বুধবার ১৯ নভেম্বর ২০২৫ - ২২:০২
দ্বীনের তাবলীগে আত্মশুদ্ধি ও আমলওয়ালা আলেমের অপরিহার্যতা

ইসলামী সমাজে দাওয়াত ও তাবলীগ কেবল মুখের বয়ান বা জ্ঞানের উপস্থাপন নয়; বরং তা এক গভীর আত্মিক দায়িত্ব, যা আত্মশুদ্ধি ও আমলের সততার ওপর নির্ভরশীল। কুরআন ও আহলে বাইতের (আ.) শিক্ষা স্পষ্টভাবে বলে—যে আলেম নিজেকে পরিশুদ্ধ করেননি, তাঁর দাওয়াত মানুষের হৃদয়ে প্রভাব ফেলতে পারে না।

হাওজা নিউজ এজেন্সি'র সঙ্গে এই বিষয়ে এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে কথা বলেছেন ইসলামি গবেষক ও চিন্তাবিদ হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমিন ড. মুহাম্মাদ ফারুক হুসাইন; পাঠকদের জন্য সাক্ষাৎকারটির সারসংক্ষেপ তুলে ধরছি:

হাওজা নিউজ এজেন্সি: দ্বীনের দাঈ বা মুবাল্লিগদের জন্য আত্মশুদ্ধি কেন প্রথম শর্ত বলে গণ্য হয়?

হুজ্জাতুল ইসলাম ড. মোহাম্মাদ ফারুক হুসাইন: তাবলীগের মূল উদ্দেশ্য হলো মানুষকে আল্লাহর দিকে ডাকা। কিন্তু যদি দাঈ নিজেই আত্মিকভাবে আল্লাহর পথে না যায়, তবে সে কিভাবে অন্যকে আহ্বান করবে? কুরআনে আল্লাহ বলেন,

“হে মুমিনগণ! তোমরা নিজেদের ও তোমাদের পরিবারকে আগুন থেকে রক্ষা করো।” [সুরা তাহরিম, ৬]

অতএব, দাওয়াতের প্রথম ধাপ নিজেকে সংস্কার করা। ইমাম আলী (আ.) বলেছেন,

 “যে নিজেকে সংস্কার করে, তার কথা মানুষের হৃদয়ে অধিক প্রভাব ফেলে।” [নাহজুল বালাগা, হিকমত ৭৩]

এই কারণেই ইসলামি ঐতিহ্যে “تربیت النفس” বা আত্মশুদ্ধিকে জ্ঞানের পূর্বশর্ত বলা হয়েছে।

হাওজা নিউজ: একজন আলেম যদি জ্ঞানে পারদর্শী হন কিন্তু আমল ও আত্মশুদ্ধিতে দুর্বল হন, তবে তাঁর দাওয়াত সমাজে কী প্রভাব ফেলে?

ড. ফারুক হুসাইন: আল্লাহ তায়ালা কুরআনে সতর্ক করেছেন,

“তুমি কি সেই লোকদের দেখনি, যারা অন্যদের নেক কাজের আদেশ দেয় অথচ নিজেদের ভুলে যায়?” [সুরা বাকারা, ৪৪]

এমন আলেমের বয়ান মানুষের অন্তরে স্থায়ী প্রভাব ফেলে না। ইমাম জাফর সাদিক (আ.) বলেছেন,

“যে আলেম নিজের জ্ঞান অনুযায়ী আমল করে না, তার নসিহত মানুষের অন্তরে প্রভাব ফেলে না।” [আল-কাফি, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ৪৪]

তাই ইসলামী ইতিহাসে প্রকৃত দাঈ সেই, যার মুখের কথা ও জীবনের বাস্তবতা একই।

হাওজা নিউজ: আজকের সমাজে ‘আমলওয়ালা আলেম’-এর অভাব কেন দেখা যাচ্ছে, এবং এর প্রতিকার কীভাবে সম্ভব?

