অন্যায়, পরিবার সংকট, ও আত্মিক শূন্যতার মধ্যে নিমজ্জিত—তখন হযরত ফাতিমা যাহরা (সা.আ.)-এর জীবনই মানবতার সামনে আলোর পথ দেখিয়ে দেয়। তিনি কেবল নারীর নয়, বরং সকল যুগের মানুষের পরিপূর্ণ আদর্শ।”

Tags

আপনার কমেন্ট

You are replying to: .
captcha