ড. ফারুক হুসাইন: সমাজ আজ এমন এক সময়ে আছে, যেখানে বাহ্যিক জ্ঞান বেশি কিন্তু আত্মিক উপলব্ধি কম। কুরআনে আল্লাহ বলেন, “আল্লাহ কোনো জাতির অবস্থা পরিবর্তন করেন না, যতক্ষণ না তারা নিজেরা নিজেদের পরিবর্তন করে।” [সুরা রা’দ, ১১]

অতএব, পরিবর্তন শুরু হবে অন্তর থেকে। ইমাম বাকির (আ.) বলেছেন,

“আলেম যদি আল্লাহভীরু না হয়, তবে তার জ্ঞান তার জন্য বিপদ হয়ে দাঁড়ায়।” [তুহাফুল উকূল, পৃ. ২৯৪]

আমলওয়ালা আলেম গড়ে তুলতে হলে হাওজায়ে ইলমিয়া ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে “আত্মশুদ্ধির তালীম” বাধ্যতামূলক করতে হবে, যেন জ্ঞানের সঙ্গে চরিত্রও গঠিত হয়।

হাওজা নিউজ: ইমাম মাহদী (আ.ফা.)-এর যুগের তাবলীগের প্রস্তুতির ক্ষেত্রে আত্মশুদ্ধির ভূমিকা কী?

ড. ফারুক হুসাইন: ইমাম মাহদী (আ.ফা.)-এর বিশ্ববিপ্লব হবে ন্যায়, সততা ও তাকওয়ার ওপর প্রতিষ্ঠিত। তাই তাঁর প্রকৃত সহায়কেরা হবে পবিত্র হৃদয়ের ধারক। কুরআন ঘোষণা করেছে,

“নিশ্চয়ই সে সফল হয়েছে, যে নিজেকে পরিশুদ্ধ করেছে।” [সুরা শামস, ৯]

ইমাম সাজ্জাদ (আ.) বলেছেন,

“আমাদের কায়েম (আ.ফা.)-এর আনুগত্য কেবল তাদের জন্য, যাদের অন্তর পবিত্র ও আমল আল্লাহর জন্য খাঁটি।” [বিহারুল আনওয়ার, খণ্ড ৫২, পৃষ্ঠা ৩২৫]

অতএব, মাহদাভী সমাজ গঠনের জন্য প্রতিটি আলেম ও তাবলীগকারীর উচিত নিজের আত্মাকে প্রস্তুত করা।

হাওজা নিউজ: আলেমদের জন্য আত্মশুদ্ধি ও আমলিক সততার আদর্শ কী হওয়া উচিত—এ বিষয়ে আহলে বাইত (আ.) আমাদের কী শিক্ষা দিয়েছেন?

ড. ফারুক হুসাইন: কুরআন বলছে,

 “তোমরা যা বলো, তা কেন (নিজে) করো না?” [সুরা সফ, ২–৩]

ইমাম হুসাইন (আ.) এই আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেছেন, “হে আলেমগণ! তোমরাই সমাজের দায়িত্বশীল। কিন্তু তোমরা যদি নিজের আমল দ্বারা দৃষ্টান্ত না হও, তবে অন্যরা কেমন করে সৎ হবে?” [তুহাফুল উকূল, পৃ. ২৪৫]

অর্থাৎ আলেমের প্রকৃত নেতৃত্ব জ্ঞান নয়, বরং আমল। তাঁর জীবনের প্রতিটি দিক হতে হবে আল্লাহর নির্দেশের প্রতিফলন।

দ্বীনের তাবলীগ এক পবিত্র দায়িত্ব, যা কথায় নয়, কর্মে প্রকাশ পায়। আহলে বাইত (আ.)-এর শিক্ষা হলো—“নিজেকে পরিশুদ্ধ করো, বিশ্ব আপনিই ঠিক হয়ে যাবে।” আত্মশুদ্ধি ও আমলওয়ালা আলেমই পারেন সমাজে সত্যিকারের রুহানিয়াত ফিরিয়ে আনতে এবং ইমাম মাহদী (আ.ফা.)-এর দাওয়াতের মজবুত ভিত্তি স্থাপন করতে।

Tags

আপনার কমেন্ট

You are replying to: .
captcha